রোবট শব্দটার সাথে পরিচিত নেই, এমন মানুষ বোধহয় আজকাল খুঁজে পাওয়া ভার।
তবে সায়েন্স ফিকশন মুভির বদৌলতে অনেকের মাথায় রোবট বলতে আবার মানুষের মত দেখতে রোবটই ঘুরে।
কিছু কিছু দেশ আর অঞ্চলের ছায়াছবিতো আরো এক ধাপ এগিয়ে! এদের ছবিতে রোবটেরা আবার বাচ্চা জন্মও দিতে পারে!
সে যাইহোক, ধুন্ধুমার মারামারির হলিউড আর উরোধুরো নাচানাচির বলিউড নয়, আজ আমরা বাস্তবতায় থেকে বর্তমান সময়ের ছোট, বড় বিভিন্ন আকার এবং বিভিন্ন আকৃতির রোবট নিয়ে আলোচনা করবো। আর আলোচনায় আমি শাহেদ রাইয়ান আছি আপনাদের সাথে। তো চলুন তাহলে সিনেমার ক্লাইম্যাক্স এ ভিলেনকে মারার আগে ডায়লগবাজির মত কিছু না করে মূল কথায় যাওয়া যাক!
প্রথমেই প্রশ্নে আসা যাক, রোবট কি?
হুট করে ভাবতে গেলে কিন্তু ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ারই কথা!
রোবট হল এক বা একাধিক ভিন্ন ভিন্ন কার্যকরী অংশের সমন্বয়ে গঠিত যন্ত্রবিশেষ, যা পূর্বনির্ধারিত কোনো প্রোগ্রাম অনুযায়ী, বিশ্লেষণ অনুযায়ী বা তারবিহীনভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে কার্যসম্পাদনে সক্ষম।
এখানে রোবটের কিছু বৈশিষ্ট্য চলে আসে:
১. বিভিন্ন কার্যকরী অংশের সমন্বয়ে গঠিত যন্ত্র।
২. নিজ থেকে প্রোগ্রাম করা নির্দেশ অনুসরণ করতে সক্ষম
৩. কিছু সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম (ব্যাপারটা AI বা Artificial Intelligence এর)
৪. দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ বা অপারেট হয়ে সক্ষম। এবং…
৫. জটিল কার্য সম্পাদনে সক্ষম। আর এই দিকটাই সাধারণ রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি থেকে একটা রোবটকে আলাদা করে। এদের নির্দেশনা এরচাইতে সামান্য জটিল থেকে শুরু করে বেজায় জটিল হতে পারে৷ যেমন চাকাওয়ালা রোবট গাড়ির মত চললেও এরা বাধাবিপত্তি শনাক্ত করে এড়াতে পারবে, নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে ইত্যাদি।
এছাড়াও রোবটের আরেকটি বৈশিষ্ট্য থাকে অনেকক্ষেত্রে, যা হচ্ছে তথ্য আদানপ্রদান।
সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় রোবট বলতে আমরা যেমন মানবসাদৃশ কিছুকেই বুঝায় শুধু তা না। এদের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার সাপেক্ষে একটা যন্ত্রকে রোবট বলা যায়।
রোবট ব্যাপারটার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়তা বা Automated ব্যাপারটাও একটা মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত।
রোবট শব্দটি এসেছে মূলত চেক (Czech) শব্দ রোবোটা (Robota) থেকে, যার অর্থ হচ্ছে “জোরপূর্বক শ্রম” বা ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করানো। সেইসূত্রে রোবট শব্দটি ১৯২০ সালে Rossumovi Univerzální Roboti নামক একটি মঞ্চ অভিনয়ে প্রথম ব্যবহার করা হয়, যা Karel Čapek নাম চেক লেখকের লেখা ছিল। কিন্তু পরে তার ভাই Josef Čapek ই মূলত শব্দটিকে বিস্তৃত অর্থে ব্যবহার করেন।
রোবটের আদিকথায় উকি দিতে গেলে আমাদের দেখতে হবে ফিরে সেই সুপ্রাচীনকালে! জ্বী হ্যা, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন। অর্থানুযায়ী রোবট বলতে যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রব্যবস্থার কথা বুঝানো হয়, তা নিয়ে মানুষের গবেষণা আর প্রচেষ্টা এই দশ/বিশ বা ত্রিশ বছরের নয়। হাজার হাজার বছরের!
