সাধারণত, আমদের সমাজে অধিকাংশেই এক ধরণের মিথ প্রচলিত আছে যে বিভিন্ন ট্রান্সজেনিক শস্য অথবা জীবকে খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করা যাবে না। কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, এসব জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যের সাথে বিভিন্ন রকমের অজানা ঝুঁকি জড়িয়ে আছে। তবে, ট্রান্সজেনিক খাদ্যের প্রতি এই অনীহা বিদায় নিয়েছে যখন প্রযুক্তি এর সাথে কিছু সুস্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ সুফল যোগ করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ডায়াবেটিকের রোগী ট্রান্সজেনিক ব্যাকটেরিয়া হতে উৎপন্ন ইন্সুলিনই গ্রহণ করেন। উৎস সম্পর্কে জানার পরও তিনি তা গ্রহণ করা কখনই বন্ধ করবেন না। বরং প্রায় ৩৫ বছর (প্রায় দুই প্রজন্ম) ধরে কেবলমাত্র এই ট্রান্সজেনিক ইন্সুলিনই ডায়াবেটিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও মানব স্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখনও অজানা। এই ঔষধের গুণ হচ্ছে, এর তাৎক্ষণিক প্রভাব অনেক বেশি কার্যকরী। অর্থাৎ আগে থেকে কোনো প্রকার উপশমের ব্যবস্থা না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। যেকোনো রোগের উপশম বা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আগে থেকেই যে ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে, তা ‘পূর্ব সতর্কতামূলক নীতি’-র আওতাধীন।
উপরের উদাহরণটির মত এই যুক্তিটি আমদের গৃহীত অন্যান্য সকল জৈব অথবা কৃত্রিম উৎসের ঔষধের জন্যেও একইভাবে প্রযোজ্য। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কিছু বিজ্ঞানীও এই ট্রান্সজেনিক শব্দ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রযুক্তির প্রতি এক প্রকার বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, যা আসলেই ব্যাখ্যাতীত। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ মতামত এবং পছন্দ প্রকাশের অধিকার রয়েছে। তবে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যখন আমরা আমাদের মতামত দেই, তখন সেখানে নিজস্ব বিশ্বাস এবং পছন্দ প্রাধান্য পায় না। তা হতে হয় একান্তই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আহরিত কোনো প্রমাণ, যা যেকোনো প্রকার নীতি ও বৈষয়িক প্রভাবমুক্ত।
আমরা আবার আমাদের আগের আলোচনায় ফিরে আসি। বর্তমানে এমন কোনো খাদ্য নেই যা মানবজাতির কৃত্রিম নির্বাচনের দ্বারা জিনগত ভাবে পরিবর্তিত হয় নি। এটি কোনো হাইপোথিসিস বা অনুকল্প নয়, বরং বাস্তব। কার্যতঃ আমরা বাজার থেকে কখনই কোনো খাদ্যের একদম প্রাকৃতিক বা ওয়াইল্ড টাইপ কিনে আনি না (ব্যতিক্রম কিছু প্রজাতির মাছ ও ফলের ক্ষেত্রে)। এই বাস্তবতা থেকে আমরা একটা উপসংহারে আসতে পারি: বিগত প্রায় দশ হাজার বছরে মানবজাতি তার খাদ্য হিসেবে গৃহীত, রোপিত, পালিত প্রায় সবকিছুরই পরিবর্তন সাধন করেছে। এবং আমাদের গৃহীত অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্যই কোনো না কোনো ভাবে জিনগত উন্নতি লাভ করেছে, হোক সেটা সরাসরি নিষিক্তকরণে অথবা কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে। অনেকেই দাবি করেন যে আমরা নাকি শুধুমাত্র প্রকৃতিগত প্রাপ্ত বস্তুকেই বেছে নিয়েছি! তারা আসলে ভুলে যাচ্ছেন যে, আমাদের বহুসংখ্যক শাকসবজিই ১৯৫০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে কোনো রাসায়নিক অথবা রেডিওএক্টিভ রশ্মি দ্বারা জেনেটিকভাবেই পরিবর্তিত। হ্যাঁ, পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পদ্ধতি ন্যূনতম প্রতিবন্ধকতার সাথেই চর্চিত হয়ে আসছে।
অতএব, বাস্তবিক অর্থে আমরা যা কিছুই খাই না কেন তার প্রায় সবকিছুই যে মানুষের দ্বারা পরিবর্তিত, এই সত্যকে মেনে নিলে ট্রান্সজেনিক খাদ্যের প্রতি অনুৎসাহের যুক্তি কিছুটা হলেও দূর্বল হয়ে পড়ে। যদিও অনেকে এখনও বলেন যে এই খাদ্যগুলো প্রাকৃতিক না হওয়ায় এরা অনেক সম্ভাব্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এটা কোনো উপযুক্ত আদালত নয় যেখানে আমরা “অপ্রাকৃতিক” প্রযুক্তির, যা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে তার দোষ নিয়ে বিচার করব। এমনকি এর দীর্ঘমেয়াদী (হতে পারে তা দুই অথবা কয়েক প্রজন্ম) ক্ষতির সম্ভাবনা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। যে কোনো অবস্থাতেই আমরা এদের ব্যবহার করছি। যা পূর্ব সতর্কতামূলক নীতির মত ব্যবহারিক দিকগুলোর প্রতি নিজেই প্রশ্ন তোলে। তবুও এটি ইতোমধ্যেই একটি পুরনো আলোচনা হয়ে গিয়েছে যার মধ্যে এখন আর কোনো নতুনত্ব নেই। তাই আমরা এখানে নতুন কিছু প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নতুন করে প্রমাণের প্রত্যয় নিয়েছি।
২০০১ সালে মানব জিনের সম্পূর্ণ সিকুয়েন্সিং সম্পন্ন হয়। এরপরের প্রায় ১৬ বছর ধরে আমরা ডিএনএ সিকুয়েন্সিং প্রযুক্তিতে কিছু অভিভূত সাফল্য দেখেছি। এই সাফল্য পরবর্তীতে এক বিশাল সংখ্যক প্রজাতির জিনোম সিকুয়েন্সিঙে সফলতার দিকে আমাদের ধাবিত করেছে। ডিএনএ –সিকুয়েন্সিং প্রযুক্তির এই বিস্ময়কর অগ্রগতি আমাদের সামনে জিনোমের গঠন ও এর বিবর্তনের অনেক অজানা দুয়ার খুলে দিয়েছে।
[চলবে…]
তথ্যসূত্র: omicsonline.org
One Comment
আমরা সবাই কী ট্রান্সন্সজেনিক? পর্ব -০২ | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] আমরা সবাই কী ট্রান্সজেনিক? পর্ব-১ […]