AK-47 : পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় অস্ত্র

আপনি যদি বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন  শক্তিশালী অস্ত্রের তালিকা জানতে চান , তাহলে হয়তো অনেক অস্ত্রের নামই আসবে। কিন্তু আপনি যদি জানতে চান এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত  ও জনপ্রিয়  অস্ত্র  কোনটি তাহলে যে নামটার কথা সামনে আসবে তা হল  রাইফেল একে-৪৭  (AK-47) । একটি দেশের সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে অবৈধ সন্ত্রাসী- সবার কাছেই আপনি পাবেন এটি ।

কিন্তু কেন এটি এতো জনপ্রিয়? আর এর ইতিহাসই বা কি? সেসব কথাই আজ  আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।

একে ৪৭ এর স্রষ্টা হলেন  সাবেক সোভিয়েট সেনাবাহিনীর  লে. জেনারেল মিখাইল কালাশনিকভ ( Mikhail Kalashnikov) . পুরো নাম  মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ । ১৯৪১ সালের অক্টোবরে ব্রায়ানস্কে তিনি জার্মান বাহিনীর গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন।    আহত হওয়ায় তিনি ৬ মাস ছুটিতে ছিলেন। সে সময়টাতেই মূলত তিনি  নতুন  ধরনের রাইফেল বানানোর পরিকল্পনা মাথায় আসে।  এটা নিয়ে লেগে থাকেন তিনি। এর পর ১৯৪৭ সালে প্রথম তিনি তার অস্ত্রের ডিজাইন  করেন ।

কেন এর নাম AK-47 ?

এ প্রশ্নের জবাবে উত্তর হল, এখানে A হচ্ছে  রাশিয়ান শব্দ “Avtomat” থেকে যার বাংলা মানে “স্বয়ংক্রিয়”, আর  “K”  হল  এই অস্ত্রের প্রস্তুত কারক “Kalashnikov” (কালাশনিকভ) এর নাম, আর “47” আসে এই অস্ত্রের প্রস্তুত সাল থেকে অর্থাৎ “1947” সাল থেকে । আর  এই সবগুলি মিলে এই অস্ত্রের নামকরণ করা হয় “AK-47“।

১৯৪৭ সালে তৈরি করা হলেও  সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় এটাকে নিয়ে।  তার রাইফেলটি ১৯৪৯ সালে পুরোদমে সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে ব্যাবহার করা শুরু হয় যখন দেখা যায় এটি প্রতি মিনিটে ৬০০ গুলি ছুড়তে সক্ষম হয়।  এর পর থেকেই মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন এটি রপ্তানি করা শুরু করে এবং ব্যাপক হারে এটি ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়।

বিবরণ:

প্রস্তুতকারক দেশঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া)

ভরঃ ৪.৪ কেজি

এমুনিশানঃ  ৭.৬২*৩৯ মি.মি.

মাজল ভেলোসিটিঃ ৭১৫ মিটার/সেকেন্ড

কার্যকরী দূরত্বঃ ৪০০ মিটার/সেমি অটোমেটিক , ৩০০ মিটার/অটোমেটিক

ফায়ারিং রেটঃ ৬০০ রাউন্ড/মিনিট

ম্যাগাজিনঃ ৩০ বা ৪৫ রাউন্ডের বক্স ম্যাগাজিন  অথবা ৭৫ বা ১০০ রাউন্ডের ড্রাম ম্যাগাজিন

কেন AK-47 এত জনপ্রিয়?

