২০ জুলাই, ১৯৬৯ তারিখটা অবশ্যই সাধারণ কোনো দিন ছিল না। মানুষের অর্জনের অন্যতম একটা দিন হিসেবে তারিখটা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ এদিন মানুষ পা রাখে ৩,৮৪,৪০০ কিমি দূরের এক স্বর্গীয় বস্তুতে। যে বস্তুকে হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে কেউ পুঁজো করেছে, কেউ অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেছে আবার কেউ কবিতার মাধ্যমে নিজের প্রেয়সীর রূপ খুঁজে ফিরেছে। হ্যা, সেই অন্ধকার রাতের রহস্যময় চাঁদের কথা বলছি। সেই চাঁদে মানুষের পদার্পনের ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে এই ২০ জুলাই, ২০১৯ তারিখে। চলুন জেনে আসা যাক সেই অবিশ্বাস্য অর্জনের পেছনের গল্প।

বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত মহাকাশ প্রযুক্তির (Space Technology) বেশিরভাগ উন্নতি ঘটেছিল যুদ্ধের মাধ্যমেই। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিযোগীতা থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, কম্পিউটার সায়েন্সসহ বিজ্ঞানের প্রায় সবগুলো শাখাতেই উৎকর্ষ যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি ছিল। মূলত যুদ্ধবিমান আর মিসাইলের অনেক তত্ত্বই পরবর্তীতে কাজে লাগানো হয় রকেট উৎক্ষেপনের কাজে।
তো যাই হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ (Cold War) চলছিল তখনই শুরু স্পেস রেসের। কে কার আগে মহাকাশে রাজত্ব করতে পারবে এবং চাঁদে মানুষ পাঠাতে পারবে সেটাই ছিল তখনকার প্রধান যুদ্ধ। এ যেন আমাদের দেশে নদীর বুকে নতুন জেগে ওঠা চরের দখল নিয়ে এক যুদ্ধ। শুধু এখানে মারামারি-খুনোখুনির বদলে ছিল প্রযুক্তি আর এর ফল ছিল মানব ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠতম অর্জন।
স্পেস রেস নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের করা ম্যাগাজিনের কভার।
শুরুর দিকে এ যুদ্ধে বরাবরের মতই রাশিয়া ছিল একধাপ এগিয়ে। আর আমেরিকানদের কাছে সে যুদ্ধের বিষফোড়া ছিল ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবরে প্রেরিত রাশিয়ার স্পুটনিক-১। যা ছিল প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ। তারপর ১৯৬১ সালে রাশিয়ান মহাকাশচারী (Astronaut) ইউরি গ্যাগারিন (Yuri Gagarin) মহাকাশে ভ্রমন করা প্রথম মানুষের খ্যাতি পেয়ে যায় তখন ব্যাপারটা বুঝি আমেরিকানদের কাছে চরম অসহ্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন বেশি ভালো না আর অপরদিকে আমেরিকার অর্থনীতি জেগে উঠছে দ্রুতবেগে ঠিক তখন এই স্পেস রেসে আমেরিকার পিছিয়ে পরাটা আমেরিকানদের জন্য ছিল চরম অপমানজনক। আর সেজন্যই ১৯৬১ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলেন চাঁদে মানুষের অবতরণ। আর এভাবেই যাত্রা শুরু হয় অ্যাপোলো মিশনের।

পরের বছর রাইস স্টেডিয়ামে দেয়া কেনেডির এক ভাষণে নাসার বিজ্ঞানীরা দারুনভাবে অনুপ্রানিত হয়। আর সবাই অ্যাপোলো মিশনকে সফল করতে নিজের জীবনকে প্রায় উৎসর্গ করে ফেলেন। কিন্তু এই প্রায় অসম্ভব মিশনকে সফল করতে দরকার ছিল এক বিশাল বাজেট। নাসাকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট দেয়া হয় ১৯৬০ সালে। যা ছিল আমেরিকার জিডিপির (GDP) ২.৫%। আর এই বাজেট দেয়া হয় টানা ১০ বছর। অ্যাপোলো মিশন ১৯৬১-১৯৭২ সাল পর্যন্ত চালানো হয় যদিও কেনেডির স্বপ্ন সেই ১৯৬৯ সালেই পূরণ হয়েছিল। অ্যাপোলো ১১ এর পরে আরো অনেক মহাকাশচারী (Astronaut) চাঁদের মাটিতে পা রাখেন। কিন্তু প্রথম চাঁদে পা রাখাটা অবশ্যই এক অনন্য ঘটনা ছিল।
