আরব সাগর বনাম বঙ্গোপসাগর (পর্ব-০১)

পৃথিবীটা খুবই অদ্ভুত। এখানে বসবাসকারী সকল প্রাণী কোনো না কোনোভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকে। আপনি চাইলেও কোনো না কোনো একটা কাজ নিজে নিজেই করতে পারবেন না। একইভাবে একটি পুরো ইকোসিস্টেম পরিচালিত হয় একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীলতার অপর ভিত্তি করে। সেখানে একটি শব্দ ভেসে আসে “জীবন”। আর জীবনের উৎপত্তি হয় সাগর বা মহাসাগর থেকেই যা বিজ্ঞানের ধারণা। এই সাগর এবং মহাসাগরগুলো পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক বিষয় বস্তুগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। বায়ু চলাচলের দিক থেকে শুরু করে ঘোটা একটি মহাদেশকে গরম রাখা পর্যন্ত, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে শীতের সকালের শিশির পর্যন্ত, সর্বোচ্চ পাহাড় থেকে গভীর গিরিখাত, বড় বড় প্রানীদের আবাস্থল, এছাড়াও অনেক কিছুই ঘটে থাকে আমাদের এই সাগর মহাসগরগুলোতে যা আমাদের অনেকেরই অজানা। সমুদ্র পাড়ে গিয়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা আর সমুদ্রকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা কখনো এক নয়। সমুদ্র বা মহাসমুদ্র আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক জটিল। আর আজকে আমি শুধুমাত্র দুইটি সমুদ্রের মধ্যে তুলনা করে দেখানোর চেষ্টা করবো যে আমাদের ভারত মহাসাগরে অবস্থিত সমুদ্রগুলো কতটুকু নিরীহ বা উত্তাল। তাহলে শুরু করা যাক………

পরিচয় পর্ব

আরব সাগর

আরব সাগর, তেমনভাবে সবার কাছে সুপরিচিত নাহলেও এর সবচেয়ে বড় পরিচিতি হয় “দ্যা সি আব ট্রেড” নামে। আর এই সাগরের নাম টাও এমন একটি কারণেই এসেছে। কারণ ইউরোপের সাথে বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে আরব সাগর। আরব সাগর ভারত মহাসাগরের উত্তরে অবস্থিত। আরব সাগরের উত্তরে রয়েছে পাকিস্তান এবং ইরান, পশ্চিমে অ্যাডেন উপসাগর, পূর্বে ভারত, আরবীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে ল্যাকক্যাডেভ সাগর, দক্ষিণে সোমালিয়া সাগর দ্বারা বেষ্টিত। পশ্চিমে আডেন উপসাগরীয় বাব-এল-মান্দেব নদীর জলসীমা দ্বারা আরব সাগরকে লোহিত সাগরের সাথে সংযুক্ত করে এবং এটি ওমান উপসাগর ও পারস্য উপসাগরের সাথেও যুক্ত রয়েছে।

এই সাগরের আয়তন ৩,৮৬২,০০০ বর্গ কিমি(১,৪৯১,০০০ বর্গ মাইল)। এর গড় গভীরতা ২,৯৯০ মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৫,৮০৩ মিটার (১৯,০৩৮ফিট)। দক্ষিণ-পূর্বে লক্ষদ্বীপ অ্যাটলগুলি মালদ্বীপ সাবমেরিন খাদের অংশ তৈরি করে, যা ভারত মহাসাগরের আরও দক্ষিণে বিস্তৃত যেখানে মালদ্বীপের অ্যাটলগুলি গঠনের জন্য একটি পৃষ্ঠ বা ব্লকের উপরে উঠে যায়। সমুদ্রের পশ্চিম দিকে সমুদ্রের মালভূমি দ্বীপ সকট্রা প্রায় ৭০ মাইল (১১০ কিলোমিটার) দীর্ঘ এবং প্রায় ১,৪০০ বর্গমাইল (৩,৬২৫ বর্গকিলোমিটার) এলাকা সহ হর্ণ অফ আফ্রিকা এর একটি অন্তরক প্রসারণ, যা ১৬০ মাইল দূরে অবস্থিত। (তথ্যসূত্রঃ Arabiansea- Anwar Abdel Aleem)

