শ্বেত বিবর বা হোয়াইট হোল কি ?

আমাদের এ মহাবিশ্ব  অজস্র বিস্ময়ে ভরপুর।  একে জানার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত এই মহাবিশ্বের অনেক কিছুর অস্তিত্বই বাস্তবিকভাবেই আছে। আবার অনেক কিছুর অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত শুধু তাত্ত্বিকভাবেই সীমাবদ্ধ। তেমন একটি বিষয় হল হোয়াইট হোল (White hole) বা শ্বেত বিবর।  আর এ শ্বেত বিবরই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু।

শ্বেত বিবর বা হোয়াইট হোল সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আগে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। যদিও আমরা হোয়াইট হোল শব্দটার সাথে খুব একটা পরিচিত না হলেও ব্ল্যাক হোল শব্দটার সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। তো ব্ল্যাক হোল কি?  ব্ল্যাক হোল হল  মহাবিশ্বের এমন এক বস্তু যার আয়তন অনেক ক্ষুদ্র কিন্তু এর ভর এবং ঘনত্ব অনেক অনেক বেশি। এই মহাকর্ষীয় শক্তি এত বেশি যার কারণে কোনো কিছুই এর ভেতর থেকে বের হতে পারে না । এমনকি আলোও। এ কারণে একে অন্ধকার দেখায়।

এই ব্ল্যাক হোলের উল্টো  ধারণাটিই  হল “হোয়াইট হোল”।  সহজ ভাষায় বলতে গেলে  ব্ল্যাক হোল যেমন নিজের দিকে সবকিছু টেনে নেয়, হোয়াইট হোল তেমনি সবকিছু বাইরে বের করে দেয়। যার জন্য একে উজ্জ্বল ধরা হয়। এর ভেতর কিছু ঢুকতে পারে না।

কিভাবে ধারণা এলো হোয়াইট হোলের???

আমরা জানি ব্ল্যাক হোল সব কিছুকে নিজের দিকে টেনে নেয়। এখন কথা হচ্ছে  যে সব বস্তুকে সে নিজের দিকে টেনে নেয় সেসব বস্তুকে কোনো এক জায়গা দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়।  আর এ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার হয় একটি মাধ্যমের। এই মাধ্যমটিই হল হোয়াইট হোল। এভাবেই জন্ম নেয় হোয়াইট হোলের ধারণা।

কিভাবে সৃষ্টি হয়  হোয়াইট হোল ???

বিজ্ঞানীরা বলেন প্রতিটি ব্ল্যাক হোলেরই একটা শেষ পর্যায় আছে। একটি ব্ল্যাক হোল যখন নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে তখন সে তার ভিতর থাকা বস্তুগুলো বের করে দিতে থাকে। তখনই জন্ম হয় হোয়াইট হোলের।

হোয়াইট হোল সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সূত্রগুলোর একটি সম্ভাব্য সমাধান। এই তথ্যানুসারে যদি মহাবিশ্বে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব থাকে তাহলে হোয়াইট হোলও থাকা উচিত।    ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’র পদার্থবিজ্ঞানী সিন ক্যারল (Sean Carrol)  হোয়াইট হোলকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন: “ব্ল্যাক হোল হলো এমন একটি জায়গা যেখানে কেউ একবার গেলে আর ফিরে আসতে পারবে না; হোয়াইট হোল হলো এমন একটি জায়গা যেখান থেকে কেউ একবার বের হলে আর সেখানে ফিরে যেতে পারেনা।”   ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে ঘটনা দিগন্ত (Event Horizon) দিয়ে কেবল কোনো কিছু প্রবেশ করে কিন্তু হোয়াইট হোলের ক্ষেত্রে ঘটনা দিগন্ত দিয়ে সবকিছু বের হয়ে যায়।  হোয়াইট হোলের মত ব্ল্যাক হোলেরও রয়েছে ভর, চার্জ, কৌণিক ভরবেগ।