যদি বর্ণনার ব্যাপার বলা হয়, তো বলবো রোবটদের বর্ণনার ব্যাপার সেই আগের পৌরাণিক কথা বা মিথলজিতেও এসেছে। এই ধারণা এসেছে অটোম্যাটন (Automaton) থেকে যার অর্থ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এবং যার বহু বচন অটোম্যাটা (Automata)। গ্রীক পুরাণ দেবতা Hephastias (রোমানদের কাছে Vulcan) এর অটোম্যাটন ভৃত্য নির্মাণের কথা আছে। আবার আমাদের অনেকের পরিচিত নাম, ইহুদি ও নর্স পুরাণের Golem ও কিন্তু অটোম্যাটন।
আবার আর্কিটাস (Archytas) এর যান্ত্রিক ঘুঘু, Mozi আর Lu Ban এর যান্ত্রিক পাখি, Hero of Alexandria’র কথা বলা অটোম্যাটন, Philo of Byzantium এর অটোম্যাটন এই সবই আদিমতম অটোম্যাটার উদাহরণ! আর শুনতে অবাক করা লাগলেও বিভিন্ন দেশ আর অঞ্চলের মিথলজি ঘাটলেও কিন্তু আমরা অনেক অটোম্যাটনের নমুনা দেখতে পাই। অটোম্যাটনের উদাহরণ রেখে গিয়েছেন এমনকি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিও! যুগে যুগে সেই অটোম্যাটার স্বরূপ বদলে, ধীরে ধীরে তা বৈদ্যুতিক যন্ত্রের রূপ নিয়েছে। সেই সাথে কল্পকাহিনীর অটোম্যাট রোবটদের মাঝেও এসেছে বহু বিবর্তন ও উন্নয়ন। মানুষের বরাবরই চেষ্টা রয়েছে কিভাবে এমন সব রোবট বানানো যায় যা মানুষের কাজকে আরো সহজতর করে তোলে। সেই সাথে ঝুঁকিপূর্ণ আর সূক্ষ্ম কাজগুলোয় কিভাবে এগুলোকে ব্যবহার করে আরো সহজে কাজ হাসিল করা যায়। সেই সূত্র ধরে এই ২০১৮ অবধি বহু রোবট তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। গবেষণা চলছে ক্রমাগত। যার ফলস্বরুপ অনেক নিত্যনতুন রোবটের ঝলক আমরা দেখছি। চলুন জেনে নেয়া যাক তেমনি কিছু রোবটের ব্যাপারে।
১. Articulated রোবট
রোবটের কথা উঠলে এদের কথা সর্বপ্রথম চলে আসা উচিত। এইগোত্রের রোবটরা হল মূলত একহাতি। রোবট বলতে আমরা যেমন মানবসাদৃশ কিছু চিন্তা করি তেমন কিছু নয় মোটেও। তারপরেও এদের কথা আগে আসা উচিত কারণ এই গোত্রের রোবটেরা হল Industrial Robot যা অন্যান্য রোবট না শুধু, আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য্য অনেক জিনিষ বানানোর কাজে প্রতিদিন নিয়োজিত থাকে। এরা মূলত Robotic Arm। এরা দুই বা তিন ভাঁজবিশিষ্ট হয়, যা x, y ও z অক্ষে অনায়াসে ঘুরতে পারে। এদের সম্মুখভাগে এদের প্রয়োজন অনুযায়ী যন্ত্র বসানো থাকে। যেমন RIB 1660ID একটি বাণিজ্যিক রোবোটিক আর্ম যা মূলত সূক্ষ্ম ওয়েল্ডিং বা ঝালাই এর কাজে নিয়োজিত থাকে। পাশাপাশি এটা কম্পোনেন্ট ধরে জায়গামত বসাবার কাজ করতেও সক্ষম।
