আমাদের এই অসীম মহাবিশ্বে রয়েছে অগণিত মহাজাগতিক বস্তু যারা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের এই বিশাল মহাকাশে। কিন্তু কিছু মহাজাগতিক বস্তু আবার মাঝে মাঝে আমাদের সোলার সিস্টেমে ঢুকে পড়ে যারা হয়তো অন্য কোনো সোলার সিস্টেম থেকে এসেছে। এমনি এক মহাজাগতিক বস্তু অন্য সোলার সিস্টেম থেকে আমাদের সোলার সিস্টেমে ঢুকে পড়েছিলো আর আমরা নিশ্চয়ই সেটি সবাই জানি। সেই মহাজাগতিক বস্তুটির নাম ছিলো “Oumuamua.” মহাজাগতিক বস্তু বলতেই আমরা বুঝি গ্রহাণু, উল্কা, মহাজাগতিক ধূলিকণা ইত্যাদি কিন্তু মহাকাগতিক বস্তু আমাদের এই মহাবিশ্বে রয়েছে অগণিত। তেমনি Asteroid বা গ্রহাণু হলো সেই সকল মহাজাগতিক বস্তুগুলোর মধ্যে অন্যতম। Asteroid বা গ্রহাণুর নাম শুনে নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া নিতান্তই দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রতিনিয়তই পত্রিকাতে কমবেশি আমরা পৃথিবীতে গ্রহাণু, উল্কাদের আঁচড়ে পড়ার খবর পড়ে থাকি কিংবা খবরে তা শুনতে পাই। প্রতিনিয়ত অসংখ্য গ্রহাণু আমাদের পৃথিবীর পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। যারা জানেন না তাঁদের মনে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক যে কি এই গ্রহাণু? চলুন তবে তা জেনে আসা যাক।
Asteroid বা গ্রহাণুঃ

এই Asteroid বা গ্রহাণুগুলো হলো মূলত মহাজাগতিক পাথর। এরা মূলত পাথর, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, ধাতু দিয়ে তৈরী। এরা তাদের নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে। এই গ্রহাণুগুলো বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। আমাদের সৌরজগতে গ্রহাণুগুলো “ক্ষুদ্র গ্রহ (Minor Planet)” নামক শ্রেণীর সবচেয়ে পরিচিত বস্তু। আর বৃহৎ গ্রহাণুগুলো “Planetoids” নামে পরিচিত। এই গ্রহাণুগুলো মূলত ছোট আকারের হয়ে থাকে এমনকি কিছু কিছু গ্রহাণু আবার বুধ গ্রহের চেয়েও ছোট। আপনারা কি জানেন আমাদের এই মহাবিশ্বের এতো অসংখ্য গ্রহাণুগুলো কোথায় অবস্থান করে? অধিকাংশ গ্রহাণুই “মঙ্গল (Mars) এবং বৃহস্পতি (Jupiter) গ্রহের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত “গ্রহাণু বেল্টে (Asteroid Belt)” অবস্থান করে। এরা এই গ্রহাণু বেল্টে থেকে নির্দিষ্ট উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে আবর্তন করে। ধারণা করা হয় যে গ্রহাণুগুলো “Protoplanetary Disc” এর অবশিষ্টাংশ। কিছু গ্রহাণুর আবার চাঁদও রয়েছে। ১৮০১ সালে নক্ষত্রের ম্যাপ বানানোর সময় কাকতালীয়ভাবে ইতালির জ্যোতির্বিদ “Giuseppe Piazzi” প্রথম একটি গ্রহাণু আবিষ্কার করে ফেলেন। এ যাবৎকালে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় গ্রহাণু হলো এটি। আর এই গ্রহাণুটির নামকরণ করা হয়েছে “Ceres.” এটি মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে প্রদক্ষিণ করে অর্থাৎ Asteroid Belt এ অবস্থান করে। এই গ্রহাণুগুলো তাদের বর্ণালীর বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়েছে। তবে অধিকাংশ গ্রহাণুই তিনটি প্রধান গ্রুপে বিভক্ত হয়। আর সেগুলো হলোঃ
- C – type
- M – type
- S – type
এই C – type, M – type এবং S – type এর নামের পেছনে যে কারণ রয়েছে তা কি আপনারা জানেন? যদি না জেনে থাকেন তবে চলুন আজকে তা জেনে আসা যাক।
- C – type গ্রহাণুগুলো হলো সেই সকল গ্রহাণু যারা কার্বন-সমৃদ্ধ। অর্থাৎ যেসকল গ্রহাণুতে কার্বনের পরিমাণ অত্যাধিক তারা এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত।
- M – type গ্রহাণুগুলো হলো সেই সকল গ্রহাণু যাদের মধ্যে ধাতুর পরিমাণ অনেক বেশি। অর্থাৎ ধাতব গ্রহাণুগুলো হলো এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত।
- S – type গ্রহাণুগুলো হলো সিলিকেট সমৃদ্ধ গ্রহাণু।
আশা করি এবার হয়তো আপনারা এই তিন শ্রেণীর গ্রহাণুর সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারনা পেয়েছেন। চলুন তবে এবার আশা যাক আসল কথায় যেই বিষয়টিকে নিয়ে আজ এই আর্টিকেল লিখছি।
1998 OR2:

