আরব সাগর বনাম বঙ্গোপসাগর (পর্ব- ০২)

আরব সাগর বনাম বঙ্গোপসাগর (পর্ব-০১)

গত পর্বের পর থেকে……… 

ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকার মধ্যে আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর

আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ৪-৭ টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবে এই ঘূর্ণিঝড়গুলো বছরের দুইটি সময়ে হয়ে থাকে। এর সময়কাল হচ্ছে এপ্রিল-জুন এবং অক্টোবার-নভেম্বার মাসে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই মাসগুলোতেই ঘূর্ণিঝড় সংঘঠিত হয়, অন্য মাসে কেন নয়? এর সাথে সমুদ্রের ভৌত বিজ্ঞানের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার জন্য ৫ টি ক্ষেত্র পূর্ণ করতে হবে। নিচে তার বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ভারত মহাসাগরের এই উত্তর ভাগে মৌসুমি বায়ুর খুবই চমকপ্রদ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যার জন্য পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই অনেক ঋতুর সমাগম দেখা যায়। অবশ্য প্রধান ঋতু তিনটি। গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীত এবং এদেরকে মোট চারটি মৌসুমে ভাগ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান তিনটি হচ্ছে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ু, শীতকালীন মৌসুমি বায়ু, শীত-গ্রীষ্ম অন্তঃবর্তীকালীন মৌসুমি বায়ু। আর এই শীত-গ্রীষ্ম অন্তঃবর্তীকালীন মৌসুমি বায়ুর শেষের দিকেই ঘূর্ণিঝড়গুলো তৈরি হয়। এখন আসি কেন‘র উত্তরে।

শীত-গ্রীষ্ম অন্তঃবর্তীকালীন মৌসুমি বায়ুর সময়কালের শেষের দিকে সমুদ্রের উপরিভাগের পানির উপরিভাগের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে থাকে, যা ঘূর্ণিঝড় তৈরির প্রথম শর্ত। শীত-গ্রীষ্ম অন্তঃবর্তীকালীন মৌসুমি বায়ুর মৌসুমে আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের বায়ু প্রবাহ দুর্বল হয়ে পড়ে। যার জন্য বায়ু প্রবাহ কিছু কিছু যায়গায় ভেঙে যায় এবং একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কারণ গ্রীষ্ম মৌসুমে মৌসুমি বায়ুগুলো মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। আর এই বায়ু ভূমির দিকে (তিব্বতের মাল্ভূমি/হিমালয়ে বাধা পায়) প্রবাহিত হয়। আবার বিপরীত দিক থেকে আসা বায়ু প্রবাহ সরাসরি গ্রীষ্ম মৌসুমি বায়ুর সাথে সংঘর্ষ করে। যার ফলে সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জলরাশির উপর ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়ে থাকে, যা হচ্ছে দ্বিতীয় শর্ত। প্রচুর তাপমাত্রার কারণে যে নিম্ন চাপের সৃষ্টি হয়ে, সেখানে বাতাসের সংঘর্ষের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং প্রচুর ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়। এটি হচ্ছে তৃতীয় শর্ত। চতুর্থ শর্ত মতে, বায়ুগুলো উলম্বভাবে দুর্বল হয়ে ভেঙ্গে যাবে। পঞ্চম এবং শেষ শর্ত মতে, বাতাসে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প থাকা লাগবে যা শীত-গ্রীষ্ম অন্তঃবর্তীকালীন মৌসুমি বায়ুর সময়কালে ভালো তৈরি হতে পারে।

সুতরাং, আমরা জানতে পারলাম কেন এই সময়টাতে উত্তর ভারত মহাসাগরের দুই সমুদ্রে এতো বেশি ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। শীত-গ্রীষ্ম অন্তঃবর্তীকালীন মৌসুমে বায়ু অপেক্ষাকিত কম শক্তিশালী হয়ে থাকে। কম শক্তিশালী হলেও গ্রীষ্ম এবং শীত মৌসুম থেকে অপেক্ষাকিত অনেক বেশি স্থিতিশীল থাকে। অর্থাৎ, বাতাসের বেগ সমান থাকে, দিক একই থাকে, এবং একে অন্যের সমান্তরালে অবস্থান করে, খুব সহজেই দিক পরিবর্তন করে না। আর ঘূর্নীঝড় তৈরির জন্য এটিও আদর্শ পরিবেশ। এদের মাঝে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে তাপমাত্রার ব্যবধান। তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে থাকলেই ঘূর্নিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে, তার পূর্বে কোনো সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম পাড়ে কিছু জেট বায়ুর সৃষ্টি হয়ে থাকে এই মৌসুমে, যা ঘূর্ণিঝড়ের গতি ত্বরান্বিত করতে পারে। 