বঙ্গোপসাগর

পৃথিবীর উত্তাল কিছু সমুদ্রের মাঝে এই নামটি সুপরিচিত। বিশেষ করে ইংরেজদের শাসন আমলে এই সাগরকে তাদের নিত্যপ্রয়োজনের একটি পথ হিসেবে ধরা হয়। তখনকার সময়ে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে বাণিজ্যের জন্য বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরকে বেছে নেয়। তাছাড়া এই সাগরের রয়েছে নানা বৈচিত্র যা যেকোনো বিজ্ঞানীকে মুগ্ধ করবেই। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমে রয়েছে ভারত, শ্রীলংকা, উত্তরে রয়েছে বাংলাদেশ, পূর্বে রয়েছে মায়ানমার (বার্মা), আন্দামান দ্বীপ, আন্দামান সাগর, এবং দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। বঙ্গোপসাগরের নাম এসেছে প্রাচীন বঙ্গ থেকে, যখন পশ্চিম বঙ্গ (কলকাতা) এবং পূর্ব বঙ্গ (বাংলাদেশ) ছিল। আরবদের সময়ে যখন বাণিজ্য শুরু হয় তখন তারা এই এলাকায় বন্দর স্থাপন করতে শুরু করে এবং বঙ্গের সাথে মিল রেখে এই সাগরের নাম দেয় বঙ্গোপসাগর।

বঙ্গোপসাগর আরব সাগর থেকে অনেকটাই ভিন্ন। তার কারণগুলো অবশ্য পরবর্তীতে আলোচনা করবো। প্রধান কিছু চরিত্র যদি তুলে ধরি তাহলে বলতে পারি। যেমন, প্রচুর পরিমাণে নদীর পানির উৎস, তিন দিক দিয়ে বদ্ধ জলরাশি, ২০০ কিমি বিস্তৃত কন্টিনেন্টাল শেলফ ইত্যাদি। তাছাড়াও বায়ু প্রবাহের দিকের উপর নির্ভর করেও এই সাগরে প্রতি বছর বিশাল আকারের ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে। বেশ কয়েকটি বড় নদী বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে, গঙ্গা – হুগলি-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র – যমুনা, বরক – সুরমা – মেঘনা, ইরাবতী, গোদাবরী, মহানদী, ব্রাহ্মণী, বৈতরণী, কৃষ্ণ এবং কাভেরি। কিছু ঐতিহাসিক এবং সুপরিচিত বন্দরগুলো এই সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। যেমন, চেন্নাই পোর্ট, ইন্নোর পোর্ট, চট্টগ্রাম পোর্ট, কলম্বো পোর্ট, কলকাতা-হলদিয়া পোর্ট, মংলা পোর্ট, পারাদীপ পোর্ট, পোর্ট ব্লেয়ার, বিশাখাপাটনম এবং ধমরা পোর্ট।

বঙ্গোপসাগর প্রায় ২,১৭২,০০০ বর্গকিলোমিটার (৮৩৯,০০০ বর্গ মাইল) এলাকা দখল করে আছে। এই সমুদ্রের গড় গভীরতা ২৬০০ মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৫,২৫৮ মিটার। তাছাড়া রয়েছে প্রায় ২০০ কিমি বিস্তৃত কন্টিনেন্টাল শেলফ, ১৬৪০ মিটার গভীর গিরিখাত, ছোট ছোট পানির বলয় চক্র রয়েছে (১০০ কিমি ব্যাসার্ধ) ইত্যাদি। এই সমুদ্রের প্রাণি জগৎ নিয়েও অনেক তথ্যবহুল আলোচনা রয়েছে। এমনকি অনেক অজানা তথ্য রয়েছে যা হয়ত আমাদের অনেকেই জানেন না।

তবুও বঙ্গোপসাগরে গবেষণা এখনো অনেক কম। যার কারণে বিজ্ঞানীরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তথ্যের সন্ধানে। (তথ্যসূত্রঃ Bay of Bengal- Joseph R. Morgan)

আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের উৎপত্তি

পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তুর আবির্ভাব অনেকটাই পরিকল্পিতভাবে এসেছে। যেমন পৃথিবীর একদম শুরুতে শুধুমাত্র গলিত লাভা ছিল। তারপর পানির আবির্ভাব,

