পৃথিবী কি নতুন মহাসামুদ্রের অপেক্ষায়?

মহাসমুদ্রগুলোকে নিয়ে পৃথিবীর মানুষের আলোচনার শেষ নেই। পৃথিবীতে মহাসমুদ্রগুলো তৈরি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বহুবার তাদের রূপ পরিবর্তন করেছে। মহাসমুদ্রগুলো ছোট ছোট খাদ থেকে প্যান্থালাসার মতো বিশাল মহাসমুদ্রে আবির্ভাব। অতঃপর বর্তমানের ৫ মহাসমুদ্রের আগমন। সবকিছুর সাথেই ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা পৃথিবীর সৃষ্টির পর থেকেই চলে আসছে। বেশ কিছু সময় ধরে ইন্টারনেট জুড়ে একটি খবর অনেক ছড়িয়েছে, “আফ্রিকা মহাদেশের ফাটল থেকে নতুন মহাসমুদ্রের আগমন ঘটছে”। অনেকগুলো সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে বেশ কিছু বিজ্ঞানীদেরও মতামত এই, আমরা ৬ষ্ঠ মহাসমুদ্র দেখতে যাচ্ছি। সত্যিই কি তাই? আসলেই কি আমরা নতুন কোনো মহাসমুদ্রের স্বাদ পেতে যাচ্ছি? নাকি অন্য কোনো ক্রিয়াকলাপ ঘটতে যাচ্ছে? আফ্রিকা মহাদেশেরই বা কি হবে? আসুন বিস্তারিত জেনে নিই।

মহাসমুদ্রের সৃষ্টি

মহাসমুদ্রের কথা উল্লেখ করার পূর্বে আরেকটি তথ্য যোগ করতে চাইবো। পৃথিবীতে প্রিমরডিয়াল্ল স্যুপের (পৃথিবীর চারদিক লাভা দ্বারা আবৃত) যুগ পার করেছিলো পানির আগমনের পূর্বে। যখন পৃথিবী ঠান্ডা হতে শুরু করে ততক্ষনে পৃথিবীর টেকটনিক ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এতে কিছু সমস্যা ছিলো। পৃথিবীতে তখনো বড় কোনো বেসিন তৈরি হয়নি যা বর্তমানের বিশাল জলরাশি ধারণ করতে পারবে। ঐসময় আজ থেকে প্রায় ৪.১-৩.৫ বিলিয়ন বছরের মাঝে পৃথিবীতে বড় বড় গ্রহাণুগুলো আঘাত করতে থাকে। এর ফলে পৃথিবীতে বড় বড় খাঁদ বা বেসিনের সৃষ্টি হতে থাকে। তবুও বেসিনগুলো যথেষ্ঠ বড় ছিলো না।  ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের ফলে বেসিনগুলো বড় হতে থাকে।

The Mighty Ocean - Picture of Sarasota, Southwest Gulf Coast ...

এই পদ্ধতিকে ভূতত্ত্বিক ভাষায় ‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফট” বলে। অর্থাৎ, দুইটি মহাদেশীয় প্লেট যখন দুইদিকে মেন্টাল প্লুম থেকে উৎপন্ন শক্তির কারণে সরে যায়। এর ফলে বেসিনগুলো আয়তনে বড় হতে থাকে আবার অন্যদিকে কন্টিনেন্টগুলো ভাঙতে থাকে। যার ফলে কন্টিনেন্টগুলো বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে যে সকল কন্টিনেন্টগুলো আমরা দেখছি, সেগুলোও পরিবর্তিত রূপ।

চিত্রঃ উইলসন সাইকেল

কন্টিনেন্টের এরূপ ভাঙা গড়া এবং মহাসমুদ্রের তৈরি হওয়ার এই পদ্ধতিকে বিজ্ঞানী উইলসনের নামানুসারে “উইলসন সাইকেল” বলা হয়। এই তত্ত্ব দিয়ে বিজ্ঞানী উইলসন দেখিয়েছেন কিভাবে একটি কন্টিনেন্ট গঠিত হয়, কিভাবে সমুদ্রগুলো খুলতে শুরু করে, কিভাবে সেগুলো প্রসারিত হতে থাকে, এবং আবার কিভাবে আরেকটি কন্টিনেন্টের উৎপত্তি ঘটে।

চিত্রঃ মহাসমুদ্র প্যান্থালাসা

পৃথিবীর সর্বোপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় মহাসমুদ্র ছিলো প্যান্থালাসা মহাসমুদ্র। বিজ্ঞানীদের মতে এটির উৎপত্তি পেলিওজোয়িক এবং মেসোজোয়িকের মাঝামাঝি সময়ে। যা ঘটেছিলো প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে। তখন শুধুমাত্র পেঙ্গিয়া সুপার কন্টিনেন্ট ছিলো (ঐসময়কার কন্টিনেন্টগুলো একসাথে সংযুক্ত থাকায় তাদের একসাথে সুপার কন্টিনেন্ট বলা হয়)। তখনো প্যান্থালাসা পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ দখল করে ছিলো। বর্তমানে মহাসমুদ্রগুলো পৃথিবীর  প্রায় ৭১ ভাগ দখল করে আছে।