আরব সাগরে সৃষ্ট কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে নিচে উল্লেখ করা হলো, 

১। সাইক্লোন চাপালা­- ঘূর্ণিঝড় চাপালা, ইয়েমেনে ভূমিধ্বস হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। ৩ নভেম্বর, ২০১৫ সালে সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর এর গতি রেকর্ড করে ২১৫ কিমি/ঘন্টা (তথ্যসূত্রঃ Meteorological department of India)। আমেরিকান আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে এর গতিবেগ ছিল ২৪০ কিমি/ঘন্টা, যা চাপালাকে আরব সাগরের শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলোর একটিতে পরিনত করেছে। ঐসময় ঐ অঞ্চলের পানির তাপমাত্রা ছিল ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, আর বায়ুচাপ হঠাৎ করেই নেমে যায়। ঘূর্ণিঝড় চাপালার কারণে ইয়েমেন, সোমালিয়া, সোকট্রায় প্রায় $ ৩,০০০,০০০ ‘র ক্ষয়ক্ষতি হয়।

২। সাইক্লোন মেঘ- ঘূর্ণিঝড় ‘মেঘ’ ইয়েমেনী দ্বীপ সোকট্রার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এযাবৎ কালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি ছিল। এটি ৫ নভেম্বর, ২০১৫ সালে পূর্ব আরব সাগরে তৈরি হয়। এটি আরব সাগরের উত্তরে প্রসারিত হওয়ার সময় ঘূর্ণিঝড় চাপালার পথ অনুসরণ করে। ঐসময় পশ্চিম আরব সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা উত্তর-পূর্ব দিক থেকে অনেক বেশি থাকায় ঘূর্নিঝড়টি সেই দিকে মোড় নেয় এবং সোকট্রায় আঘাত হানে। ৭ নভেম্বরের দিকে ঘূর্ণিঝড়টি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের বেগ ছিল ১৭৫ কিমি/ঘন্টা, যা প্রায় ৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয় (তথ্যসূত্রঃ Meteorological department of India)। আমেরিকান আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, তা ১ মিনিট পর্যন্ত ২০৫ কিমি/ঘন্টায় পৌছায় (তথ্যসূত্রঃ Joint Typhoon Warning center, United States of America)।

১০ নভেম্বরের দিকে ইয়ামেনের কাছাকাছি পৌছালে ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সোকট্রায় ৫০০ বাড়িঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, ৩০০০ থেকেও বেশি ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে, ৭৯০ এর বেশি মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়ে যায়, পুরো দ্বীপে বিদ্যুৎ চলে যায় আর ১৮ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এই ঘুর্ণিঝড়। (তথ্যসূত্রঃ Yemen: Cyclones Chapala and Megh Flash Update 8)

৩। সাইক্লোন গোনু- ঘূর্ণিঝড় গোনু ১ জুন, ২০০৭ সালে পূর্ব আরব সাগরে তৈরি হয়। এর তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ ছিল আরব সাগরের পানির উপরিভাগের উচ্চ তাপমাত্রা এবং বাতাসের দিকের পরিবর্তন অনেক প্রাভাব ফেলেছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল ওমান এবং আরাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ গুলিতে। এতে ওমানে ভূমি ধ্বসের মতো ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে প্রায় ৬৮০ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় (যা বাকিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ)। এর স্থায়িত্ব ছিল ৮ জুন, ২০১৫ পর্যন্ত। এর মাঝে শুধুমাত্র ওমানে ৫০-৫২ জন মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ৪.২ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। (তথ্যসূত্রঃ Report on Cyclonic Disturbances over North Indian Ocean during 2007)

এখন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো,

১। বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন ১৮৭৬- ১৮৭৬ সালের ২৯ অক্টোবার, বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের মেঘনা নদীর আশপাশের এলাকায় আঘাত হানে এই ঘূর্ণিঝড়। এটি ১ নভেম্বর ১৮৭৬ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর সর্বোচ্চ গতি ছিল ২২০ কিমি/ঘন্টা। এই ঝড়ে প্রায় ২ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৩-১৩.৪ মিটার পর্যন্ত ছিল।  (তথ্যসূত্রঃ SAARC Meteorological Research Center (SMRC),1998)

