পৃথিবীর বায়ুমন্ডল সৃষ্টির পর থেকেই আমাদের চিরচেনা নীল আকাশ স্পষ্ট হতে থাকে। পৃথিবীকে ঘিরে বায়ুমন্ডলের স্তরটির জন্যই মূলত আকাশ নীল দেখায়। আর এই সুবিশাল আকাশের মাঝে ভেসে বেড়াতে থাকে বিভিন্ন ধরণের মেঘদল। আকাশের পানে তাকালেই মনে হবে কেউ যেন রঙ তুলি দিয়ে পুরো আকাশটাকে সাজিয়ে দিয়েছে। মেঘগুলো ভাসতে ভাসতে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, মাঝে মধ্যে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশেও চলে যায়। মেঘগুলো জায়গা ভেদে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে। কিছু মেঘ দেখতে তুলোর মতো, কিছু দেখতে সমান্তরাল রাস্তার মতো, আবার কিছু মেঘ দানব আকৃতির ন্যায় সোজা উপরের দিকে সরে গিয়েছে। তাহলে আসুন আজ মেঘের বিভিন্ন প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনে করি।
মেঘের সৃষ্টি?
মেঘ মূলত জলীয়বাষ্প থেকে সৃষ্ট। যখন মাটি কিংবা বিশাল সমুদ্র থেকে জলরাশি উচ্চ তাপমাত্রার জন্য বষ্পীভূত হয়ে উপরের দিকে উঠে যায় তখন তা নিম্ন তাপমাত্রায় আসতে আসতে ঘনীভূত হতে থাকে। যার ফলে সম্পূর্ণ জলরাশি বরফে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। ঘনীভূত অবস্থায় এই জলীয়বাষ্পগুলো মেঘের সৃষ্টি করে এবং বাতাসের দিকের উপর নির্ভর করে চলাচল করতে থাকে।

আমরা সকলেই পানি চক্র সম্পর্কে জানি। পানি চক্রে প্রধান চারটি ধাপ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে;
১। বাষ্পীভবন,
২। ঘনীভবন,
৩। বৃষ্টিপাত,
৪। পানি প্রবাহ,
এই চারটি ধাপের উপর নির্ভর করে স্বাদু পানির উৎসের সৃষ্টি হয়। আর এর মাঝে ২য় ধাপে ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় মেঘের সৃষ্টি হয়।
বাতাসের স্থিতিশীলতার উপর মেঘের আকার আকৃতি নির্ভর করে। বাতাস স্থিতিশীল হলে মেঘগুলো সমান্তরালভাবে চেপে থাকবে। বাতাস অস্থিতিশীল হলে মেঘগুলো সংঘর্ষের ফলে ফুলে উঠবে (ফুলকপির মতো)।

মেঘের প্রকারভেদ
মেঘের প্রকারভেদ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন,
- বাতাসের সঞ্চালনের দিক
- বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ
- বাতাসের স্থিতিশীলতা
মেঘকে মূলত তার গঠন এবং উচ্চতার উপর ভিত্তি করে ভাগ করা হয়। আবার তাদের মধ্যেও বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন গঠনের উপর নির্ভর করে মেঘকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়,
১। সাইরাস
২। স্ট্রেটাস
৩। কিউমুলাস
আবার উচ্চতার উপর নির্ভর করে মেঘকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়,
১। সাইরো
২। অল্টো
৩। নিম্বো

১। সাইরাস – এই ধরণের মেঘগুলো মূলত সরু এবং কিছুটা কোঁকড়ানো হয়ে থাকে। এই মেঘগুলোর আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন, এই মেঘগুলির শেষ প্রান্ত সবসময় সরু থাকে। তাদের আকার-আকৃতি সবসময় লক্ষ্য করা যায়। এই মেঘগুলো সম্পূর্ণ ছোট ছোট বরফ খন্ড দ্বারা তৈরি। এই সকল মেঘগুলো সাধারণত ২০,০০০ ফিটের উপরে অবস্থান করে থাকে। এদের মাঝে একধরণের ঢেউ খেলানো ভাব বিরাজমান থাকেই। অনেক সময় এদের দেখতে কোঁকড়ানো চুলের মতো মনে হতে পারে।