সমুদ্র-মহাসমুদ্রের সৃষ্টি, জীবনের সৃষ্টি, মহাদেশগুলোর ভাগ হয়ে যাওয়া, তাদের স্থানের পরিবর্তন ইত্যাদি ইত্যাদি। আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের উৎপত্তি প্রায় একই সময়ে হয়েছিল। উভয় সাগর খোলে করে ৫৫-৫০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে। তারপর থেকে তারা প্রসারিত হতে থাকে এমনকি এখনো হচ্ছে। আজ থেকে প্রায় ৩.৫-৩ বিলিয়ন বছর পূর্বে প্রথম ক্রাস্ট (ভূমি) তৈরি হয় (তথ্যসূত্রঃ The plate tectonics theory- Alfred Wegner)। তারপর থেকে ক্রাস্টগুলো ভাঙতে থাকে আবার পুনরায় তৈরি হতে থাকে। এভাবে এসেছিল প্রথম সুপার কন্টিনেন্ট “উর” যা ৩.১ বিলিয়ান বছর পূর্বে তৈরি হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে আসতে থাকে সুপার কন্টিনেন্ট রডিনা, পেঙ্গিয়া। পেঙ্গিয়া ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল লউরেশিয়া এবং গনওয়ানাল্যান্ড। গনওয়ানাল্যান্ড ভেঙ্গে ইন্ডিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের সৃষ্টি হয়।

হয়। ১৩২ মিলিয়ন বছর পূর্বে টেকটনিক শিফটের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে থাকে। আর এর মাঝে ভারতীয় মহাসাগর খুলতে আরম্ভ করে।  ঐসময় “কারগুলিয়ান হটস্পট” নামক একটি ম্যান্টাল প্লুমের সৃষ্টি হয় যা থেকে ইন্ডিয়ান কন্টিনেন্ট এবং অ্যান্টার্কটিক কন্টিনেন্ট আলাদা হয়ে যায়। ১২০-৫৫ মিলিয়ন বছরের মাঝে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটে আঘাত করে। এর ফলে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচের দিকে সাবডাক্ট করে। কারগুলিয়ান হটস্পটের কারণে যে শিফট হয়েছিলো তার ফলাফল হিসেবে সিলেট আগ্নেয়গীরি এবং রাজমহল আগ্নেয়গীরির সৃষ্টি হয়। এটিই এই শিফটের একমাত্র প্রমাণ।

এখন আসি বঙ্গপোসাগরের উৎপত্তি নিয়ে। বঙ্গোপসাগর, ভারতীয় প্লেটের উত্তরমুখী হয়ে

পাশাপাশি উন্মুক্ত ও প্রসারিত হয়েছে প্রায় ৬ সে.মি./বছর হারে ১২০-৫৫ মিলিয়ান বছরের মধ্যে। স্যাটেলাইট থেকে পরিমাপ করে দেখা গিয়েছে বঙ্গোপসাগরের ক্রাস্টাল প্লেট প্রতি বছর প্রায় ২ সে.মি. করে সরে যাচ্ছে(তথ্যসূত্রঃ stecklar,2008) । বঙ্গপোসাগরের প্রায় মাঝ দিয়ে “90 east ridge” চলে গিয়েছে। যেটি চলে গিয়েছে ঠিক বাংলাদেশের মাঝ বরাবর একদম সিলেট পর্যন্ত। (তথ্যসূত্রঃ The plate tectonics theory- Alfred Wegner)

এখন আসি আরব সাগর নিয়ে। আরব সাগরের উৎপত্তি আর বঙ্গোপসাগরের উৎপত্তি প্রায় একই সময়েই হয়েছে। তারপরও তাদের গঠন আর সমুদ্র তলদেশের অবস্থা অনেকটাই ভিন্ন। তার কারণ হতে পারে আফ্রিকা মহাদেশ। ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট যখন ভাগ হওয়া শুরু করে তখন আফ্রিকা মহাদেশও ভাগ হতে থাকে। আর এইদিক দিয়ে প্রায় ৫২ মিলিয়ন বছরের মাঝে, ইন্ডিয়ান কন্টিনেন্টের সংঘর্ষের পর, আরব সাগর খোলা শুরু করে। ম্যাগনেটিক এনোম্যালি দিয়ে হিসেব করে দেখা হয়েছে আরব সাগরের পুরতন শিলার বয়স ৫২-৪৫ মিলিয়ন বছর।