পেঙ্গিয়া সুপার কন্টিনেন্ট যখন ভেঙে গিয়ে লউরেসিয়া এবং গোন্ডওয়ানা কন্টিনেন্ট দুইটি তৈরি করে তখন তাদের মধ্যবর্তি জায়গায় তেথিস সাগরের জন্ম হয়। অবশ্য লউরেসিয়া এবং গোন্ডওয়ানা কন্টিনেন্ট দুইটি ভাগ হয়ে যাওয়ার পর তেথিস সাগর বন্ধ হয়ে যায়, ইন্ডিয়ান কন্টিনেন্ট এবং ইউরেসিয়ান কন্টিনেন্টের সংঘর্ষের ফলে। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা ভেঙে মাঝে তৈরি হয় উত্তর অ্যাটলান্টিক মহাসাগর এবং আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা ভেঙে মাঝে তৈরি হয় দক্ষিণ অ্যাটলান্টিক মহাসাগর। অপর দিকে প্যান্থালাসা ছোট হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে রূপ নেয়। ইন্ডিয়ান কন্টিনেন্টের জায়গা পরিবর্তনের দরুন ভারত মহাসাগরের সৃষ্টি হয়।

এসকল সাগর মহাসাগরের সৃষ্টি হতে হাজার হাজার বছর লেগেছিলো। এখন প্রশ্নে ফিরে আসা যাক। ৬ষ্ঠ মহাসাগর তৈরি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি? আমার মতে থাকার সম্ভাবনা হয়ত কিছুটা আছে। কিন্তু তার জন্য হয়ত আপনাকে আরো কয়েক মিলিয়ন বছর বাঁচতে হবে। চলুন আফ্রিকার ফাটলটি নিয়ে আলোকপাত করা যাক।

ট্রিপল জাংশন

আফ্রিকায় যাওয়ার পূর্বে ট্রিপল জাংশন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেওয়া যাক। ট্রিপল জাংশন হচ্ছে এক ধরণের সংযুক্ত হটস্পট, যেখানে তিনটি টেকটনিক প্লেট একত্রিত হয় অথবা সংঘর্ষ করে। এর কেন্দ্রবিন্দুকে মূলত হটস্পট বলা হয়। যখন তিনটি মহাদেশীয় প্লেট একসাথে একি জায়গায় মিলিত হয় এবং তাদের মধ্যে তিন ধরণের ক্রিয়াকলাপ বিদ্যমান থাকে, শুধুমাত্র তখনি একে ট্রিপল জাংশন বলা যায়। যেমন, আফ্রিকার উত্তর-পূর্বে একটি ট্রিপল জাংশন রয়েছে। সেখানে ইন্ডিয়ান প্লেট, আফ্রিকান প্লেট, এবং সোমালিয়ান প্লেট অবস্থিত।

চিত্রঃ বিভিন্ন মহাদেশীয় প্লেট

ট্রিপল জাংশন মূলত তিন ধরণের হয়ে থাকে। তার মধ্যে আফ্রিকায় যেটি দেখা যায় সেটি হচ্ছে রিজড-রিজড-ফল্ট ট্রিপল জাংশন। (তথ্যসূত্রঃ Triple junction- Carl K. Seyfert)

নতুন মহাসমুদ্রের আগমন কি সত্য ঘটনা?

পূর্ববর্তী অংশে বলেছি যে আফ্রিকায় যেটি দেখা যায় সেটি হচ্ছে রিজড-রিজড-ফল্ট ট্রিপল জাংশন। অর্থাৎ, তিনটি মহাদেশীয় প্লেটের দুইটিতে সমুদ্রের সম্প্রসারণ হচ্ছে এবং একটিতে কন্টিনেন্ট ভেঙে দুইদিকে সরে যাচ্ছে। একটি কন্টিনেন্টের দুইদিকে সরে যাওয়া উইলসন সাইকেলের একটি অংশ। আর সেটি ঘটছে ফল্ট (ফাটল) লাইনের উপর।

