চোখ দেখেই বলা যাবে আলঝেইমার্স আছে কী নেই!

কমপ্লুটেন্স ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রিদ (Complutense University of Madrid) এর বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি কিছু উন্নতি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অ্যালঝেইমার ও রেটিনার নানা পরিবর্তনের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, রেটিনার বিভিন্ন স্তরের পরিবর্তন যেমন এর পুরুত্ব বৃদ্ধি অথবা হ্রাস পাওয়ার ব্যাপারটি অ্যালঝেইমার রোগের সাথে সম্পর্কিত। দুর্বল (mild) অ্যালঝেইমার রোগে আক্রান্ত রোগীদের রেটিনার বিভিন্ন স্তরের পরিবর্তনের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা চালিয়ে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেন নন-ইনভেসিভ ইমেজিং প্রযুক্তি। ফলাফলে তারা দেখান যে রেটিনার কিছু স্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি ও হ্রাস, উভয় ব্যাপারই স্নায়ুভ্রংশ এবং প্রদাহজনিত সমস্যাকে ইংগিত করতে পারে। এর ফলে কোনো স্নায়ুভ্রংশজনিত ব্যাধির উপসর্গ প্রকাশের আগেই একে নির্ণয় করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অ্যালঝেইমার হচ্ছে একটি দীর্ঘমেয়াদি স্নায়ুক্ষয়জনিত রোগ। এটি খুবই ধীর গতিতে শুরু হয়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আরও অবনতির দিকে ধাবিত হয়। প্রায় ষাট থেকে সত্তর শতাংশ ক্ষেত্রে এটি স্মৃতিভ্রংশের মত অবস্থায় গিয়ে পরিণত হয়।

তাদের ফলাফলের মাধ্যমে তারা কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে:

১। রেটিনার সাথে মস্তিষ্কের একটি সমান্তরাল সম্পর্ক রয়েছে

২। নন-ইনভেসিভ অর্থাৎ অস্ত্রোপচার বিবর্জিত ইমেজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে রেটিনার স্তরসমূহের ছবি সংগ্রহের সুযোগ;

এই দুইটি তথ্যের সংমিশ্রণে রেটিনার অবস্থার ভিত্তিতে অ্যালঝাইমার রোগের সম্ভাব্যতা নির্ণয় করা সম্ভব বলে তারা ধারণা করছেন। এক্ষেত্রে রেটিনা একটি সুযোগ্য জৈব মার্কার হিসেবে কাজ করবে।

কমপ্লুটেন্স ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রিদ –এর অন্তর্গত রামোন ক্যাস্ট্রোভিয়েহো চক্ষুবিজ্ঞান গবেষণা ইন্সটিটিউট (Ramon Castroviejo Ophthalmology Research Institute) –এর বিজ্ঞানী ও এই গবেষণার একজন গবেষক  এলেনা সালোব্রার গার্সিয়া (Elena Salobrar-García, PhD) বলেন, “যুগান্তকারী পরীক্ষাগুলোতে চোখকে মস্তিষ্কের জানালা হিসেবে ব্যবহার করে এর মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তন লক্ষ্য করে অ্যালঝাইমার রোগের প্রাথমিক পর্যায় এবং এর অগ্রগতি নির্ণয়ে কাজে লাগানো হয়েছে।” তাদের এই গবেষণা কর্মটি সায়েন্টিফিক রিপোর্টস (Scientific Reports) –এ প্রকাশিত হয়েছে।

এ ব্যাপারে লুই হানেজ (Luis Jáñez), ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট (Knowledge Technology Institute) –এর একজন বিজ্ঞানী, আরও বলেন, “আমাদের এ ফলাফলের মাহাত্ম্য হচ্ছে যে, আমাদের রোগীদের থেকে সংগৃহীত নমুনায় রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে পুরুত্ব হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা এর বৃদ্ধি পাওয়ার থেকে বেশি প্রাধান্য বিস্তার করে, এবং এক্ষেত্রে তা পাতলা তলের পরিমাণ ও হ্রাসপ্রাপ্ত স্নায়বিক আয়তন থেকেই তা বোঝা যায়”। তিনি এ গবেষণার প্রধান গবেষক। তাদের গবেষণার শিরোনাম ছিল :