AK-47 হচ্ছে  বিশ্বের প্রথম কার্যকর অটোমেটিক রাইফেল। এর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ- সহজ ব্যবহার, নির্ভরতা ও অধিক প্রাণঘাতী। জলে ভিজিয়ে, ধুলায় রেখে, এমনটি এর ওপর দিয়ে রাস্তা মেরামতের রোলার চালালেও এই অস্ত্র আগের মতোই ব্যবহার করা যায়। এটা জ্যাম হয় না খুব সহজে , ওভারহিটেড হয় না, অতি গরম বা অতি শীতল আবহাওয়াতেও ভালভাবে কাজ করে। বছরের পর বছর কোনো যত্ন না নিলেও চলে।  এর পরীক্ষায়  দেখা গেছে, আমেরিকান এম ১৬ প্রতি ৫০০ রাউন্ড ফায়ারে যে জ্যাম হয়, সেই পরিমাণ জ্যাম একে -৪৭ এর হতে ১৩৭৫ রাউন্ড ফায়ার করতে হয়। অন্যান্য অস্ত্র যখন অবিরাম গুলি করতে থাকলে ওভারহিটেড হয়ে নষ্ট হয়ে যাইয়, এক -৪৭ এর বেলায় তেমন টা ঘটে না।  একে ব্যাবহার করার জন্য তেমন কোনো প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন হয় না।  আপনি অস্ত্র চালাতে জানেন না, অস্ত্র নিয়ে কোনো জ্ঞান নেই  এসব কোনো সমস্যাই না। মাত্র  কয়েক ঘণ্টার প্রশিক্ষণেই AK-47 চালানো শিখে ফেলার রেকর্ড রয়েছে।  মূলত একে-৪৭ এর জন্যেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে নাজেহাল হতে হয় মার্কিনবাহিনীর। ব্যবহার সহজ বলে এই অস্ত্রটিই ভালো কাজে দেয় ভিয়েতনামিদের জন্য।

একে-৪৭ এর অন্যতম সুবিধা হল এর মারাত্মক ভেদন করার ক্ষমতা।

এটি ৭.৬২*৩৯ মি.মি. বুলেটকে ৭১৫ মিটার/সেকেন্ডে ছুড়ে যা ৮” কাঠ বা ৫” কনক্রিটের দেয়াল ভেদ করতে পারে।  এছাড়া এতে কাস্টমাইজড বুলেট ব্যবহার করা যায়। এর ফলে এটি হতে পারে আরো মারাত্মক। উদাহরণে ভারতের মুম্বাই হামলার সময় মুম্বাই পুলিসের এন্টি টেররিষ্ট স্কোয়াডের চীফ হেমন্ত কারেকারের উদাহরণ দেয়া যায়। যার বডি আর্মার ভেদ করেছিল একে ৪৭ এর কাষ্টমাইজ বুলেট।  এতে সিঙ্গেল শট, ব্রাশ ফায়ার এবং গ্রেনেড ছুড়ার সুবিধাও আছে। একে -৪৭ এ কখনো ব্যাক ফায়ার হয় না। এ এক অনন্য নির্ভরযোগ্য  অস্ত্র।

তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ভুল ছিলো একে ৪৭ নিয়ে। কালশনিকভের এই অস্ত্রটি তিনি নিজের নামে পেটেন্ট করেননি। ফলে কোনো কপিরাইট না থাকার ফলে  বিভিন্ন দেশ ইচ্ছেমত এর নকল  এবং মোডিফাইড ভার্সন  বের করে।এতে প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় কালশনিকভ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।    ১৯৯১ সালে স্বত্ব সংরক্ষণ করার আইনি লড়াইয়ে তিনি হেরে যান।তবে নকলের মাঝেও অনেক ভালো কোয়ালিটির আছে।

হাঙ্গেরি বের করে AMD 65M, চায়না বের করে TYPE 56, ফিনল্যান্ডের টা হল RK -52. ভারতের ভ্যারিয়েন্ট হল INSAS Rifle, KALANTAK CARBAIN.  কিছু কিছু দেশ বাদে প্রায় সব দেশের সেনাবাহিনীতেই ব্যাবহার করা হয় একে ৪৭ বা এর মোডীফাইড ভার্সন গুলো।  আমেরিকা এবং ইরাকে এর আমেরিকান ভার্সন AKS ব্যবহার করা হয়।  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও ব্যাবহার করা হয় এটি । বাংলাদেশে যে টা ব্যাবহার করা হয় সেটি হল একে-৪৭ এর চাইনিজ সংস্করণ TYPE 56.  এ সংস্করণটির সত্ব কিনে নিয়ে নাম দেয় BD-08.

আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে একে-৪৭ পার করেছে ৬০ বছরেরও বেশি সময়। এই সময়ের মধ্যে এ আগ্নেয়াস্ত্রটি প্রায় ১০০ মিলিয়নেরও বেশি বার উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে এই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশে। বলা হয়, এ যাবত পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ গ্যাস পরিচালিত এই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রটি।

সাম্প্রতিক পৃথিবীতে একে-৪৭ ছাড়া কোনো সামরিক বাহিনী কল্পনা করা অসম্ভব। ধারণা করা হয়, প্যাটেন্ট সংরক্ষিত না থাকায় আবিষ্কারের পর থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারি, বেসরকারি অস্ত্র কারখানাগুলো প্রকাশ্যে, গোপনে একে-৪৭ উৎপাদন করেই যাচ্ছে। ফলে একে-৪৭ হচ্ছে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রাইফেল এবং পৃথিবীতে গুলি খেয়ে মারা যাওয়া মানুষদের মধ্যে সিংহভাগের কপালে একে-৪৭ এর ১৬ দশমিক ৩ গ্রামের কার্টিজই জুটেছে!

একে ৪৭  সন্ত্রসীদের হাতে দেখে দুঃখ পেয়েছিলেন কালাশনিকভ। তিনি বলেছিলেন, ” আমার তৈরি অস্ত্র দিয়ে আমি যখন সন্ত্রাসীদের গুলি চালাতে দেখি এবং তারা যখন অন্যায় ভাবে মানুষ মারে তখন খুব কষ্ট হয় আমার” । একে-৪৭ আবিষ্কারের কারণে ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পদক ‘হিরো অব রাশা’ উপহার পান মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ। ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যান বিশ্বের ভয়ঙ্কর এই মারণাস্ত্রের জনক।

এছাড়াও আপনাদের জন্য একে ৪৭ এবং কালশনিকভ সম্পর্কে আরো কত গুলো তথ্য নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

১. মোজাম্বিকের জাতীয় পতাকায় দেশটির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে কালাশনিকভ রাইফেল।

২। একে-৪৭ রাইফেলটিতে মাত্র আটটি নড়াচড়া করানো সম্ভব এমন অংশ রয়েছে। এই রাইফেলটির অংশগুলো খুলে মাত্র ৩০ সেকেন্ডেই তা আবারও জোড়া লাগানো সম্ভব। অস্ত্রটি বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশেও ব্যবহার করা যায়।

৩। মিখাইল কালাশনিকভ কবি হতে চেয়েছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। রাইফেলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করলেও আজীবন কবিতার সাধনা করেছেন তিনি। ২০০৯ সালে মিখাইল বলেছিলেন, ‘আমি ছাড়াও এখানে আরও খারাপ কবি আছেন। আমি একাই ভিন্ন পথে চলে গেছি।’

৪। নিজের উদ্ভাবন নিয়ে তাঁর যেমন গর্ব ছিল তেমনি কিছুটা আক্ষেপও ছিল। একবার তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ভাবন না করে যদি কৃষকদের কাজে লাগে এমন কোনো যন্ত্র উদ্ভাবন করতাম!

৫। ইয়েমেনে ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়ায় প্রচলিত প্রথা হিসেবে কালাশনিকভের ব্যবহার দেখা যায়। সম্প্রতি ইয়েমেনে এক বিয়েবাড়িতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন বা চালকবিহীন বিমানের হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে একে-৪৭ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে দেশটির একটি সংগঠন।

৬।  ২০০৪ সালে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে এমন ৫০টি পণ্যের তালিকা প্রকাশ করেছিল প্লে বয় ম্যাগাজিন, যেখানে স্থান করে নিয়েছিল একে-৪৭।

৭। একে-৪৭ নিয়ে বিখ্যাত হয়েছে অনেক গান। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন র্যাপ গায়ক লিল ওয়েনের একে-৪৭।

Comments are closed.