আবার KUKA এর KR Agilus ও একই ধরণের রোবট। তবে এটা আকারে ছোট, চলাফেরা করতে সক্ষম এবং কোনো কিছু ধরতে এবং জায়গামত বসাতে সক্ষম। এমনি আরেকটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট হল SynchroFeed। এটিও মূলত ওয়েল্ডিং রোবটই।
২. Cartesian রোবট/ Gantry রোবট
এরা এতই সহজ সরল গড়নের, যে এদের দেখলে আদতে রোবট বলে মেনে নেয়া যাবেনা। কিন্তু তবুও এরা রোবট। এবং এরাও ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা বাণিজ্যিক রোবটই। বাণিজ্যিকক্ষেত্রে সবচে বেশী ব্যবহৃত রোবটগুলোর আরেকটি হল এই কার্তেসীয় রোবট। এরা মূলত লিনিয়ার অর্ডার দ্বিমাত্রিক প্রেক্ষাপটে কাজ করে। কোনোকিছু পূরণ করা, ম্যাচিং করা, সাজানো, গোছানো, প্রিন্ট করা ইত্যাদি কাজে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যেমন YAMAHA’র XY-X সিরিজের কার্তেসীয় রোবট এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য। এটি বিভিন্ন মেশিনারি কাজ থেকে শুরু করে নানারকম প্যাকেজিংয়ের কাজেও ব্যবহৃত হয়। এ রোবট Arm type, Moving Arm type, Gantry Type, Shaft Upward/Downward type প্রভৃতি সুবিধার হয়ে থাকে।
৩. Spherical রোবট, বা গোলাকার রোবট
এই জনাবরা দেখতে বেশ নাদুসনুদুস হয়। ইয়ে মানে পুরোপুরি গোলাকার তো, তাই আরকি। এদের ক্যাটাগরিতে বহু চমকপ্রদ রোবট রয়েছে। এইসব রোবট মূলত ভেতরে থাকা রিভার্স হুইল এর সাহায্যে চলাফেরা করে। যা একে উল্টোমুখী বল প্রয়োগ করে এগিয়ে নিয়ে যায় যাকে Internal Driving Unite (IDU)।
ROSPHERE তেমনি এক Spherical Robot যার নির্মাতা হল মাদ্রিদ পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয় (Universidad Politecnica de Madrid)। অভ্যন্তরীণ পেন্ডুলাম পদ্ধতির সাহায্যে এই গোলগাল রোবট মহাশয় অনায়াসে উঁচুনিচু, ফসলি জমিতে আগেপিছে আর আশেপাশে চলতে পারে। এবং পাশাপাশি এটি জমির নমুনার তথ্যও সংগ্রহ করতে পারে। এবড়েথেবড়ো জমিতে চলার জন্যে সার্ভিল্যান্স রোবট হিসেবে এটি চমকপ্রদ!
একই সাথে Spherical এবং Hexapod রোবটের দারুণ উদাহরণ হল MorpHex রোবট! ২০০৬ সালে নরওয়েজিয়ান প্রকৌশলী Kare Halvorsen রোবটিক্সের প্রতি স্রেফ নিজের ভালবাসা আর আগ্রহের বশে একাই বানিয়ে ফেলেন এই রোবটটি।
বারোটা সমান সমান ত্রিকোণাকৃতির প্যানেল নিয়ে গঠিত মর্ফেক্স এগুলোর সাহায্যেই বন্ধুর পথে এগিয়ে চলতে পারে। আবার এর ছয়টি প্যানেল সুপ্রসারিত হয় একে অর্ধবৃত্তাকার ষোড়পদীর রুপও দান করে!