‘Spatial analysis of thickness changes in ten retinal layers of Alzheimer’s disease patients based on optical coherence tomography’

মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাদ্রিদ ভিত্তিক এই গবেষণা প্রকাশের কিছুদিন আগেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-র গবেষকরা একটি ফলাফল প্রকাশ করেন তাদের কাজের। সেখানে তারা দেখিয়েছেন যে, নানা বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষার সময় চোখের মণির যে প্রসারণ ঘটে তাকে আরও কম খরচে অ্যালঝেইমার রোগের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে; এবং তা করা যেতে পারে বুদ্ধিবৃত্তি হ্রাস বা লোপ পাওয়ার পূর্বেই।

সালোব্রার গার্সিয়া এবং তার সহকর্মীরা ব্যাখ্যা করেন যে, আলঝেইমার্স রোগের মত আরও নানা মস্তিষ্ক সংক্রান্ত রোগের ক্ষেত্রে রেটিনা একটি চমৎকার জৈব মার্কার হিসেবে কাজ করতে পারে। যেহেতু রেটিনার অনেক বৈশিষ্ট্যে মস্তিষ্কের সাথে মল রয়েছে সেহেতু এটি মস্তিষ্কের নানা অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্যে একটি উৎকৃষ্ট সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাঁরা বলেন, “আলঝেইমার্স রোগে প্রধানত মস্তিষ্কের টিস্যুগুলোই আক্রান্ত হয়। এক্ষেত্রে কোনো প্রকার অস্ত্রোপচার ছাড়া রোগের অবস্থা বিশ্লেষণের জন্য রেটিনাকে ব্যবহার করে এর নিউরোনাল টিস্যুগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। ক্রমান্বয়ে প্রাপ্ত প্রমাণাদি এটাই ইঙ্গিত করে যে রেটিনাল অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে মস্তিষ্কের রোগতত্ত্বে আরও পরিজ্ঞান লাভ সম্ভব।” অ্যালঝেইমার্স রোগের একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় রেটিনার পরিবর্তন সংক্রান্ত এ গবেষণা বলে যে এ রোগে মস্তিষ্কের গঠন রেটিনার পুরুত্ব ও দৃষ্টিশক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই গবেষণার ফলাফল থেকে সহজেই স্পষ্ট হয় যে, আলঝেইমার্স সংশ্লিষ্ট নিউরোনাল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং আনুষঙ্গিক পরিবর্তন মস্তিষ্কে সংঘটনের পূর্বে রেটিনাতে সংঘটিত হতে পারে। ফলে রেটিনাল অ্যানালাইসিসের দ্বারা কোনো উপসর্গ দেখা দেওয়ার পূর্বেই এবং পূর্ব-ক্লিনিকাল অবস্থার সময়েই আলঝেইমার্স রোগ নির্ণয় করা সহজ হবে।

চিত্রঃ রেটিনা ও তার বিভিন্ন স্তর

তাদের এই গবেষণার জন্য দলটি অপটিক্যাল কোহেরেন্স টোমোগ্রাফি (optical coherence tomography –  OCT) –র উচ্চতর পদ্ধতির সাথে বিশেষায়িত সফটওয়্যারের সমন্বয় সাধন করেন। এই জটিল কাজের উদ্দেশ্য হল রেটিনার ভিন্ন ভিন্ন ১০টি স্তরের মানচিত্র সূক্ষ্মভাবে তৈরি সম্ভবপর করা এবং এই স্তরসমূহের পুরুত্বের মধ্যে পারস্পরিক তুলনা করা। OCT প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি অংশগ্রহণকারীর রেটনার ৬*৬ বর্গ মিলিমিটার ক্ষেত্রের বর্গাকার অংশের একটি ত্রিমাত্রিক ছবি পাওয়া গেছে। সালোব্রার গার্সিয়ার মতানুযায়ী এই OCT প্রযুক্তির দ্বারা রেটিনার উক্ত ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট অংশটি প্রায় ২.৫ সেকেন্ডে একটি আলোর বিম দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব। বিনা অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত এই প্রযুক্তিটি একই সাথে দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং কম খরচেরও বটে।