এবার চলুন অ্যাপোলো মিশনের সেই রোমাঞ্চকর গল্পগুলো জেনে নেয়া যাক।
অ্যাপোলো-১ বা অ্যাপোলো স্যাটার্ন-২০৪ (Apollo Saturn-204 or AS-204) ছিল ক্রু সহ প্রথম মিশন। এই মিশনটি ছিল পৃথিবীর কক্ষপথের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ২৭ জানুয়ারি, ১৯৬৭ সালে অ্যাপোলো-১ এর কমান্ড মডিউলে আগুন ধরে যায়। তখন সেখানে ৩ জন মহাকাশচারী (Astronaut) মিশনের প্রি-লঞ্চের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই দূর্ঘটনায় ৩ জন মহাকাশচারী (Astronaut) মারা যান। এটা অ্যাপোলো মিশনের জন্য একটা বড় ধাক্কা ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন অ্যাপোলো মিশন বুঝি শুরুতেই শেষ। কিন্তু তা না হয়ে নাসা আরো দৃঢ় হলো তাদের কাজে। বিজ্ঞানীরা মহাকাশাচারীদের জন্য সেফটির ব্যবস্থা আরো কড়াকড়ি করলেন। এবং তারপর থেকে অ্যাপোলো-৬ পর্যন্ত তারা ক্রু বিহীন মিশন পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে দিয়ে নাসা সেফটি সহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে । আর সেজন্যই অ্যাপোলো-১ এর পরে এই মিশনে আর কোন দূর্ঘটনা ঘটেনি। ঐ ৩ জনই ছিল অ্যাপোলো মিশনের প্রথম ও শেষ নিহত ব্যক্তি।
তারপর অ্যাপোলো-৭ কে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো হয় ১১ অক্টোবর, ১৯৬৮ সালে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় কক্ষপথে থেকে অ্যাপোলো-৭ ফিরে আসে ২২ অক্টোবরে। এই মিশনটিও একটি মাইলফলক ছিল। ক্রু মেম্বাররা এতে করে রকেটের সার্ভিস ও কমান্ড মডিউলের খুটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো ভালো ধারনা পেয়েছিলেন। সাথে মহাকাশে মেশিনের সাথে মানুষের একসাথে মিলে কাজ করার অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছিলো।
অ্যাপোলো-৭ এর সফলতার পরেই পাঠানো হয় প্রথম চন্দ্রাভিযান; যা ছিল অ্যাপোলো-৮। অ্যাপোলো-৮ মিশনেই প্রথমবারের মত মানুষ পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে চাঁদের কক্ষপথে যেতে সক্ষম হন। ১৯৬৮ সালের ২১ ডিসেম্বরে লঞ্চ হবার পরে ২৭ ডিসেম্বর অ্যাপোলো-৮ পৃথিবীতে ফিরে আসে। এটি ছিল পরবর্তী মিশনগুলোর পথিকৃত। এই মিশনের মাধ্যমেই নাসা মূলত নেভিগেশন সিস্টেমে অনেক উন্নতি আনে এবং আরো নতুন কৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হয়।
এরপর ১৯৬৯ সালের ৩ রা মার্চে পাঠানো হয় অ্যাপোলো-৯। এর মাধ্যমেই আরো যা যা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার বাকি ছিল সেগুলো সম্পন্ন করা হয়। পৃথিবীর কক্ষপথেই চাঁদের কক্ষপথের সকল ফাংশনালিটিও চেক করা হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ১৩ ই মার্চে অ্যাপোলো-৯ পৃথিবীতে ফিরে আসে।