২০২০ সাল নাগাদ অর্থাৎ আগামী বছরের দিকে প্রকান্ড এক গ্রহাণু আমাদের পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন। তো এখন অনেকেরই জানার ইচ্ছে জাগবে যে কতোটা বড় হতে পারে এই গ্রহাণু? NASA-র “Center for Near Earth Object Studies (CNEOS)” এর তথ্যমতে, গ্রহাণুটি প্রস্থে ৪ কিলোমিটার অর্থাৎ এর ব্যাস ১৩৫০০ ফুট এবং উচ্চুতায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ Mount Everest এর অর্ধেক। এই তথ্য শোনার পর নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন যে কতোটা প্রকান্ড এই গ্রহাণুটি। এই গ্রহাণুটির নাম রাখা হয়েছে 1998 OR2. মার্কিন গবেষণা সংস্থা NASA-র “Center for Near Earth Object Studies (CNEOS)” থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, এই গ্রহাণুটি যখন ২৯শে এপ্রিল, ২০২০ সালে ভোর ৫টা ৫৬ মিনিটে এর দিকে যখন পৃথিবীর পাশ ঘেঁষে যাবে তখন তা পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ৬.৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করবে। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে “Yarkovsky Effect” এবং “Gravitational Keyhole” এর কারণে গ্রহাণুটির পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তো আবার কি এই “Yarkovsky Effect?” ধৈর্য ধরুণ, বিস্তারিত বলছি।
“Yarkovsky Effect”:
Yarkovsky Effect হলো এমন একটি প্রভাব যেটি Thermal Photon এর Anisotropic Emission এর কারণে মহাকশে ঘূর্ণনরত কোন একটি বস্তুর উপর বল কাজ করে যা ভরবেগ (Momentum) বহন করে। এই প্রভাবটি সাধারণত Meteroids বা ছোট Asteroids (যাদের ব্যাসার্ধ ১০ সে. মি. – ১০ কি. মি.) এর উপর ঘটে থাকে। এই Thermal Photon এর Anisotropic Emission কি? এই প্রশ্নের জবাব আজ আর এই আর্টিকেলে দিচ্ছি না। হয়তো অন্য কোনো একটি আর্টিকেলে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। যাইহোক যা বলছিলাম, এই Yarkovsky Effect টি আবিষ্কার করেন একজন পলিশ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার “Ivan Osipovich Yarkovsky.” আর সর্বপ্রথম ১৯৯১-২০০৩ সালে “6489 Golevka” নামক গ্রহাণুর উপর এই Yarkovsky Effect পরিমাপ করা হয়।
Yarkovsky Effect গুলো হলোঃ
1. Radiation from asteroid’s surface
2. Prograde rotating asteroid
3. 1 location with “Afternoon”
4. Asteroid’s orbit
5. Radiation from Sun.
অনেকের কাছে হয়তো ২ এবং ৩ নাম্বার পয়েন্টটি বোধগম্য হয়ে উঠে নি। চলুন তবে এই দুটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করা যাক।
2. Prograde rotating asteroid:

Prograde rotating asteroid এর মানে হচ্ছে গ্রহাণুটি কোনদিকে ঘুরছে এবং সেই ঘূর্ণনের গতির দিক। অর্থাৎ গ্রহাণুটি যদি ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে (Anti clockwise) ঘুরে তবে তা ডানদিক থেকে বামদিকে ঘুরবে এবং এর গতির দিকও একই হবে। অর্থাৎ আমাদের সূর্য যেমন ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরে। আমাদের পৃথিবীও এই Prograde Rotation এ ঘুরে। আর এর বিপরীতটাকে বলা হয় “Retrograde Rotation.” আমাদের সৌরজগতের বুধ গ্রহ এই Retrograde Rotation এ ঘুরে। এমনকি Asteroid “Bennu” ও এই Retrograde Rotation ঘুরে। এই Prograde Rotation এবং Retrograde Rotation হিসেব করে আমরা যেকোনো গ্রহ, নক্ষত্র, গ্রহাণুর ঘূর্ণনের দিক এবং তার গতিকে পর্যবেক্ষণ করে তা নির্ণয় করতে পারি অতি সহজেই।
3. 1 location with “Afternoon”:

