১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তৃতীয় পর্বের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটবে “আরব সাগর বনাম বঙ্গোপসাগর” সিরিজের। পূর্বের পর্বে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি সময়গুলোর কিছু প্রভাব উল্লেখ করেছিলাম। যেগুলো ছিলো,
- নিম্ন ভাগের পানি ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সাগরের উপরিভাগে চলে আশে (কম তাপমাত্রা যুক্ত পানি)
- তাপমাত্রা তুলনামূলক কম থাকে
- দুই স্তরের পানির মধ্যে মিশ্রণ হয়
- পানির দুই স্তরের মধ্যবর্তী স্তরটি (ব্যারিয়ার লেয়ার) ভেঙে যায়, আর ফাইটোপ্লাংক্টনগুলো খাদ্য পায়
- কার্বন নিঃসৃত হয় (সমুদ্র থেকে)
- মাছ এবং অন্যান্য জীবের জন্য আদর্শ পরিবেশের সৃষ্টি হয়
উপরে উল্লেখিত প্রত্যেকটি বিষয় ঘূর্ণিঝড়ের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে। যদিও তা সবসময় ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েই আমাদের মাঝে হাজির হয়ে থাকে। আর যাই হোক, এই দুই সমুদ্রে অবস্থানরত সকল জীবের জন্য কিছু আদর্শ পরিবেশের প্রয়োজন পড়ে। আর সেই সকল জীবের উপর নির্ভর করেই মৎসজীবিরা তাদের জীবিকা অর্জন করে থাকে। আর সেই সাথে একটি দেশের অর্থনীতির চাকাও পরিচালিত হতে পারে। এমন অনেক দেশ আছে যারা শুধুমাত্র সমুদ্রের মাছের উপর নির্ভর করে এখনো তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। কয়েকটি প্রশ্নের জবাবের প্রেক্ষিতে আমরা কিছু জিনিস জেনে নিতে পারি।
আরব সাগরে বঙ্গোপসাগরের তুলানায় বেশি মাছ পাওয়া যায় কেন?
সাধারনত বিজ্ঞানীরা ফাইটোপ্লাংক্টনের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে সমুদ্রের বিভিন্ন এলাকায় জীবের অবস্থা, বাসস্থান, খাদ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি তুলে ধরেন। তাদের মতামত অনুযায়ী,
– যেখানে পানি বেশি পরিষ্কার থাকবে,
– সূর্যের আলো বেশ দূর পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারবে (সমুদ্রের ভিতর),
– ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমাণ বেশি থাকবে,
– দুইটি স্তরের পানির মিশ্রণ যত ভালো হবে,
– খাদ্যের পরিমাণ যথেষ্ট থাকবে, সেই সকল যায়গায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি বেশি পরিমাণে থাকবে।

এখন স্যাটেলাইট থেকে যখন আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের উপরিভাগের (৫ মিটার গভীর) ছবি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন লক্ষ্য করা যায় যে বঙ্গোপসাগরের তুলনায় আরব সাগরে ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমাণ অনেক বেশি। ছবিতে দেখা হয় যে কোন জায়গায় ক্লোরোফিলের ঘনত্ব কত। তার থেকেই ফাইটোপ্লাংক্টনের ঘনমাত্রা নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