Rotundus এর GroundBot হল গোলাকার রোবটের আরো এক চমৎকার উদাহরণ! ফুটখানেক উঁচু এবং মোটামুটি পঁচিশ কেজি ওজনের এই মহাশয়কে দেখলে আপনাদের সাইফাই মুভির কথা মনে পড়ে যাবে। বরফ বলুন, পিচঢালা পথ বলুন বা কাদাভরা পথ বলুন বা এমনকি পানিতে ভেসে থাকা বলুন, গ্রাউন্ডবট সবজায়গাতেই অনায়াসে চলতে সক্ষম।
ওজনে মাঝারি মাপের এই গোলক রোবটটি মূলত Surveillance বা নজরদারির রোবট। আর এরজন্যে এর দুইপাশে কানের মত দুই অংশে রয়েছে দুটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা, যা হাই ডেফিনিশন ছবির পাশাপাশি 360 ডিগ্রী এ্যাঙ্গেল বা ত্রিমাত্রিক ভিউতে ছবি ও ভিডিও নিতে সক্ষম। পাশাপাশি এটি লাইভস্ট্রিম করতেও সক্ষম। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১০কিলোমিটার যা একটা গোলক রোবটের জন্যে বেশ! চটপটে গ্রাউন্ডবটে WiFi ছাড়াও রয়েছে নানারকমের সেন্সর। এর সেন্সরগুলো তাপ (Heat), ধোঁয়া, আর্দ্রতা (Humidity), আর গ্যাস এর ব্যাপারে তথ্য তো দিতে পারেই, এমনকি তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity) আর মাদকের ব্যাপারেও তথ্য দিতে পারে!
৪. চাকাওয়ালা রোবট
চাকাওয়ালা রোবট একচাকা, দুইচাকা, তিন, চার, পাঁচ বা ছয় চাকারও হতে পারে।
জাপানের Murata Electronics কোম্পানির তৈরি Murata Girl একধরণের একচাকার রোবট যা একটি চাকা ও এর দেহের মধ্যস্থ হুইলের মাধ্যমে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে।
ভেতরে থাকা মেকানিজম ওই চাকাটিকে ডানে বায়ে ঘুরাতে সাহায্য করে। আবার Ballbot জাতীয় রোবটও এক চাকার রোবট, কিন্তু এদের চাকা ফ্ল্যাট না হয়ে গোলাকার বা Spherical।
একচাকার রোবটেরা দেখতে অদ্ভুত হলেও ভারসাম্য রক্ষা করে চলার দিক দিয়ে এরা ঝামেলার আর ঝুঁকিপূর্ণ। একটু উনিশ থেকে বিশ হলে এরা হুড়মুড়িয়ে আছড়ে পড়তে পারে।
দুই চাকা বা Double Wheeled রোবটদের মাঝে সবচে বেশি প্রচলিত এখন ভ্যাক্যুম ক্লিনার রোবটগুলো। দুইচাকার রোবটদেরো মূল দেহের উপরে নীচে ভারসাম্য রক্ষা করা নিয়ে ঝামেলা হয় তবে তা একচাকার চাইতে কম।
দুই চাকাওয়ালা রোবটদের মাঝে irobot এর তৈরি Roomba cleaner রোবটটি বেশ জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত। কমান্ড সেট করে দিলে এটি ছোট – বড় বিভিন্নধরণের ময়লা আর টুকরো তুলে নিতে পারে। এটি একাধিক ঘর পরিষ্কার করতে সক্ষম এমনকি কোথায় কতটুকু বল প্রয়োগ করে কাজ করতে হবে সার্ফেস অনুযায়ী এটাও রুমবা বুঝে। এটিকে Google Home এর সাহায্যেও অপারেট করা যায়, অর্থাৎ গুগল এ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করে একে নির্দেশ দেয়া সম্ভব।
দুইচাকার আরো উল্লেখযোগ্য একটি ক্লিনার হল Dyson 360 Eye। এটি হাতে ব্যবহার করা ক্লীনারের মত অত শক্তিশালী না হলেও বেশ ভালই ময়লা পরিষ্কার করতে সক্ষম। সবচে বড় কথা হল একে শিডিউল করে রাখা যায় কাজের সময় নির্ধারণ করে।