বিগ ব্যাং থিওরি ব্যাখ্যা করার জন্যও মানুষ শরণাপন্ন হয়েছে হোয়াইট হোলের কাছে। আমরা জানি একটি বিন্দু থেকে বৃহৎ বিস্ফোরণের মাধ্যমেই জন্ম এ মহাবিশ্বের। বিজ্ঞানীরা মনে করেন বিগ ব্যাঙের সময়  এত বিশাল পরিমাণ শক্তি  এবং পদার্থ  উদয় হওয়ার পেছনে রয়েছে হোয়াইট হোলের অবদান।

এই ব্ল্যাক হোল আর হোয়াইট হোল থেকে আসে ওয়ার্ম হোলের ধারণাও । কিছু কিছু গবেষণা থেকে মনে করা হয় হোয়াইট হোল হল ব্ল্যাক হোলের শেষ প্রান্ত। অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী  লুডউইগ ফ্লেম বলেন যে,  মহাবিশ্বের যে কোনো দুই প্রান্তের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে পারে ব্ল্যাক হোল আর হোয়াইট হোল। যেখানে ব্ল্যাক হোল হলো  “প্রবেশ পথ” আর হোয়াইট হোল “বাহির হওয়ার পথ” হিসাবে কাজ করে।  ব্ল্যাক হোল যে সমস্ত পদার্থ শোষণ করে হোয়াইট হোল দিয়ে সেগুলো অন্য কোথাও বের হয়ে যায়।  এই ব্ল্যাক হোল আর হোয়াইট হোলকে যুক্ত করে যা , সেটি হচ্ছে ওয়ার্মহোল।  বলা যেতে পারে এটি এক প্রকার  সুড়ঙ্গ। পরবর্তীতে এ ধারণা নিয়ে আরো গবেষণা করে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এবং রোজেন একটি থিওরি দাড়া করান যেটি “আইনস্টাইন – রোজেন ব্রিজ” নামে পরিচিত।

আবার আরেকটি মজার বিষয় হল,  ওয়ার্মহোল দিয়ে  কোনো বস্তু প্রবেশ করার পর হোয়াইট হোল ঐ বস্তুর অংশগুলোকে মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিক্ষেপ করবে এমনকি বিভিন্ন সময়েও নিক্ষেপ করতে পারে। যার কারণে  বস্তুটির কিছু অংশ পাওয়া যেতে পারে আবার  কিছু অংশ নাও পাওয়া যেতে পারে। তবে এই সম্পর্কে গাণিতিক প্রমাণ থাকলেও এটি বাস্তবিক নয় বলে ধারণা করেন কলরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী  এন্ড্রু হ্যামিল্টন।

তবে এই হোয়াইট হোলের অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আছে দ্বিধা। এর অস্তিত্ব সম্পর্কে শক্ত কোনো প্রমাণ এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে নেই।  অনেক বিজ্ঞানীই হোয়াইট হোলের অস্তিত্ব মেনে নিতে নারাজ । থার্মোডায়নামিক্সের দ্বিতীয় সূত্রের সাথে বিভিন্ন ভাবে সাংঘর্ষিক হয় হোয়াইট হোল। এ সূত্রের সাহায্যে যেখানে প্রমাণিত হয় মহাবিশ্ব এনট্রপির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে, সেখানে হোয়াইট হোলের অস্তিত্ব অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণ করে এন্ট্রপির পরিমাণ কমছে।

তবে যাই হোক না কেন, বিজ্ঞানীরা হোয়াইট হোল  সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে হয়তো আরো শক্তভাবেই প্রমাণ করা যাবে হোয়াইট  হোলের অস্তিত্ব। তখন হয়ত আমরা  সত্যিই দেখা পাবো  এ হোয়াইট হোলের।

তথ্যসুত্রঃ

10 Mind-Blowing Facts about White Holes

One Comment

  1. বিজ্ঞানের অপার সম্ভাবনা: টাইম ট্রাভেল | বিজ্ঞানবর্তিকা

    […] সবচেয়ে বেশী সমর্থন করে, সেটি হচ্ছে ওয়ার্মহোল। একটা বিষয় সম্বন্ধে আমাদের অবগত থাকা […]

Comments are closed.