ভূত্বত্ত ও ভূমিরূপ

আরব সাগর

আজকের আরব সাগর প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে তখনকার ভারত উপমহাদেশ এশিয়ার সাথে সংঘর্ষের কারণে গঠিত হয়। সকট্রা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়ে আছে অন্তঃসাগরীয় কার্লসবার্গ রিজ (একটি দীর্ঘ সরু পাহাড়ের চূড়া, পর্বতশ্রেণী)। এটি ভারত মহাসাগরের ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপের সাথে মিলে যায় যা আরব সাগরকে দুটি প্রধান ‘বেসিন’ বা অববাহিকায় বিভক্ত করে পূর্বদিকে আরব অববাহিকা এবং পশ্চিমে সোমালিয়া অববাহিকা। কার্লসবার্গ রিজটি লম্বালম্বিভাবে একটি কেন্দ্রীয় উপত্যকা দ্বারা বিভক্ত যা সমুদ্রের পৃষ্ঠের নীচে প্রায় ৩,৬০০ মিটার (১১,৮০০ ফুট) গভীরতায় পৌছায়।

আডেন উপসাগরের উপকূলীয় উচু উচু পাহাড়গুলো বিভিন্ন চিড়, ফাটল দ্বারা তৈরি, যা আফ্রিকার পূর্ব দিকের ছড়াই হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে। আরব বেসিনকে ওমান উপসাগরীয় বেসিন থেকে মূরেয় রিজটি আলাদা করেছে। মূরেয় রিজ এর পশ্চিমে মালিয়ান সাবডাকশন জোন, এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে সমুদ্রের তলদেশে মহাদেশীয় ব্লকটি ভূত্বকের নীচে ডুবে গেছে। আরব সাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে সিন্ধু নদী (ইন্ডুস নদী) দ্বারা একটি গভীর সাবমেরিন গিরিখাত কেটে তৈরি হয়েছে, যা প্রায় ৫৩৫

মাইল (৮৬০ কিলোমিটার) প্রশস্ত এবং ৯৩০ মাইল (১,৫০০ কিলোমিটার) জায়গার উপর গভীর মৌচাকের মতো পাতলা পলল শিলা জমা করেছে। এই গভীর মৌচাক আকৃতির পলল আরব সাগরের উত্তর-পূর্ব তলদেশের বেশিরভাগ অংশ দখল করে রেখেছে। এখানে অবস্থিত কন্টিনেন্টাল শেলফটি আরব উপদ্বীপের দিকে অনেকটাই উপকূলে সংকীর্ণ এবং সোমালিয়া উপকূলে এর চেয়ে বেশি সংকীর্ণ। আরব উপকূল বরাবর সত্যিকারের প্রবাল প্রাচীর খুঁজে পাওয়া যায় নি। ক্যাপ-আল-হাদ এর নিকটে যে পলল পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে কিছু আছে সবুজাব সাদা রঙের কাদা-মাটি যা গ্রীষ্ম মৌসুমে সমুদ্রের গভীর পানির আপওয়েলিং (নিচের পানি উপরে আসার পদ্ধতি) এর মাধ্যমে উপরে আসে। এই পলল গুলোতে প্রচুর পরিমাণে জৈব হাইড্রোজেন সালফাইড পাওয়া যায়। এই জায়গা কে “ফিস সিমেন্ট্রি” বা মাছের কবরস্থান বলা হয়। টেরিজেনাস ডিপোজিটগুলো (জমে থাকা পলল বা শিলা) কন্টিনেন্টাল ঢালটির বড় একটি অংশ জুড়ে বিস্তৃত প্রায় ২,৭০০ মিটার পর্যন্ত।

তার নিচে ক্যালসিয়াম ডিপোজিট গুলো অবস্থা করছে প্রায় ৪,০০০ মিটার গভীরে। এই ক্যালসিয়াম গ্লোবিজেরিনা (Globigerina) নামক প্রাণী থেকে প্রাপ্ত। তারও নিচে অবস্থান করছে লাল পলি মাটি। (তথ্যসূত্রঃ Tectonic and climatic evolution of the Arabian Sea region: An introduction)