দুইচাকার রোবটদের মধ্যে একেবারে ভিন্নরকম দেখতে হল Ghost Rider রোবট। কারণ এর আকৃতি অন্যান্য রোবটের মত নয়, বরঞ্চ মোটরসাইকেলের মত।
তিন চাকা আর দুইচাকার রোবটগুলো হচ্ছে পার্ফেক্টলি ব্যালেন্সিং রোবট! ভরকেন্দ্র অনুযায়ী নিজেদের ভারসাম্য রক্ষা করতে এদের রীতিমত যুদ্ধ করা লাগেনা। এধরণের রোবটগুলোর পেছনের চাকাগুলো হয় আগে বাড়ার জন্যে যা হয় একই মোটর সোর্স দ্বারা চলে বা দুই চাকার জন্যে দুটো আলাদা সোর্স থাকে। আর সামনের একটি বা দুইটি নেভিগেটর বা দিক ঠিক করা চাকার জন্যে থাকে আলাদা আরেকটি বা দুইটি মোটর, যা পুরো যন্ত্রটিকে বিভিন্ন দিকে ঘুরপথেরা করার সামর্থ্য দান করে।
আরেকটি অদ্ভুতদর্শন দুইচাকার রোবট হল Piaggio কোম্পানির Gita রোবট। যা মূলত একটি কার্গো রোবট।
ফুটখানেক উঁচু আকারে মোটামুটি বড়, গোলগাল নীলরঙা এই রোবটের দুইপাশে রয়েছে দুটি চাকা যা তার গোট দেহের আকারের সাথে মিশে যাওয়া। আর এর মাঝের পেটু অংশটা রয়েছে জিনিষপত্র নেয়ার জন্যে। এটি নির্ধারিত দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতে সক্ষম। এর মাথার উপরের দিকে রয়েছে একটি ব্যাটারি স্ট্যাটাস ইনডিকেটর ডিসপ্লে। দুইপাশের চাকাগুলোয় রয়েছে লাল নীল বাহারী LED বাতি, যা দেখে এর উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব।
চাকাওয়ালা বহু রোবটই ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মাঝে গত বছর বের হওয়া Mayfield Robotics এর তৈরি পার্সোনাল রোবট Kuri অন্যতম। গোলুমোলু এই রোবটটি শুধু দেখতে আদুরে নয়, এর ভেতরে থাকা প্রোগামও একে এমনভাবে পরিচালিত করতে সক্ষম যাতে করে এটি মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে।
মাত্র সোয়া ছয় কেজি ওজনের এই রোবটটি মানুষের চেহারার বিভিন্ন অভিব্যক্তি, মাথা নাড়ানোর ধরণ, গলার স্বর ইত্যাদি আলাদাভাবে বুঝতে সক্ষম। সেইসাথে বিভিন্ন শিডিউলের ব্যাপারে জানান দিতে এবং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতেও সক্ষম। পাশাপাশি এটি সরলভাবে বিভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেও সক্ষম। অত্যন্ত শক্তিশালী হার্ডওয়্যার দ্বারা পরিচালিত Kuri’র রয়েছে 1080p ক্যামেরা, ৪টি মাইক্রোফোন, ২টি উচ্চমানের স্পীকার, ব্লুটুথ ও ওয়াইফই ডিভাইসের মত দারুণ সব সুবিধা।
চাকাওয়ালা রোবটদের কথা বলাতে আরেকটি আধুনিক রোবটের কথা না বললেই নয়। সেটি হল Anki এর তৈরি Vector রোবট। মাত্র কয়েক ইঞ্চি লম্বা আর কয়েক ইঞ্চি উঁচু ছোটখাটো এই হোম রোবটটি প্রযুক্তির দারুণ এক উদাহরণ!
এইতো আজকে, মানে ১২ই অক্টোবর থেকেই এর অফিশিয়াল রিলিজ ডেট ধরা হয়েছে। আড়াইশ ডলারের এই রোবটটি খেলন আকার আর আকৃতির দেখতে হলেও এতে রয়েছে দারুণ সব ফিচার!