তারপর মে মাসের ১৮ তারিখে পাঠানো হয় অ্যাপোলো-১০। অ্যাপোলো-১০ কে বলা যেতে পারে অ্যাপোলো-১১ এর কপি। অ্যাপোলো-১১ মিশনের মাত্র দুই মাস আগে এর সমস্ত ফাংশনালিটি শেষবারের মত চেক করে নেয়ার জন্যই একে পাঠানো হয়। এতে ছিল সার্ভিস ও কমান্ড মডিউল; যার নাম ছিল ‘চার্লি ব্রাউন’ (Charlie Brown), এতে ‘স্নুপি’ (Snoopy) নামে একটা লুনার মডিউলও ছিল। অ্যাপোলো-১১ এর যা যা করার কথা ছিল ঠিক তাই তাই করেছিল অ্যাপোলো-১০; শুধুমাত্র আসল চাঁদে অবতরণ ছাড়া।
অ্যাপোলো-১১ মিশন
অবশেষে দীর্ঘ ৯ বছরের প্রস্তুতি শেষে আসল সেই শুভক্ষণ। ১৬ জুলাই, ১৯৬৯। শক্তিশালী স্যাটার্ন ৫ (Saturn V) রকেটে করে অ্যাপোলো স্পেস ক্রাফটকে পাঠানো হয়েছিল। ফ্লোরিডায় অবস্থিত কেনেডি স্পেস সেন্টারের ৩৯ এ (39 A) নম্বর লঞ্চ প্যাড থেকে যাত্রা করে ৬.২ মিলিয়ন পাউন্ডস ওজনের বিশাল স্যাটার্ন ৫ (Saturn V) রকেট। যাত্রা করেন ৩ জন মহাকাশচারী- নীল আর্মস্ট্রং (Neil A. Armstrong), এডুইন অলড্রিন (Edwin E. Aldrin, Jr.) ও মাইকেল কলিন্স (Michael Collins) ; বহুপ্রতীক্ষিত স্বর্গীয় সেই চাঁদের উদ্দেশ্যে।
নীল আর্মস্ট্রং (Neil A. Armstrong) এডুইন অলড্রিন (Edwin E. Aldrin, Jr.) মাইকেল কলিন্স (Michael Collins)
স্যাটার্ন ৫ (Saturn V) রকেটকে মূলত ৩ টি ভাগে ভাগ করা যায়। আর রকেটের সবথেকে উপরের অংশে ছিল মূল অ্যাপোলো স্পেস ক্রাফট (Apollo Spacecraft)। অ্যাপোলো স্পেস ক্রাফটের মধ্যে ছিল আবার ৩ টি অংশঃ লুনার মডিউল (Lunar Module), সার্ভিস মডিউল (Service Module), কমান্ড মডিউল (Command Module)। কেবলমাত্র লুনার মডিউলটি চাঁদে অবতরন করেছিল। আর কমান্ড মডিউলের মধ্যেই মহাকাশচারীরা তাদের যাত্রার বেশিরভাগ সময় ছিলেন। মূল রকেটের একেবারে সবার উপরের অংশে ছিল আরেকটি রকেট যাকে বলা হয় লঞ্চ ইস্কেপ রকেট (Launch escape rocket)। এর কাজ মূলত; রকেট লঞ্চের সময় কোনো ধরনের দূর্ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে মূল রকেট থেকে কমান্ড মডিউলকে দ্রুত আলাদা করে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়া। মহাকাশচারীদের কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্যই মূলত এই ডিজাইন করা হয়েছিল।

Credit: National Geographic

লঞ্চ প্যাড (Launch Pad) থেকে যাত্রা শুরু করে বিশাল এই রকেট যখন পৃথিবী ছেড়ে ৪২ মাইল উপরে এবং এর গতি প্রায় ৬০০০ মাইল প্রতি ঘন্টায় তখন এর ৩ ধাপের প্রথম ধাপ রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরবর্তী ধাপে রকেট আরো গতি পায় এবং পৃথিবীর ১০৩ মাইল উপরে গিয়ে দ্বিতীয় ধাপ বিচ্ছিন্ন হয়। তৃরীয় ধাপে ১৩৩ মাইল উপরে অ্যাপোলো ১১ পৃথিবীর কক্ষপথে গিয়ে পার্কিং করে। এই পার্কিং কক্ষপথ থেকে পরবর্তীতে নির্দিষ্ট স্থান থেকে নির্দিষ্ট দিকে আরেকবার রকেটকে ফায়ার করা হয় এবং যাত্রা শুরু হয় চাঁদের কক্ষপথের উদ্দেশ্যে। এই ফায়ারকে বলা হয় ট্রান্সলুনার ইনজেকশন (Trans-Lunar Injection) ।
ট্রান্সলুনার ইঞ্জেকশন ট্রান্সলুনার ইঞ্জেকশন
অ্যাপোলো স্পেস ক্রাফটকে পৃথিবী থেকে চাঁদের কক্ষপথের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে স্যাটার্ন ৫ রকেটের কাজ এখন শেষ। তাই যাত্রা পথেই কমান্ড সার্ভিস মডিউল লুনার মডিউলকে সাথে নিয়ে তৃতীয় ধাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রকেট লঞ্চ থেকে তৃতীয় ধাপ পর্যন্ত মোট সময় লাগে মাত্র সাড়ে ৩ ঘন্টার মত। পরবর্তী ৩ দিন ধরে অ্যাপোলো স্পেস ক্রাফট মহাশুন্য ধরে যাত্রা করবে চাঁদের কক্ষপথের উদ্দেশ্যে যতক্ষণ না পর্যন্ত চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বলে চাঁদের কক্ষপথে আটকে যায়।