বঙ্গোপসাগর

সেই ৫৫ মিলিয়ন বছর থেকে আজ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের অনেক ধরণের পরিবর্তন হয়েছে। এসকল পরিবর্তনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, উত্তরে কন্টিনেন্টাল শেলফের উত্থান, জিবিএম সিস্টেমের মাধ্যমে পলি মাটির স্তর, বেঙ্গল ফ্যান, 90 ইস্ট রিডজ, 85 ইস্ট রিডজ, সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড ইত্যাদি। শুরু করবো কন্টিনেন্টাল শেলফ (Continental Shelf) দিয়ে। বাংলাদেশ এবং ভারতের উপকূলে বঙ্গোপসাগরের কন্টিনেন্টাল শেলফের প্রস্থ কিছুটা কম বেশি। দক্ষিণ উপকূলে হিরণ পয়েন্ট, কলকাতা ও সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডের (Swatch of no Ground) মধ্যে এটি ১০০ কিলোমিটারেরও কম প্রশস্ত, আবার কক্সবাজার উপকূলের সম্মুখে ২৫০ কিলোমিটারেরও অধিক প্রশস্ত। সমুদ্র অভিমুখে এবং পশ্চিম অভিমুখের পলল মাটি ও সামুদ্রিক গিরিখাত (Submarine canyon) সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডের নিকটে সর্বাধিক পুরুত্ববিশিষ্ট কর্দমের সঞ্চয়ন ঘটেছে। চট্টগ্রাম ও টেকনাফ উপকূল অভিমুখী মহীসোপানের অগভীর (২০ মিটারেরও কম  অংশ) বালি দ্বারা আবৃত এবং আন্তজোয়ারভাটা এলাকাসমূহ সুগঠিত বালুময় সমুদ্রতট প্রদর্শন করে থাকে। অপরদিকে সুন্দরবন, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী উপকূল অভিমুখী মহীসোপানের দক্ষিণ ভাগের অগভীরতর অংশটি পলিকণা ও কর্দম দ্বারা আবৃত এবং উপকূলরেখা বরাবর একটি বিস্তীর্ণ কর্দমাক্ত সমভূমি  (Muddy tidal flats) গড়ে উঠেছে। কন্টিনেন্টাল শেলফটি ৪৫-৩২ মিলিয়ন বছরের মাঝে কোনো এক ভূমিকম্পের কারণে উপরের দিকে উঠে আসে, সাথে জিবিএম সিস্টেম থেকে আসা পলি মাটি জমা হতে থাকে যা আজ প্রায় ২০ কিমি পুরুত্ব ধারন করে।

তারপর বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রায় ৩২ মিলিয়ন বছর পূর্বে ২২ কিমি প্রশস্থ একটি নদী বয়ে যেত যা হিমালয় থেকে আসা বরফ গলা পানি বয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলত। নদীটির বহমান দিক ছিল বর্তমান সামুদ্রিক গিরিখাতটি। ঐ অংশটুকু বছরের পর বছর দূর্বল করে দিয়ে পলললের ধস নেমে কেটে তারপর বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রায় ৩২ মিলিয়ন বছর পূর্বে ২২ কিমি প্রশস্থ একটি নদী বয়ে যেত যা হিমালয় থেকে আসা বরফ গলা পানি বয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলত।

নদীটির বহমান দিক ছিল বর্তমান সামুদ্রিক গিরিখাতটি। ঐ অংশটুকু বছরের পর বছর দূর্বল করে দিয়ে পলললের ধস নেমে কেটে হিমালয় থেকে আসা পললগুলো বঙ্গোপসাগরে নিয়ে জমা করে। আর এখান থেকেই সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সর্বোবৃহৎ ফ্যান, বেঙ্গল ফ্যান, যা গঙ্গা ফ্যান নামেও পরিচিত। এটি ২,৮০০ থেকে ৩,০০০ কিমি দীর্ঘ, ৮৩০ থেকে ১,৪৩০ কিমি প্রশস্ত এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের তলদেশে এটি প্রায় ১২ কিলোমিটার

পুরু পলল দ্বারা গঠিত। (তথ্যসুত্রঃ Geo resource and geo hazards of Bangladesh- Dr. Prof. Aftab Alam Khan)

সুন্দা ট্রেঞ্চ বা জাভা ট্রেঞ্চ নামে পরিচিত নিকোবর ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জদ্বয় সৃষ্ট বাঁকের পশ্চিম পার্শ্বে সমান্তরাল বরাবর এই ট্রেঞ্চ বা খাদ বিস্তৃত হয়েছে। উত্তর অভিমুখে এই ট্রেঞ্চ উপসাগরে ১০° উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে এবং হিমালয় পর্বতমালার পূর্বসীমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভূতাত্ত্বিকভাবে ভারতীয় প্লেট এবং মায়ানমার প্লেটদ্বয়ের মিলনস্থলে সাবডাকশানের জন্য এই ট্রেঞ্চের উৎপত্তি।

চলবে…………

2 Comments

  1. আরব সাগর বনাম বঙ্গোপসাগর (পর্ব- ০২) | বিজ্ঞানবর্তিকা

    […] আরব সাগর বনাম বঙ্গোপসাগর (পর্ব-০১) […]

Comments are closed.