সামনে ও পেছনে দুটো করে চার চাকার দুই চেইনে চলা ভেক্টরের রয়েছে দেখার জন্যে শক্তিশালী ক্যামেরা, শোনার জন্যে শক্তিশালী মাইক্রোফোন আর মানুষের সাথে কথা বলার জন্যে রয়েছে উচ্চপর্যায়ের স্পীকার, যার সাহায্যে এটি শত শত রকমের ভিন্ন ভিন্ন শব্দ করতে সক্ষম। ও হ্যা, এর সামনের ডিসপ্লেটি এর চেহারার মত কাজ করে। যাতে ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি আর সেই সাথে কথা মিলিয়ে মনে হবে ভেক্টর বুঝি জ্যান্ত কিছু! আরো অবাক করা ব্যাপার হল এর মধ্যে টাচ সেন্সর রয়েছে, ফলে পোষা প্রাণীকে আদর করলে যেমন সে বুঝতে পারে ভেক্টরের বেলায়ও তেমন কিছু প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাঝে রয়েছে শক্তিশালী প্রসেসর, যার সাহায্যে ইন্টারনেটের সাথে এটি যুক্ত হয়ে চিন্তা করতে সক্ষম কিছুতে রূপান্তরিত হতে পারে!
এছাড়াও এটির মধ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া করার প্রোগ্রাম। এবং এটি নিজের চার্জ নিজেও করে নিতে পারে চার্জার কোথাও রাখা থাকলে!
৫. ক্ষুদে রোবট
ক্ষুদে রোবটরা হল মাত্র কয়েক মিলিমিটার থেকে শুরু করে কয়েক সেন্টিমিটার আকারের রোবট। এদের বেসিক কিছু কার্যসম্পাদন করার জন্যে তৈরি করা হয়, যা ভবিষ্যতে সামরিক, চিকিৎসা প্রভৃতি খাতে বেশ কাজে লাগতে পারে বলে প্রযুক্তিবিদরা আশাবাদী।
Defense Advanced Research Projects Agency (DARPA) তাদের ক্ষুদে রোবট তৈরির প্রোগ্রাম Short-Range Independent Microrobotic Platforms (SHRIMP) এ এমন সব ক্ষুদে রোবটই তৈরি করার প্রচেষ্টায় রয়েছে যেগুলো মাত্র কয়েক মিলিমিটার বা সেন্টিমিটার বড় হবে এবং এগুলো অনায়াসে সেইসব জায়গায় পৌছাতে পারবে ও তথ্য আনতে পারবে যেখানে মানুষের যাওয়া সম্ভব নয়!
MIT’র গবেষকদের দ্বারা তৈরি আরেক অদ্ভুত ক্ষুদে রোবট হল Primer ! এটি একটি সেন্টিমিটার আকারের ক্ষুদে অরিগ্যামি রোবট যা নিজেকে ভাঁজ করতে সক্ষম চলাফেরা করতে সক্ষম, গুটিয়ে ও ছড়িয়ে ফেলতে সক্ষম, এমনকি এটি পাল তুলে আগে বাড়তেও সক্ষম! পুরো কাজটি এটি বাইরের প্লাস্টিক আবরণ ব্যবহার করে করতে সক্ষম। ভবিষ্যতে অনুসন্ধানকার্য ও চিকিৎসাক্ষেত্রেও এটি দারুণভাবে ব্যবহার করা যাবে বলে আশাবাদী গবেষকরা।
৬. জন্তসাদৃশ রোবট!
জন্তুসাদৃশ রোবটের কথা বলতে বা ভাবতে গেলে একবাক্যে আমাদের যে কোম্পানিটির নাম বলতে হবে সেটি হল Boston Dynamics। রোবটের বেলায় নৈপুণ্যের কথা আসলে প্রথমেই এদের নাম বলতেই হয়। এদের চার পাওয়ালা (Quadrupedal) রোবট প্রজেক্টের অন্যতম উল্লেখযোগ্য রোবট হল Cheetah সিরিজ এর রোবট। বোস্টন ডায়নামিক্স দীর্ঘদিন যাবত এই সিরিজের রোবট নিয়ে কাজ করে আসছে।
সময়ের ধারাবাহিকতায় তারা Cheetah রোবটে এনেছে নানান রকমফের ও আপগ্রেড। ভারসাম্য রক্ষা থেকে শুরু করে, ওজন, গতি ইত্যাদির উপর নজর দিয়ে তারা Cheetah কে আরো উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়াসে রয়েছে।
জন্তুসাদৃশ রোবটের একটি দারুণ উদাহরণ হল Sony’র Aibo রোবট। এটিও সময়ের ধারায় ক্রমে উন্নত হয়েছে। এটি মূলত কুকুরসাদৃশ ছোট্ট একটা রোবট, যা বিভিন্নভাবে তার মালিকের সাথে যোগাযোগ করতে পারে চার পা ভিন্ন ভিন্নভাবে নড়াচড়া করতে পারে, কথা বলতে, ভাব প্রকাশ করতে এমনকি নিজের একটা আলাদা ব্যক্তিত্বও গড়ে তুলতে পারে! বোস্টন ডায়নামিক্স এর আরেক অভূতপূর্ব রোবট হল Spot Mini । চারপেয়ে এই রোবট চিতাহর চাইতে পাতলা, এবং বেশ শক্তিশালী। পাশাপাশি এর সম্মুখভাগে সব এঙ্গেলে ঘোরার মত একটি দুইভাজের বাহুও রয়েছে!