চাঁদের কক্ষপথে থেকেই আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন লুনার মডিউলে চলে যায় এবং অ্যাপোলো স্পেস ক্রাফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চাঁদে অবতরনের উদ্দেশ্যে চন্দ্রপৃষ্ঠের দিকে রউনা দেয়। এই লুনার মডিউলের নাম ছিল ‘ইগল’ (Eagle)। অন্যদিকে মাইকেল কলিন্স কমান্ড মডিউলেই থেকে যায় যার নাম ‘কলম্বিয়া’ (Columbia)। এই মডিউলে থেকেই কলিন্স কক্ষপথে চাঁদকে চক্কর কাটতে থাকে।
লুনার মডিউল অ্যাপোলো কমান্ড ও সার্ভিস মডিউল
লুনার মডিউলের গতি কমিয়ে একে নামিয়ে নিয়ে আসা হয় চাঁদের পৃষ্ঠে। তারপর ইগল থেকে বের হন নীল আর্মস্ট্রং; ২০ জুলাই, ১৯৬৯ তারিখে পা রাখেন প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদের মাটিতে। এ যেন ছিল এক অসম্ভব স্বপ্ন। ৪ লক্ষ মানুষের পরিশ্রম যা ছিল কল্পকাহিনীর মত; রূপ নিল বাস্তবে। চাঁদে পা রেখে আর্মস্ট্রং তার সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন “One small step for man, one giant leap for mankind”. আর্মস্ট্রং এর পরে চাঁদের মাটিতে পা রেখে দ্বিতীয় মানব হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান এডুইন অলড্রিন। তারা দুইজন তারপর প্রায় সাড়ে ২১ ঘন্টা চাঁদের মাটিতে ঘুরে বেড়ান এবং গবেষণার জন্য বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করতে থাকেন। অতঃপর ফিরে আসেন কক্ষপথে থাকা কমান্ড মডিউল কলম্বিয়ার কাছে।

লুনার মডিউলে করে কমান্ড মডিউলে ফিরে আসার পর লুনার মডিউলের আর প্রয়োজন ছিল না। তাই চাঁদের কক্ষপথেই লুনার মডিউলকে ফেলে কমান্ড মডিউল রউনা করেন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। চাঁদের কক্ষপথ থেকে পৃথিবীতে যাত্রার উদ্দেশ্যে এই ফায়ারকে বলা হয় ট্রান্স আর্থ ইঞ্জেকশন (Trans Earth Injection)। চাঁদের কক্ষপথ থেকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে আসতে সময় লাগে আড়াই দিন। বায়ুমন্ডল থেকে ২৫ হাজার মাইল প্রতি ঘন্টা বেগে আসতে থাকে অ্যাপোলো স্পেস ক্রাফটের কমান্ড মডিউল ‘কলম্বিয়া’। সবশেষে ২৪ জুলাই, ১৯৬৯ তারিখে প্যারাসুটের মাধ্যমে গতি কমিয়ে প্রসান্ত মহাসাগরে পতিত হওয়ার মাধ্যমে ৮ দিনের সেই ঐতিহাসিক চন্দ্রাভিযানের নিরাপদ সমাপ্তি সম্পন্ন হয়। ৩ হাজার টনের বিশাল রকেট পৃথিবী ছেড়ে যাত্রা করে ফিরে আসে কেবল একটা ছোট্ট প্রাইভেট গাড়ির সমান কমান্ড মডিউল যাতে ছিল ৩ জন হিরো, চাদের পাথরের কিছু স্যাম্পল-ধুলোবালি ও মানব সভ্যতার জন্য এক ঐতিহাসিক বিজয়।
সেদিন ২০ জুলাই, ১৯৬৯ তারিখে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষ আর্মস্ট্রং আর অলড্রিনের চন্দ্রাবতরণ টেলভিশনে সরাসরি দেখেছিলেন। প্রায় প্রতিটা মানুষ ছিল অত্যন্ত শিহরিত ও আনন্দিত। ৫০ বছর আগের সেই সাহসী যাত্রা এখনো মানুষকে প্রেরণা যোগায়। অসম্ভবকে সম্ভব করার যে গল্প অ্যাপোলো-১১ তৈরি করেছিল সেই গল্প এখনো প্রতিনিয়ত বাস্তব করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। অ্যাপোলো-১১ এর পরে অ্যাপোলো-১৭ পর্যন্ত সেই মিশন পরিচালনা করা হয়। অতপর ১৯৭২ সালে সমাপ্তি হয় অ্যাপোলো মিশনের।