বঙ্গোপসাগরে গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হওয়ার কারণে পশ্চিমে ভারত, উত্তরে বাংলাদেশ এবং পূর্বে মায়ানমারের নদীগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে স্বাদু পানি সমুদ্রে মুক্ত হয়। ফলে তা সাগরের লবণাক্ততার ঘনমাত্রা পরিবর্তন করে দেয়। এই পরিবর্তন ০-৩০ পিপিটি পর্যন্ত হতে পারে। আরব সাগরে গ্রীষ্ম মৌসুমে বৃষ্টিপাত হলেও তার প্রভাব খুব কম থাকে। কারণ, বঙ্গোপসাগরের মতো আরব সাগরে বড় নদী খুব কম মিশেছে। একটি মাত্র বড় নদী, ইন্দুস নদী, যা পাকিস্তানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে মিশেছে। এতে করে আরব সাগরের লবনাক্ততার ঘনমাত্রার তেমন পরিবর্ত্ন হয় না (৩৪.৫-৩৫.৫ পিপিটি)।
আবার প্রচুর পরিমাণ পানির প্রবাহের সাথে বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন নদীর মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে পলি মাটি এসে পড়ে। যার জন্য উত্তর বঙ্গোপসাগর সম্পূর্নভাগ এবং মধ্য বঙ্গোপসাগরের কিছু জায়গার পানি ঘোলাটে থাকে। যার জন্য সূর্যের আলো পানির বেশি গভীর পর্যন্ত যেতে পারে না। তাই ফাইটোপ্লাংক্টনের জন্মাতে পারে না। এতে অন্যান্য জীবের ক্ষতি হয়। তাছাড়া এসকল পরিবেশে প্রবাল জন্মাতে পারে না। প্রবাল প্রাচীর একটি ইকোসিস্টেম কতটুকু ভালো বা খারাপ তার নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে। আর এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ইকোসিস্টেমগুলোর একটি। আরব সাগরের পানি মোটামুটি কম ঘোলাটে হয়।

পানির দুইটি স্তরের মধ্যে মিশ্রণের প্রয়োজন রয়েছে যা “আপ-ওয়েলিং” এবং “ডাউন-ওয়েলিং” এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। এতে করে খনিজ পদার্থ, পরিপোষক পদার্থ সমূহ সম্পূর্ণ পানিতে মিশে যেতে পারে। বঙ্গোপসাগরে পানির মধ্যে (০-১৫ মিটারের মধ্যে) ব্যারিয়ার স্তর বিদ্যমান থাকায় পানির মিশ্রণ কষ্ট সাধ্য। আরব সাগরের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। কারণ ব্যারিয়ার স্তর তৈরি করতে প্রচুর স্বাদু পানির প্রয়োজন যা বঙ্গোপসাগরে পাওয়া সম্ভব।
এসকল কারণেই বঙ্গোপসাগরে আরব সাগরের তুলনায় কম মাছ ধরা পরে। (তথ্যসূত্রঃ Why Bay of Bengal is less productive during summer monsoon compared to the Arabian Sea?- Dr. Prasanna)
বঙ্গোপসাগর কেন “ডেড জোনে” পরিণত হচ্ছে?
এতো দিনে অনেকেই হয়ত জেনে গিয়েছেন বা জনতে পারবেন যে বঙ্গোপসাগরের অনেক জায়গায় (বিশেষ করে উত্তর বঙ্গোপসাগর) “ডেড জোনের” আওতায় চলে আসছে। ডেড জোন কি?
যেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ খুবিই কম এবং জীব জগতের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যায়, সেসকল জায়গাকে “ডেড জোন” বলা হয়। একে আবার ওএমজেড (OMZ) ও বলা হয়ে থাকে। এমনকি, আরব সাগরেও ওএমজেড (OMZ) এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে অনেক ধরণের মাছের প্রজাতি ঐ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যেমন আরব সাগরে এখন পূর্বের ন্যায় তিমি খুবই কম দেখা যায়। এর অন্যান্য কারণ থাকলেও ওএমজেড (OMZ) একটি বড় কারণ।