এছাড়াও জন্তুসাদৃশ রোবটের মাঝে WildCat, Big Dog এগুলোও উল্লেখযোগ্য।
৭. মানবাকৃতির রোবট (Humanoid) ও অন্যান্য
রোবট বলতেই বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু এইধরনের রোবটের কথা আগে ভাবে। হিউম্যানয়েড রোবট হল সেইসব রোবট যা আকৃতিতে মানুষের মত। পুরোপুরি মানুষের মত না হলেও এদের দুটি পা, মানুষের হাতের মত দুটি বাহু, মুল দেহ ও মাথার জায়গায় মাথার মত আকৃতি থাকে।
Humanoid এর কথা বলতে গেলে সর্বপ্রথম আমাদের যে রোবটটির নাম বলতে হয়, সেটি হল Honda কোম্পানির Asimo রোবট।
দূর থেকে পরিচালনা করতে পারা এই রোবট পা ফেলে হাঁটাচলা করতে, হাল্কা লাফাতে, উঠতে, বসতে, হাত দিয়ে কিছু ধরতে ও আঙুলগুলো আলাদাভাবে নাড়াতে ও বাহু নাড়াতে সক্ষম। এছাড়া এটি শব্দ করতে সক্ষম। চেহারার জায়গায় রয়েছে এর কালো প্যানেল। এটি হাল্কাপাতলা খেলাধুলা করতেও সক্ষম।
তবে হাঁটাচলায় সবচে সুনিপুণ Humanoid এর কথা বলতে গেলেও আবারো সেই Boston Dynamics এর নামই সবার আগে চলে আসে। গুগল অধিকৃত এই রোবটিক্স বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে কিভাবে আরো ভালমনের Humanoid বানানো যায়। তাদের এই ধরণের রোবট সিরিজের পরিচিত নাম হল Atlas।
তারা সময় সময়ে Cheetah র মত অ্যাটলাসেও এনেছে অনেক পরিবর্তন ও উন্নয়ন। বর্তমানের ৬ফিট উঁচু এটলাস রোবট দুর্গম অঞ্চলে মানুষের মত হাঁটাচলা করতে সক্ষম, দ্রুত চলতে সক্ষম, পড়ে গেলে নিজে নিজে উঠতে সক্ষম, ধাক্কা লাগলে মানুষের মত সামলে নিতে সক্ষম এমনকি আর দশটা সাধারণ মানুষের চাইতে ভালভাবে ডিগবাজী খেতেও সক্ষম। Atlas এর চেহারা আর মানুষের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারে তেমন কোনো উন্নতি সাধন করা হয়নি, তবে এটিকে ভবিষ্যতে ভালমনের উদ্ধারকারী রোবট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বোস্টন ডাইনামিকস প্রতিনিয়তই এ্যাটলাসকে আরো উন্নত, আরো কর্মক্ষম ও ফিটফাট করার কাজ করে চলেছে।
আরেকটি দুর্দান্ত Humanoid হল Honda কোম্পানির E2 – DR। ৬ ফিট উঁচু আর ৮৫ কেজি ওজনের এই রোবটটিও মূলত একটি উদ্ধারকারী রোবট। এটি বিভিন্ন প্রতিকূল জায়গায় পাঠানো সম্ভব, অতিরিক্ত উত্তাপ ও ঝক্কিঝামেলা সহ্য করতে সক্ষম এবং শরীরকে বিভিন্নভাবে ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে এমনকি চারপেয়ে অবস্থায় পরিবর্তিত হয়েও এগিয়ে যেতে সক্ষম।
আকারের দিক থেকে হিউম্যানোয়েড রোবট ছাড়াও দেখতে মানুষের মত এবং মানুষের মত অভিব্যক্তি দিতে পারে এমন হিউম্যানোয়েডও তৈরি করা হয়েছে এবং ক্রমাগত উন্নত করার চেষ্টা চলছেই।