এটি বুঝতে হলে আপনাদেরকে উপরের চিত্রের দিকে লক্ষ্য করতে হবে। 1 location with “Afternoon” দিয়ে বুঝানো হয়েছে যে যদি কেউ গ্রহাণুর ঘূর্ণনের দিকে এবং সূর্যের বিকিরণের দিকে দেখে তবে উপরের চিত্রের যে অংশে লাল থার্মোমিটারটি আঁকা সেখানে ঐ গ্রহাণুর Afternoon মানে ঐ দিকটি সূর্য এর দিক থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। সাধারণত সূর্যের আলো যখন কোনো গ্রহাণুর উপর পড়ে তারপর তা ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে থাকে এবং বিকিরণ করা শুরু করে। আর রাতে তা ঠান্ডা হয়ে যায়।
“Gravitational Keyhole”:
এবার আবারো আসা যাক 1998 OR2 গ্রহাণুর ব্যাপারে। গ্রহাণুটির সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ হওয়ার অন্যতম দ্বিতীয় কারণটি হলো “Gravitational Keyhole.” অর্থাৎ প্রতিটি মহাজাগতিক বস্তু যখন কোনো গ্রহের বা নক্ষত্রের পাশ ঘেঁষে যায় তখন সেই মহাজাগতিক বস্তুটি ঐ গ্রহের বা নক্ষত্রের Gravitational Energy দ্বারা Gravitational Pool অনুভব করে। যার ফলে ঐ মহাজাগতিক বস্তুটির Trajectory Disturbance হয়। অর্থাৎ ঐ মহাজাগতিক বস্তুটির পথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। যদি কোনো গ্রহের সামনে দিয়ে কিংবা কোনো গ্রহের কক্ষপথ ঘেঁষে কোনো Spatial Body যেমন কোনো গ্রহাণু যায় তবে সেই গ্রহ তা নিজের দিকে টানে। তেমনিভাবে এই প্রভাবের কারণে 1998 OR2 ও হয়তো Gravitational Pool এর কারণে পৃথিবীর সাথে গ্রহাণুটির সংঘর্ষের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন। বর্তমানে NASA এই গ্রহাণুটি এবং তার গতিপথ নিয়ে তোড়জোড় গবেষণা চালাচ্ছে এবং গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করছে যে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে গ্রহাণুটি আমাদের পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে কিনা। যদি সংঘর্ষ হয় তবে তা কীরকম প্রভাব ফেলবে আমাদের এই পৃথিবীর উপর তা নিয়েও NASA নিরন্তর গবেষণা চালাচ্ছে।

সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর কি কোনো ক্ষতি হবে?
অনেকেই হয়তো ভাবছেন যেহেতু সংঘর্ষ হওয়ার প্রবণতা প্রবল তবে তা কী আমাদের পৃথিবীকে ডায়নোসরের যুগের মতো ক্ষতিগ্রস্থ করবে? না এরকম কোনো বৃহৎ ক্ষতি না হলেও পৃথিবীর কিছু প্রধান অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং তা আমাদের জন্য হুমকি স্বরূপ। যদি গ্রহাণুটি আমাদের পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তবে তা আমাদের পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে যার প্রভাব পড়বে আমাদের এই পৃথিবীর উপর। আমাদের এই পৃথিবীর আবহাওয়া এবং বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। আর এটি ঘটলে আমাদের এই গ্রহের আবহাওয়ার অর্থাৎ পুরো বায়ুমণ্ডলীয় সিস্টেমের মারাত্মক ক্ষতিসাধন ঘটবে।
এমন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গ্রহাণুর পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনার কথা শুনে থাকি। এখনো পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে কেউই বলতে পারছেনা যে গ্রহাণুটি পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে নাকি হবে না। কিন্তু বিজ্ঞানীদের গাণিতিক হিসাব এবং Yarkovsky Effectএর কারণে বিজ্ঞানীরা সংঘর্ষের প্রবল ধারণা করছেন। আমাদের এই পৃথিবীতে যেহেতু কোনো Thor বা Captain America নেই যে আমাদের এই পৃথিবীকে এই গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ থেকে বাঁচাবে। তাই আমরা শুধু প্রার্থনা করতে পারি যেন গ্রহাণুটি পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পৃথিবীর কোনো ক্ষতিসাধন না করে।