গবেষণার নমুনা হিসেবে তাঁরা মাদ্রিদের সান কার্লোস হাসপাতাল (San Carlos Hospital Clinic Geriatric Service) –এর ২১২৪ জন রোগীর মধ্য থেকে ১৯ জন মৃদু আলঝেইমার্স আক্রান্ত রোগীকে বাছাই করেন। নিয়ন্ত্রণ বা কন্ট্রোল হিসেবে, অর্থাৎ বয়সের সাথে পারস্পরিক নানা বৈশিষ্ট্যের সাথে তুলনা করার জন্য আদর্শ (age-matched control) হিসেবে তাঁরা ২৪ জন স্বেচ্ছাসেবককেও এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করেন। রেটিনার যে দশটি স্তর  তাঁরা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেন, তার তালিকা নিম্নরূপ:

১। স্নায়ুতন্তু স্তর (nerve fiber layer – NFL)

২। গ্যাংগলিয়ন কোষস্তর (ganglion cell layer – GCL)

৩। অন্তঃস্থ প্লেক্সিফর্ম স্তর (inner plexiform layer – IPL)

৪। অন্তঃস্থ নিউক্লিয়ার স্তর (inner nuclear layer – INL)

৫। বহিঃস্থ প্লেক্সিফর্ম স্তর (outer plexiform layer – OPL)

৬। বহিঃস্থ নিউক্লিয়ার স্তর (outer nuclear layer – ONL)

৭। অন্তঃস্থাংশ/বহিঃস্থাংশ স্তর (inner segments/outer segments layer – IS/OS)

৮। রেটিনাল রঞ্জক আবরণী স্তর (retinal pigment epithelium layer – RPE)

৯। বহিঃস্থ স্তর (outer segment layer – OSL)

১০। বহিঃস্থ PR/RPE স্তর (outer segment PR/RPE complex – OPR)

চিত্রঃ রেটিনার বিভিন্ন স্তরের লম্বচ্ছেদ

সাম্প্রতিক দশকে যেখানে ওসিটি প্রযুক্তির নানা উন্নতি আমাদের চোখে পড়ছে, সেখানে উপরের গবেষণায় উক্ত প্রযুক্তিরই আরও এক ধাপ অগ্রবর্তী ব্যবহার আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রচলিত বাণিজ্যিক পদ্ধতিটি কেবলমাত্র রেটিনার স্তরের পূর্বনির্ধারিত জ্যামিতিক ক্ষেত্র ব্যবহার করে একটি গড় পুরুত্ব প্রদান করত। কিন্তু নতুন প্রযুক্তি দ্বারা ৬*৬ বর্গ মিলিমিটার পিক্সেলের বিশ্লেষণ সম্ভবপর হয়েছে। একই সাথে এটি গড়পড়তা হিসেব থেকেও মুক্তি দিচ্ছে যা চিকিৎসাগতভাবে সম্পর্কিত নানা পার্থক্যকে ম্লান করে দিতে পারত। রেটিনার স্তরসমূহের এমন স্থানিক অনবরুদ্ধ (spatially unconstrained) বিশ্লেষণের ফলে আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত নির্দিষ্ট স্তরটিকে খুব সহজেই তাঁরা চিহ্নিত করতে পারছেন।