এরমধ্যে Asuna আর Erica উল্লেখযোগ্য, যার দুটোই নারীর আদলে তৈরি।
আবার জাপানের Kokoro রোবটিক ফার্ম এর Geminoid সিরিজের Geminoid DK রোবটটি হুবহু তার নির্মাতা Henrik Scharfe এর আদলে বানানো হয়েছে, হুট করে যাকে দেখলে আসলে হেনরিক নাকি হিউম্যানয়েড তা বোঝা দায়।
তবে এগুলোর চাইতেও বেশি অভিব্যক্তি (Expression) দিতে সক্ষম হল রোবট Sophia যার ফেসিয়াল মেকানিজমকে ৫০টিরো অধিক আলাদা আলাদা এক্সপ্রেশন দেয়ার মত করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তা স্বত্বেও Hanson Robotics এর তৈরি রোবট সোফিয়া বিশেষজ্ঞদের মতে ভাওতাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। কেননা একে এর নির্মাতা হ্যানসন AI বা Artificial Intelligence চালিত বললেও আদতে এটি ম্যাসেঞ্জার চ্যাটবোটের হার্ডওয়্যার সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এমনকি CNBC সহ অন্যান্য বেশ কিছু জায়গায় সোফিয়াকে উপস্থাপনের পূর্বে উপস্থাপকদের কাছে আগে থেকে বানিয়ে দেয়া স্ক্রিপ্টও পাঠানো হয়েছিল এই মর্মে যে তাকে যেন সেখান থেকেই প্রশ্ন করা হয়। অতএব আমরা সোফিয়াকে আমাদের গোনার হিসেব থেকে বাদই রাখি!
আর চেহারার অভিব্যক্তির দিক দিয়ে সবচে এগিয়ে যে রোবটটি, সেটি হল ওয়াল্ট ডিজনির ব্যক্তিগত সম্পত্তি,ডিজনিল্যান্ড এর এভাটার রোবট শামান! যার Expression আর হাতের নড়াচড়া দেখলে আপনার মানতে ইচ্ছে করবে না যে এটা রোবট!
এছাড়াও আরো বহুধরণের রোবট রয়েছে এবং ক্রমাগত তৈরি আর উন্নত হয়েই চলেছে। আর কোনোটা কুকুর বা বিড়ালের আকৃতির, কোনোটা মানুষ, তো কোনোটা আবার মাছ বা সাপের আকৃতির। যেমন Sofi নামক মৎস রোবট, যাকে হুট করে দেখলে মাছই মনে হবে!
প্রযুক্তির সাথে সাথে রোবট এবং এতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার সিস্টেম ক্রমে উন্নতই হয়ে চলেছে। প্রয়োগ করা হচ্ছে এসবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)। তবে এই AI প্রয়োগ করতে গিয়ে ভবিষ্যতে যেন খোদ নিজেদের হাতেই নিজেদের মানবজাতী চিন্তা করতে পারা রোবট আর প্রোগ্রামদের হাতে হুমকির মুখে না পড়ে সেটাও আমাদের খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী৷ শত হোক, স্বতন্ত্র, কর্মক্ষম একটা জাতী চাইবে না তাদের আমরা নিয়ন্ত্রণ করি!
আজ রোবট নিয়ে আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ করছি৷ পরবর্তীতে হয়তো আবারো আসবো নতুন কোনো বিষয় নিয়ে। ততক্ষণে সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন, নিজের খেয়াল রাখুন, আর বিজ্ঞানবর্তিকার সাথেই থাকুন।