২। স্ট্রেটাস – এই ধরণের মেঘগুলো মূলত সমান্তরালভাবে পুরো আকাশ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। এই মেঘগুলো সবচেয়ে নিচের স্তরে অবস্থান করে। যার কারণে পৃথিবীতে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হোক না কেন তা এই স্তরের মেঘ থেকেই হয়ে থাকে। মেঘগুলোর অবস্থান প্রায় ২,০০০ ফিট থেকে উপরে হতে পারে। মেঘগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা অনেক ঘনীভূত অবস্থায় থাকে, যার কারণে তাদের দেখতে অনেকটা ধূসর কালো রঙের মনে হবে। আমরা বর্ষার সময় যেই ধরণের মেঘ দেখে থাকি, এগুলো ঠিক তেমনি। এই মেঘগুলোর স্পষ্টত কোনো আকার-আকৃতি বোঝা যায় না। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কিছু ঢেউ খেলানো ভাব এবং হালকা থেকে ঘন মেঘ স্পষ্ট লক্ষ্য করা সম্ভব। কুয়াশা স্ট্রেটাস মেঘের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ।


৩। কিউমুলাস – এই ধরণের মেঘগুলো মূলত ফুলকপির মতো দেখতে। এই ধরণের মেঘগুলো তৈরি হয়ে থাকে সাধারণত ২,০০০-২০,০০০ ফিটের মধ্যে। এই ধরণের মেঘগুলোকে অনেক দূর থেকে খুব সুন্দরভাবে চেনা যায়। কিন্তু অনেক সময় মেঘগুলো যখন আপনার ঠিক মাথার উপরে থাকবে তখন মনে হতে পারে মাথার উপর স্ট্রেটাস মেঘ উড়ছে। বাস্তবে কিউমুলাস মেঘ স্ট্রেটাস মেঘের উপর গঠিত হয়। যার ফলে মাথার উপর দিয়ে অবস্থাঙ্কালে তাদের দেখা যায় না। এই মেঘগুলোর মাঝেই মূলত সকল ধরণের বজ্রপাত সংঘঠিত হয়। আবার অনেকগুলো কিউমুলাস মেঘ মিলিত হয়ে অনেক বড় আকারের কিউমুলাস মেঘ গঠন করতে পারে। কিউমুলাস মেঘ যখন অনেকগুলো একত্রিত হয়ে যায় তখন সেটি স্ট্রেটাস মেঘের মতো ধূসর কালো অথবা কালো বর্ণ ধারণ করে।
উচ্চতার ভিত্তিতে ভাগ সমূহ,
১। সাইরো – যে সকল মেঘগুলো ২০,০০০ ফিটের উপরে অবস্থান করে তাদেরকে সাইরো বলা হয়ে থাকে।
২। অল্টো – যে সকল মেঘগুলো ৭,০০০-২০,০০০ ফিটের মাঝামাঝি অবস্থান করে তাদেরকে অল্টো বলা হয়।
৩। নিম্বো – যে সকল মেঘগুলো ২,০০০ ফিটের উপরে অবস্থান করে তাদেরকে নিম্বো বলা হয়ে থাকে। (তথ্যসূত্রঃ Earth’s Meteorology, National Geography)
বিভিন্ন ধরণের মেঘের উদাহরণ
পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া সকল মেঘগুলোকে মূলত তাদের গঠন এবং উচ্চতার ভিত্তিতে নামকরণ করা হয়ে থাকে। সেই অনুযায়ী কিছু মেঘের উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হলো;

সাইরো-কিউমুলাস – এই ধরণের মেঘগুলো ২০,০০০ ফিটের উপরে অবস্থান করে। দেখতে ছোট গোলাকার এবং ফুলকপির মতো। মনে হবে যেন ছোট ছোট তুলো ভাসছে।

সাইরো-স্ট্রেটাস – এই ধরণের মেঘগুলো মূলত ২০,০০০ ফিটের নিচে অবস্থান করে। সাইরাস মেঘ থেকেও পুরু এবং এর আকার আকৃতি কিউমুলাসের মতো বোঝা যায় না।