অ্যাপোলো-১১ মিশন ও চন্দ্রজয়ের প্রভাব
কিন্তু আসলে এই সমাপ্তি ছিল এক নতুন যাত্রার সূচনা। আজ মানুষ স্পেস্ক্রাফট পাঠিয়েছে প্লুটোতে, মঙ্গলের পৃষ্ঠে ও সূর্যের উদ্দেশ্যে। প্রতিনিয়ত মহাকাশে আমরা নতুন নতুন গ্রহ উপগ্রহের সন্ধান পাচ্ছি যার মধ্যে অনেকগুলো আবার পৃথিবী সদৃশ। এসব গবেষণার মাধ্যমে আমাদের সৌরজগতসহ মহাকাশ সম্পর্কে প্রতিনিয়ত জ্ঞান বাড়ছে। মহাকাশকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারছি।
চাঁদকে ঘিরে নতুন পরিকল্পনা করা হচ্ছে এখন। নাসা পরিকল্পনা করছে ভবিষ্যতে স্পেস এক্সপ্লোরেশনে চাঁদকে বেস হিসেবে ব্যবহার করতে। কারণ চাঁদ থেকে যেকোনো রকেট মহাকাশে পাঠানো তূলনামূলক সহজ। সে লক্ষ্যে তারা চাঁদে আবার স্পেস্ক্রাফট পাঠাবে বলে জানিয়েছে। ট্রাম্প সরকার এ বিষয়ে তাগাদা দিচ্ছে। হয়ত আগামী দশকের মধ্যেই স্পেস এক্সপোলোরেশনের এক নতুন দিগন্তের সুচনা হবে চাঁদকে কেন্দ্র করে।
চন্দ্রবিজয়ের স্বপ্ন এখন কেবল আর আমেরিকা বা রাশিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই স্বপ্ন আকর্ষিত করেছে অন্যান্য দেশগুলোকেও। তার মধ্যে আছে চীন, জাপান, ইসরাইল এমনকি ভারত। এবছরেই শেষের দিকে ভারত চন্দ্রায়ন-২ চাঁদের উদ্দেশ্যে প্রেরণের পরিকল্পনা করছে। এতে থাকবে চাঁদের পৃষ্ঠে গবেষণার জন্য রোভার।

মহাকাশ গবেষণা এখন কেবল আর রাষ্ট্র আর সরকারের মধ্যে আটকে নেই। এটি রূপ নিয়েছে কমার্শিয়াল আকারে। ইলন মাস্কের (Elon Musk) স্পেস এক্স (SpaceX) চাঁদে ভিজিটর নেয়ার পরিকল্পনা করছে এবং তার জন্য টিকিট বিক্রি করছে। তাছারা মঙ্গলে কলোনি পর্যন্ত তৈরি করার পরিকল্পনা করছে স্পেস এক্স কোম্পানি। আর সেই লক্ষ্যে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে রকেট প্রেরনের জন্য প্রচুর গবেষণা চালাচ্ছে স্পেস এক্স।


আশা করি আমরাও আমাদের দেশকে নিয়ে একদিন এই অগ্রযাত্রায় অংশ নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখব। জ্ঞানে বিজ্ঞানে পৃথিবীর অন্য সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলব এবং দেশের আর্থ সামাজিক উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হব। সেই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট আমাদের অর্জনের একটা প্রাথমিক ধাপ ছিল কেবল। আমরা এই অর্জনকে যেন সুদুরপ্রসারি করতে পারি সেটাই এখন আমাদের কাম্য। আর সে স্বপ্ন পূরণের জন্য দেশের সবাইকে কাধে কাধ মিলিয়ে যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে হবে। তবেই একদিন বিশ্বের উন্নত দেশ ও জাতির সাথে আমরা এক কাতারে মাথা উচু করে দাড়াতে পারব।
- তথ্যসূত্রঃ
- https://www.space.com/apollo-11-complete-guide.html
- https://www.nationalgeographic.com/magazine/2019/07/50-years-after-apollo-11-moon-landing-new-age-of-space-travel-is-coming/
- https://www.youtube.com/watch?v=OCjhCL2iqlQ
- https://www.nasa.gov/
- https://time.com/5630299/google-doodle-moon-landing/
- https://www.kennedyspacecenter.com/