২। ভোলা সাইক্লোন- ভোলা সাইক্লোন পশ্চিম বঙ্গ এবং পূর্ব বঙ্গের (বাংলাদেশ) ইতিহাসের প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি। ১৯৭০ সালের নভেম্বর ৩-১৩ পর্যন্ত এটি স্থায়ী হয়। বাতাসের গতি ১৮৫ কিমি/ঘন্টা ছিল। সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২৪০ কিমি/ঘন্টা। সাইক্লোনটি মধ্য বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয় এবং সরাসরি কলকাতা এবং দক্ষিণ বঙ্গের দিকে অগ্রসর হয়। সামুদ্রিক জ্বলোচ্ছাস সমুদ্র তীরবর্তী জায়গাগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। অনেকগুলো গ্রাম, ফসল নষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র তাজুমুদ্দিন উপজেলায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষ মারা যায় আর মোট মৃত্যুর পরিমাণ ৩ লক্ষ ২০ হাজারেরও বেশি। আর সর্বোমোট এতে প্রায় ৮৬ মিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। (তথ্যসূত্রঃ East Bengal cyclone of November, 1970)

৩। উড়িষ্যা সাইক্লোন- ১৯৯৯ সালের ২৫ অক্টোবরে উড়িষ্যা ঘূর্ণিঝড়টি আন্দামান সাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের নিম্নচাপে তৈরি হয়েছিল, যদিও এর সূত্রপাত চার দিন আগে সুলু সাগরের একটি অঞ্চলে পাওয়া যায়। ঠিক তার পরের দিন ঝড়টি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিনত হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। ২৮ অক্টোবার এর গতিবেগ ছিল ২৬০ কিমি/ঘন্টা। আর এটি দুর্বল হতে শুরু করে ৪ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে, যদিও তখনো প্রচুর জ্বলোচ্ছাস ছিল সমুদ্র সৈকতগুলোতে। এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি হয় ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা দেখা দেয়, ১.৬ মিলিয়ন বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়, শষ্যক্ষেত গুলোও নষ্ট হয়ে যায়, আর ৮ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ যায়। এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪.৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (তথ্যসূত্রঃ “Orissa Super Cyclone Situation Report 9)

৪। সাইক্লোন ভারদাহ- পূর্ব ভারতের ইতিহাসে কয়েকটি প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে এটিই সবার উপরে। ডিসেম্বর ৬, ২০১৬ তে শুরু হওয়া এই ঘূর্ণিঝড় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের নিম্ন চাপে তৈরি হয়। ঝড়টির বাতাসের গতিবেগ ১৩১ কিমি/ঘন্টা ছিল এবং সর্বোচ্চ গতিবেগ ১৫৫ কিমি/ঘন্টা ছিল। ডিসেম্বর ৯, ঝড়টি ভারতের তামিল নাডু, আন্ড্রা প্রদেশে আঘাত হানে। এটি তামিল নাডু এবং চেন্নাইয়ের উপর দিয়ে পার হয়ে আরব সাগর দিয়ে পশ্চিমের সোমালিয়ায় আঘাত হানে ডিসেম্বর ১৭ তে। তার মাঝে আরব সাগরে প্রবেশ করে ১৪ ডিসেম্বর সকালে। সোমালিয়ায় পৌছানোর পর এটি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬। ঘূর্ণিঝড়টির কারণে থাইল্যান্ডে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয় এবং ২১ জন মানুষের প্রাণ যায় (তথ্যসূত্রঃ Global Catastrophe Recap December 2016)। ভারতের তামিল নাডুতে ২৪ জন মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ৩.৩৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। সকল ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায় আর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের বাড়ীঘর হারায়। (তথ্যসূত্রঃ Tamil Nadu estimates cyclone damage at Rs 22,573 crore)