অল্টো-কিউমুলাস – এই ধরণের মেঘগুলো মূলত কিউমুলাস মেঘ (ফুলকপির মতো দেখতে), ৭,০০০-২০,০০০ ফিটের মাঝে অবস্থান করে। দেখতে অনেকটা শরতের আকাশের মেঘের মতো।

অল্টো-স্ট্রেটাস – যে সকল স্ট্রেটাস মেঘগুলো ৭,০০০ থেকে ২০,০০০ ফিটের মধ্যে অবস্থান করে তাদের অল্টো-স্ট্রেটাস বলা হয়। এই মেঘে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম।

নিম্বো-স্ট্রেটাস – যে সকল স্ট্রেটাস মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত হয় এবং যেগুলো ২,০০০ ফিটের মধ্যে অবস্থান করে তাদের নিম্বো-স্ট্রেটাস বলা হয়।

স্ট্রেটো-কিউমুলাস – এই ধরণের মেঘগুলোর মাঝে দুই প্রকার গঠন লক্ষ্য করা যায়। এদের নিচের অংশ স্ট্রেটাস মেঘ থাকে এবং উপরের অংশ কিউমুলাস মেঘ থাকে। অনেক দূর থেকে লক্ষ্য করলে এমন মেঘ দেখা সম্ভব।

কিউমুলো-নিম্বাস – এই ধরণের মেঘে মূলত বজ্রপাত কিংবা বৃষ্টপাতও হয়ে থাকে। এগুলো তৈরি হয় যখন উচ্চচাপের ফলে দুই দিকের মেঘ একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করে। বিমানে থাকা অবস্থায় এই মেঘ দেখতে পাওয়া যায়।

স্ট্রেটো-কিউমুলো-নিম্বাস – কিউমুলো-নিম্বাস এবং এই মেঘের মাঝে তেমন একটা পার্থক্য নেই। শুধু একটির নিচের স্তর স্ট্রাটাস মেঘ দ্বারা তৈরি অপরটির ক্ষেত্রে নয়।

সাইরো-সাইরাস – এই ধরণের মেঘগুলো সাধারণত অনেক উচ্চতায় থাকে। দেখতে অনেকটা বাকা চাঁদের ন্যায়। এগুলো মূলত তৈরি হয়ে থাকে ছোট বরফ খন্ড দিয়ে।

ক্যাপ মেঘ – এই মেঘগুলো মূলত পর্বত শৃঙ্গের উপর তৈরি হয়। যখন পানির কণাগুলো অধিক পরিমাণে সম্পৃক্ত হয়ে যায় তখন তা মেঘের সৃষ্টি করে যা দেখতে ক্যাপের মতো মনে হয়।উপরের মেঘগুলো ছাড়াও আরো কিছু মেঘ রয়েছে যেগুলো তৈরি হয়ে থাকে কোনো পাহাড়-পর্বতের বাধার মুখে পড়ে অথবা পাহাড়ের সাথে মিলিত হয়ে। যেমন;

লেন্টিকুলার মেঘ – এই মেঘগুলো দেখতে অনেকটা লেন্সের মতো। এগুলো তৈরি হয় যখন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উষ্ণ বাতাস উপরের দিকে উঠতে থাকে।

এছাড়াও রয়েছে কন্ট্রেইলস বা কর্ট্রা। এগুলো সত্যিকারে মেঘ নয়। যখন কোনো জেট বিমান কোনো এলাকা দিয়ে উড়ে যায় তখন তার পিছন দিয়ে সাদা ধোয়ার মতো একটা দাগের সৃষ্টি হয়। একেই কর্ট্রা বলে। জেট ইঞ্জিন অধিক পরিমাণে গরম হওয়ায় বাতাসে থাকা জলীয়বাষ্পকে আরো ঘনীভূত করে, যার জন্য এই ধরণের লম্বা সাদা দাগের সৃষ্টি হয়। (তথ্যসূত্রঃ vortex.plymouth.edu/cloud.html)
পৃথিবীতে এখনো মেঘ নিয়ে বিভিন্ন মেঘ নিয়ে গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম মেঘও তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেন, যদিও তা স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। হয়ত একদিন আর আগের মতো খরায় কৃষকদের নিঃশেষ হতে হবে না। সেই আশা নিয়ে শেষ করছি।
আল্লাহ হাফেজ