এখন ওএমজেদ (OMZ) এর ফলে যে যে সমস্যাগুলো ভবিষতে হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা তা হচ্ছে,
- মাছের খাদ্য কমে যাওয়া
- অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া
- পানির গুণাগুণ নষ্ট হওয়া
- জেলেদের বেকারত্ব এবং একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতিক সমস্যা দেখা দিতে পারে
ঐদিক বিবেচনা করলে বঙ্গোপসাগরও বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। (তথ্যসূত্রঃ Dr. Prasanna- OMZ in the Bay of Bengal)
আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের পানি কি একসাথে মিশ্রিত হয়?
আপনি একটি বড় গামলা নিলেন। আর তার মাঝে কিছু একটা দিয়ে দেয়াল তৈরি করে দেন যাতে পানি এপাড় থেকে অপাড়ে না যেতে পারে। কিন্তু নিচের দিকের কিছু অংশ খোলা রাখবেন প্রয়োজনের স্বার্থে। আপনি হাত দিয়ে পানিতে বল প্রয়োগ করলে পানি ঐ খোলা জায়গা দিয়ে কিছুটা হলেও অপর পার্শ্বে প্রবেশ করবেই। এখন আপনি যখন যেদিকে বল প্রয়োগ করবেন, তার বিপরীতে পানি প্রবেশ করবে।

একইভাবে, গ্রীষ্ম মৌসুমে দক্ষিণ-পশ্চিম ট্রেড বায়ুর (trade winds) প্রভাবে আরব সাগরের পানি বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে (কিছুটা)। আবার শীত মৌসুমে উত্তর-পূর্ব ট্রেড বায়ুর প্রভাবে (Trade winds) বঙ্গোপসাগরের পানি আরবসাগরে প্রবেশ করে (কিছুটা)। আপনি কিভাবে বুঝবেন যে পানির আদানপ্রদান ঘটেছে?
দুই সমুদ্রের পানির প্রায় নির্দিষ্ট লবণাক্ততা রয়েছে। তাই যখনি পানি মিশ্রিত হবে বা প্রবেশ করবে তখন লবনাক্ততার পরিমাণ/গ্রাফ পরিবর্তিত হবে। তাছাড়া স্যাটেলাইট ইমেজিং এর মাধ্যমেও দেখা যায় (ক্লোরোফিলের ঘনমাত্রার উপর নির্ভর করে)। এর অনেকগুলো সুবিধা রেয়েছে। (তথ্যসূত্রঃ Wind circulation of the basin- Dr. Prasanna Kumar)
জীব বৈচিত্রের দিক থেকে কোনটির মধ্যে অনেক বৈচিত্রতা দেখা যায়?
বৈচিত্রময় এই পৃথিবীতে বৈচিত্রময় প্রাণীর বসবাস। আর সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র দেখা যায় সমুদ্রের অতল গভীরে। ছোট-খাটো সমুদ্র শৈবাল থেকে শুরু করে বড় বড় প্রবাল প্রাচীর পর্যন্ত, ছোট জুয়োপ্লাংক্টন থেকে বড় তিমি, সবই এই প্রকৃতির সৌন্দর্য। সকলেই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। যার জন্যই সমুদ্রে বিরাজ করে এক সুস্থ জীবন ব্যবস্থা।
এইদিক থেকে আরব সাগর কিংবা বঙ্গোপসাগর, কেউই কারোর থেকে কম নয়। যদি তুলনা করতে যাই তবে অনেক রকমের মিল অমিল পাওয়া যাবেই।
আরব সাগরে,
- ৩০০ প্রজাতির প্রবাল
- ৫০০ প্রজাতির মোলাস্কান প্রাণী
- ২০০ প্রজাতির কাঁকড়া
- ১২০০ ‘র বেশি প্রজাতির মাছ
- ২০ প্রজাতির ম্যামালিয়ান প্রাণী
- ৭ প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ
- ২ প্রজাতির তিমি
- ৬৮ প্রজাতির হাঙ্গর আছে
- ৩ প্রজাতির টুনা মাছ

আরাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, ওমান, লোহিত সাগর, আরব আমিরাত, ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে প্রবাল প্রাচীর দেখা যায়।