চিত্রঃ আফ্রিকা মহাদেশে ভূতাত্ত্বিক অবস্থান

ইন্ডিয়ান প্লেট এবং আফ্রিকান প্লেটের উত্তর অংশে রিজড দেখা যাচ্ছে। রিজড অংশে সব সময় মেন্টাল প্লুমের জন্য নতুন করে দুইটি প্লেটের সৃষ্টি হয় আর বিপরীত দিকে সরে যায়। যার কারণে লোহিত সাগরের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি এখনো লোহিত সাগর সম্প্রসারিত হচ্ছে রিজড এর জন্য। পশ্চিমে সোমালিয়ান প্লেট এবং ইন্ডিয়ান প্লেটের মাঝে রিজড তৈরি হয়েছে। যেখানে ‘এড্যান রিজড’ থেকে লোহিত সাগরের সম্প্রসারণ ঘটছে। হটস্পট থেকে দক্ষিণে ইথোপিয়ার উপর দিয়ে সোমালিয়ান প্লেট এবং আফ্রিকান প্লেটের ফল্ট লাইনটি চলে গিয়েছে। এই ফল্ট লাইনের জন্যই মূলত ইথোপিয়ার মাঝখানে বড় ধরণের ফাটলটি উন্মোচিত হয়েছে।

যদিও এই ফাটলটি তৈরি হতে সময় নিয়েছিলো প্রায় ২ মিলিয়ন থেকে ৯০ হাজার বছরের মাঝামাঝি।  আর এই ফল্ট বা ফাটলটি ‘ইস্ট আফ্রিকান রিফট’ নামেও পরিচিত। এটি প্রতি বছর প্রায় ৬-৭ মিমি করে ছড়িয়ে পড়ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই জায়গায় এমন ঘটছে? সত্যি বলতে পৃথিবীর অনেক জায়গায় এমন ঘটনা ঘটছে আমাদের চোখের আড়ালে। উপরের ছবিটি লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন কিছু লাল ত্রিভুজের মতো চিহ্ন। এই লাল ত্রিভুজ চিহ্ন দিয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অবস্থান দেখানো হয়েছে। আরো ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বেশির ভাগ আগ্নেয়গীরিগুলো ইথোপিয়া, কেনিয়া, ইয়েমেন ‘র নিচে অবস্থান করছে। (তথ্যসূত্রঃ “Continental break-up: The East African perspective”- Ebinger, Cynthia (April 2005))

এখন আবার প্রশ্ন আসে, সক্রিয় আগ্নেয়গীরি হওয়া সত্ত্বেও কেন অগ্নুৎপাত হচ্ছে না? ভূতাত্ত্বিকভাবে অগ্নুৎপাতের জন্য ক্রাস্টের উপরের অংশ দুর্বল হতে হয়। এক্ষেত্রে ক্রাস্টি অনেক পুরু। শুধুমাত্র মেন্টাল প্লুমের জন্যই দুই মহাদেশীয় প্লেট দূরে সরে যাচ্ছে।

চিত্রঃ ইস্ট আফ্রিকান রিফট

এখন আসি আমাদের পূর্বের প্রশ্নে। এই ফাটলের দরুন কোনো মহাসমুদ্রের সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা আছে কি? বলা যায় হ্যা, থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু হয়ত মহাসমুদ্র নয়, বরং ছোট একটি সমুদ্রের আশা করা যায়। কারণ, ফাটলটি শুধুমাত্র ইথোপিয়া এবং কেনিয়ার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। এখন যদি পুরো একটি ব্লক আলাদা হয়েও যায় সেটি হবে সামান্য পরিসরে। যেমনটা দেখতে পাবেন লোহিত সাগরের উৎপত্তির সময়। অথবা যদি অ্যাটলান্টিক মহাসাগরেরও উদাহরণ দিই তবে লক্ষ্য করবেন দুইটি মহাদেশের মধ্যবর্তি বিশাল জায়গায় এটি অবস্থিত। এমনকি অ্যাটলান্টিক মহাসাগর এখনো প্রাসারিত হচ্ছে।

সম্পূর্ণ আলোচনার সাপেক্ষে দুইটি সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতে পারি,

১। আফ্রিকার ফাটলটির জন্য প্রায় মিলিয়ন বছরের মধ্যে নতুন একটি সমুদ্রের সৃষ্টি হতে পারে (মহাসমুদ্র নয়) এখন থেকে প্রায় ১০ মিলিয়ন বছর পর।

২। আফ্রিকা মহাদেশের পুর্ব দিকের একটি অংশ চিরজীবনের জন্য আলাদা হয়ে যেতে পারে (ইথোপিয়া এবং কেনিয়া)।

অর্থাৎ, আমাদের প্রত্যাশিত ৬ষ্ঠ মহাসাগর দেখতে না পারার সম্ভাবনাই বেশি। এছাড়া ইতিহাসের কোনো এক সময় হয়ত আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণের অনেক অংশেই ফাটল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। আর  হয়ত মিলিয়ন বছর পর আফ্রিকা মহাদেশ মানচিত্রে নতুন রূপে ফিরতে পারে। সাথে হয়তবা অদূর ভবিষ্যতে কোনো সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের নাম ভেসে উঠবে।

আজ এটুকুই। আল্লাহ হাফেজ।

Comments are closed.