৫। সাইক্লোন সিডর- বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়গুলোর একটি হচ্ছে সিডর। ১১ নভেম্বর, ২০০৭ এ মধ্য বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া এই ঝড়টি ১৬ নভেম্বর ২০০৭ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। রেড ক্রিসেন্ট এর মতে, প্রায় ৩০০০-১০,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এই ঝড়ে আর কারোর মতে তা ১৫,০০০ ছাড়িয়েছিল (তথ্যসূত্রঃ রেড ক্রিসেণ্ট সোসাইটির আশঙ্কা: ঘূর্ণিঝড়ে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে”-Prothom Alo )। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২.৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঘূর্ণিঝড়টির গতিবেগ ছিল ২১৫ কিমি/ঘন্টা এবং সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২৬০ কিমি/ঘন্টা। (তথ্যসূত্রঃ CYCLONE SIDR OF 15 NOVEMBER 2007 IN BANGLADESH – Dr. George Pararas-Carayannis) 

৬। সাইক্লোন আম্ফান- সাইক্লোন আম্ফান এখন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল। এটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম যা পশ্চিম বঙ্গ, পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশে মে মাসে আঘাত হানে। ২০০৭ সালের সিডর এবং ১৯৯৯ সালের উড়িষ্যা সাইক্লোনের পর এটিই সবচেয়ে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিজ্ঞানীদের নিকট বিবেচিত হয়েছে। ১৩ মে, ২০২০, আম্ফান কলোম্বো, শ্রীলংকা থেকে ৩০০ কিমি পূর্ব দিকের নিম্ন চাপ অঞ্চলে তৈরি হতে শুরু করে। বঙ্গোপসাগরের উপরিভাগের তাপমাত্রার (৩০º সেলসিয়াস) উপর নির্ভর করে সেই পথ অনুসরণ করেই উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয় (তথ্যসূত্রঃ )। ১৫ মে, ঘূর্ণিঝড়টি আরো ঘনীভূত হতে থাকে এবং ভূমির দিকে এগিয়ে যায়। ১৭ মে, ২০২০ ঘূর্ণিঝড়টি অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে উঠে। ২০ মে তে ঘূর্ণিঝড়টি যখন আঘাত হানে তখন তার গতিবেগ ছিল ২৪০ কিমি/ঘন্টা। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ রেকর্ড করা হয় ২৬০ কিমি/ঘন্টা। ভূমির উপর দিয়ে পার হওয়ার সময় সাইক্লোনটির গতিবেগ ছিল ১৫৫ কিমি/ঘন্টা। ২১ মে, ২০২০, ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে যায়।  পশ্চিম বঙ্গের সমুদ্র তীরবর্তি অঞ্চল, কলকাতা, হুগলী, উড়িষ্যা, বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, মেহেরপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই মৎসখাতের ২৫.৭ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় (তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউট)। ১৭৬,০০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয় (তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট)।(তথ্যসূত্রঃ Bangladesh alerts maritime ports as Cyclone Amphan intensifies)

এটুকু সুনিশ্চিত যে আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়গুলো অনেক বেশি মারাত্মক ছিল এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ছিল অনেক বেশি। এর আরেকটি কারণ দাঁড় করানো যায়, বঙ্গোপসাগরের গড় তাপমাত্রা আরব সাগর থেকে বেশি।

এখন ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি সময়গুলোও অনেক প্রয়োজনীয় সকলের জন্য। কারণ ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি সময়ে সাগরের অনেক ধরণের পরিবর্তন ঘটে। যেমন,

  • নিম্ন ভাগের পানি ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সাগরের উপরিভাগে চলে আশে (কম তাপমাত্রা যুক্ত পানি)
  • তাপমাত্রা তুলনামূলক কম থাকে
  • দুই স্তরের পানির মধ্যে মিশ্রণ হয়
  • পানির দুই স্তরের মধ্যবর্তী স্তরটি (ব্যারিয়ার লেয়ার) ভেঙে যায়, আর ফাইটোপ্লাংক্টনগুলো খাদ্য পায়
  • কার্বন নিঃসৃত হয় (সমুদ্র থেকে)
  • মাছ এবং অন্যান্য জীবের জন্য আদর্শ পরিবেশের সৃষ্টি হয়

আজ এই পর্যন্তই। আগামী পর্বে ইনশাআল্লাহ আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের জীব বৈচিত্রগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এবং এটাও আলোচনা করবো যে কেন আরব সাগরে উপরিভাগে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় আর বঙ্গোপসাগর কেন দিনে দিনে মৃত হয়ে যাচ্ছে।

Comments are closed.