আরব আমিরাতে শুধুমাত্র প্রবাল প্রাচীরের উপর ভিত্তি করে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে থাকে। তাছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া, ঝিনুক, মাছ বিক্রি করে আরবিয়ান উপদ্বীপের বাসিন্দারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। তাছাড়া রয়েছে ৮৬ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল। (তথ্যসূত্রঃ Oceana- Fisheries in the Arabian sea)
বঙ্গোপসাগরে,
- ৪৭৫ প্রজাতির মাছ,
- ২০০ প্রজাতির প্রবাল,
- ৯৭ প্রজাতির কাঁকড়া,
- ১১ প্রজাতির হাঙ্গর,
- ১৬ প্রজাতির রে
- ৮ প্রজাতির ডলফিন
- ৭ প্রজাতির ব্যালেন তিমি, ১৬ প্রজাতির দন্তযুক্ত তিমি
- ৫ প্রজাতির কচ্ছপ
- ৭ প্রজাতির টুনা
- ১৫৫ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল আছে

বঙ্গোপসাগরে আরেকটি বিশেষ মাছ পাওয়া যায় যা এই পুরো অঞ্চলে বিখ্যাত, ইলিশ মাছ। নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ উৎপাদন হয়। তার মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ এবং ভারতের কলকাতা।

তাছাড়া রয়েছে “ইয়েল্লো ফিন টুনা”, “আলবাকোর টুনা”, “স্কিপজ্যাক টুনা”, যা বঙ্গোপসাগরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতগুলো কচ্ছপের বাসস্থানের জন্য উপযুক্ত। (তথ্যসূত্রঃ FAO, 2012)
আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের বর্তমান অবস্থা
পরিবেশের দিক থেকে যদি বিশ্লেষন করা হয় তবে দেখা যাবে এখন পর্যন্ত দুই সাগরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নদী-নালার মাধ্যমে শুধু যে পানি এবং পলল মাটি প্রবাহিত হয় তা নয়। এর সাথে থাকে ভূমির উপরে থাকা বর্জ্য পদার্থ, প্লাস্টিক, রাসায়নিক ইত্যাদি। ভারত এবং বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প থাকায় তার বর্জ পদার্থগুলো সরাসরি সমুদ্রেই মিশছে। এতে করে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত প্রায় এবং অনেকেই হয়ত এখন নেই। তাছাড়া প্রতি বছর ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে যে পরিমাণে তেলের জাহাজ ডুবি হয়, তাতে মোহনা অঞ্চলেরও প্রচুর ক্ষতি সাধন হয়।

বৈশ্বিক তাপমাত্রার পরিবর্তন কিন্তু আরব সাগরের উপর অনেক প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া মাছ ধরার নৌকার কারণে, জালে আটকা পড়ায় প্রচুর পরিমাণে ডলফিন, কচ্ছপ, তিমি মারা যাচ্ছে। যার পরিমাণ প্রতি বছর গড়ে ১১৭ টি ডলফিন, ১০০+ কচ্ছপ শুধুমাত্র বঙ্গোপসাগরে। আরব সাগরে বর্তমানে তিমির আনাগোনা কমে গিয়েছে। মাত্র ২ প্রজাতির তিমি দেখা যায়। (তথ্যসূত্রঃ IUCN Bangladesh, 2019)
এসবের মধ্যে আমাদের কোনো না কোনোভাবে ভুলত্রুটি রয়েছে, যা আমরা বুঝতে পারছি। পৃথিবীর প্রায় ৫০-৬০% অক্সিজেন সাগর মহাসাগর থেকেই আসে। আর আমরা তাদেরকেই অবহেলার চোখে দেখি। একটি ইকোসিস্টেম যদি নষ্ট হয়, তবে তা পরবর্তি ইকোসিস্টেমগুলোকে নষ্ট করবেই।
তাই আসুন, সকলেই সচেতন হই। নিজের দেশ এবং সমুদ্রের প্রতি যত্ন নিই।
আল্লাহ হাফেজ