চিত্রঃ গবেষণায় অংশগ্রহণকারী একজন রোগীর রেটিনার বিভিন্ন স্তর

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রেটিনার স্তরগুলোকে আলাদা করা হয়েছে (segmented)। একই সাথে প্রতিটি স্ক্যানিং পয়েন্টে এদের পুরুত্বও পরিমাপ করা হয়েছে এবং ঢালু ও আঁকাবাঁকা জনিত ত্রুটিরও সমাধান করা হয়েছে। তাঁদের মতে এটিই প্রথম গবেষণা যেখানে স্থানিক বক্রতার সংশোধন করা হয়েছে। গবেষকদল তাঁদের এই কাজের জন্য একটি বিশেষ সফটওয়ারও তৈরি করেছেন। এই সফটওয়্যারটিতে তাঁরা প্রতিটি রেটিনাল স্তরের ২,৬২,১৪৪ টি পয়েন্টকে ৫১২ টি কলাম ও অসংখ্য সারির গ্রিডে সাজিয়ে বিশাল পরিমাণ ডাটা বিশ্লেষণ করেন। এই বিশ্লেষণকৃত ডাটা থেকে তাঁরা পরিমাপের কাজটিও করেন। এই দলের একজন গবেষক হানেজ (Jáñez) বলেন, “গাইউসিয়ান যাদৃচ্ছিক ক্ষেত্রতত্ত্ব (Gaussian random field theory,) নির্ভর পরিসংখ্যানসংক্রান্ত কৌশল ব্যবহার করে আমরা প্রথমবারের মত আক্রান্ত প্রতিটি রেটিনাল স্তরের একদম সঠিক আকার, আকৃতি এবং অবস্থান নির্ণয় করেছি।” তাঁরা আরও বলেন যে, সকল ডাটা বিশ্লেষণের পূর্বে তাঁরা পৃথক পৃথকভাবে গৃহীত তথ্যের এবং একই সাথে OCT প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্য গ্রহণের সময় নড়নজনিত কারণে সৃষ্ট যান্ত্রিক ত্রুটির স্থানিক মান নির্ধারণ ও এর সংশোধন করে নেন।

চিত্রঃ ফোভিয়ার কেন্দ্রে অন্তঃস্থ নিউক্লিয়ার স্তর

ফলাফলে দেখা যায় যে, ১০ টি স্তরই তাদের নির্দিষ্ট পুরুত্বের অনুপাতে আলঝেইমার্স সংক্রান্ত ক্ষীণত্ব প্রদর্শন করে। NFL, GCL, IPL, INL, OSL সহ সমগ্র রেটিনার নানা জায়গায় ক্ষীণত্ব পরিসংখ্যানগত গুরুত্ব অর্জন করছে। শুধুমাত্র INL এবং OS অংশটিই একইসাথে উভয়প্রকার পরিবর্তন, অর্থাৎ পুরুত্ব বৃদ্ধি ও হ্রাস, তাদের বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করে। র‍্যামোন ক্যাস্ট্রোভিয়েহো ইন্সটিটিউট (Ramon Castroviejo Institute) –এর পরিচালক হোসে ম্যানুয়েল রামিরেজ (José Manuel Ramírez) বলেন, “ম্যাকুলার অঞ্চল, যেটি রেটিনার সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থান এবং একইসাথে কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ও রঙ উপলব্ধির ব্যাপারকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানেই সর্বপ্রথম পরিবর্তনটি দেখা যায়। ”

গবেষকদের মতে তাঁদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল আলঝেইমার্স রোগ নির্ণয়ে ও এর পরবর্তী প্রভাব উদ্ঘাটনে এবং রেটিনাকে একটি উৎকৃষ্ট জৈব মার্কার হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে এক যুগান্তকারী ব্যাপারকে সামনে নিয়ে এসেছে। তাঁরা আরও মত পোষণ করে যে তাঁদের প্রাপ্ত ফলাফল মানুষের চোখের টিস্যুরোগতত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; যার মাধ্যমে রেটিনার পুরুত্বের পর্যবেক্ষণের দ্বারা আলঝেইমার্স রোগের কারণে রেটিনায় সৃষ্ট প্রভাবের ফলে সৃষ্ট স্নায়বিক ক্ষয় এবং প্রদাহজনিত সমস্যা নির্ণয় সহজ হবে।

তথ্যসূত্র: genengnews

Comments are closed.