এরিয়া ফিফটি ওয়ান রহস্যের সাথে ড. ড্যান বারিশ নামের আরো একজন মানুষের নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।
মনঃস্তত্ত্ব এবং জীববিদ্যার গবেষক ডক্টর বারিশ সবচেয়ে কম বয়সে লস এঞ্জেলস মাইক্রোস্কোপিক সোসাইটির সদস্য পদ পান। ১৯৯০ সালে “অপারেশন ডেজার্ট স্ট্রোম” চলাকালে একজন বায়ো-ওয়েপন বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ডক্টর ড্যান বারিশকে।
সে সময় ইরাকী সেনারা মার্কিন এবং যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে বায়োলজিকাল ওয়েপন ব্যাবহার করছিল বলে জানা যায়। ১৯৯৪ সালে বারিশ এরিয়া ফিফটি ওয়ানে “একোয়ারিস” নামের একটি প্রজেক্টে কাজ করার আমন্ত্রণ পান। লাস ভেগাস থেকে বিমান যোগে এরিয়া ফিফটি ওয়ানে ল্যান্ড করার পর তাঁকে মাটির নিচে বিশাল একটি ফ্যাসেলিটি তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটির নাম S4 ফ্যাসেলিটি। যেখানে বব লেজারডও একসময় কাজ করেছেন বলে দাবী করা হয়।
এস ফোর ফ্যাসেলিটিতে ঢোকার আগে বেশ কয়েক স্তরে নানা ভাবে তাঁকে তল্লাশী করা হয়েছিল যাতে তিনি কোনো রেকর্ডিং ডিভাইস সাথে করে নিয়ে যেতে না পারেন। তিনি দাবী করেন এস ফোরে প্রবেশের পরে শুধু এলিয়েন প্রযুক্তিই নয় অনেক এলিয়েনেরও দেখা পান তিনি। যাদের মধ্যে একজনের নাম “J-ROD”. প্রজেক্ট একোয়ারিসের অধীনে বারিশ এবং জে-রড সেখানে “এলিয়েন ভাইরাস” ক্লোনিং নিয়ে গবেষণা করতেন।
বারিশের মতে জে-রড আসলে পৃথিবীরই বাসিন্দা। তবে পঞ্চাশ হাজার বছর পরের পৃথিবী। এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর হাত থেকে বাঁচতে জে-রডরা সময় এবং কালের বাঁধা ডিংগিয়ে এ সময়ের পৃথিবীতে হাজির হয়েছে। ডক্টর বারিশ এবং এলিয়েনদের গবেষণা চলছিল মূলত ম্যাজেস্টিক টুয়েলভ নামক এক রহস্যময় সংগঠনের তত্ত্বাবধানে। বারিশ জানান কাজের এক পর্যায়ে জে-রড মারাত্নক অসুস্থ হয়ে পড়লে “স্টার গেইট” এর মতো এক ডিভাইসের সাহায্যে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
স্বাভাবিক ভাবেই ডক্টর বারিশের এ দাবীর পর তুমুল বিতর্কের ঝড় ওঠে। বব লেজারডের মতো বারিশের পরিচয়ের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। এবং তাঁর শিক্ষা গত যোগ্যতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। সেই সাথে অন্যান্য কন্সপিরেসী থিওরীর মতো বারিশের এই দাবীও স্রেফ ধাপ্পাবাজী বলে উড়িয়ে দেন গবেষকরা। এই দাবীর পর বারিশের ওপর শারীরিক হামলাও চালানো হয়। অনেকের ধারণা এই হামলারপেছনে আছে কুখ্যাত ম্যাজেস্টিক টুয়েলভ সংগঠনের হাত।
২০১৩ সালে ইউটিউবে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়। যেখানে এক বৃদ্ধ ব্যাক্তি দাবী করেন তিনি এক সময় CIA এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ওই ভিডিওতে তিনি স্বিকার করেন এরিয়া ফিফটি ওয়ানে UFO ছাড়াও এলিয়েনের মরদেহ দেখেছেন তিনি। যদিও বরাবরের মতোই তাঁর এই দাবীর সত্যতা যাচাই করার জন্য তেমন কনো প্রমাণই দেখাতে পারেন নি তিনি। অবশ্য এরিয়া ফিফটি ওয়ানে এলিয়েন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে এর স্বপক্ষে দেখানোর মতো কোনো প্রমাণ বের করা শুধু দুঃসাধ্যই নয় এক কথায় অসম্ভবও বলা চলে।
কিন্তু ২০১৭ সালের মে মাসে “সিকিউরড টীম টেন” নামের একটি UFO হান্টিং টীম একটি ভিডিও ক্লীপ প্রকাশ করে। ফুটেজে একটি UFO কে এরিয়া ফিফটি ওয়ানের আকাশে উড়তে দেখা যায়। ১৯৮০-১৯৯০ এর দশকের কোন এক সময় বেইসেরই একজন কর্মকর্তা ওই ভিডিও টি ধারণ করেছিলেন। সিকিউরড টীম টেন দাবী করে , ফুটেজটি তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে, এরিয়া ফিফটি ওয়ানে এলিয়েন প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণা চালানো হয়।
২০১২ সালে এই বেইজের আরো একটি অদ্ভুত ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল। এক দম্পত্তি এরিয়া ফিফটি ওয়ানের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় আকাশে বিচিত্র ধোঁয়ার মেঘ দেখতে পান। যা এরিয়া ফিফটি ওয়ানের সীমানার ভেতর থেকেই উঠে আসছিল। কিন্তু তাদের দৃষ্টি সীমানায় একটি টিলা থাকায় কিভাবে ওই ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছিলো তা জানা সম্ভব হচ্ছিলো না। এমনকি ওই টিলার চুড়ায় গাড়ি নিয়ে প্রহরীও প্রস্তুত ছিল যাতে কেউ কাছে যেতে না পারে। ২০১২ সালে ভিডিও টি ধারণ করা হলেও ওই দম্পত্তি ভিডিওটি প্রকাশ করেন ২০১৬ সালে।
এরিয়া ফিফটি ওয়ানে এলিয়েন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার বিষয়ের কিছু মাত্রও যদি সত্য হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আরো এরকম গোপন বেইস থাকার সম্ভাবনা আছে কিনা তাও নিশ্চয়ই ভাববার বিষয়।
এরিয়া ফিফটি ওয়ানের ৭০ মেইল দূরে রয়েছে “টোনোপা টেস্ট রেঞ্জ” নামের আরো একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত জায়গা। জানা যায় ইজরায়েলের ধার দেয়া মিগ বা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবিত F170 যুদ্ধ বিমানের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল এখানেই। তবে অনেকেই মনে করেন এখানেও এলিয়েন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চালানো হয়েছে। অন্যান্য দেশেও এরিয়া ফিফটি য়য়ানের মতো গোপন ফ্যাসিলিটি থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
১৯৭৪ সালে উত্তর ওয়েলসের বেরুইন পর্বতে একটি এলিয়েন মহাকাশ যান ভূপাতিত হয়েছিল বলে দাবী করেন অনেকে। UFO বিশ্বাসীদের মতে সেখান থেক উদ্ধার করা UFO টি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের গোপন ফ্যাসেলিটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের ২৯ জানুয়ারী পূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের ডালনিগটস শহরের কাছে একটি পাহাড়ে একটি এলিয়েন মহাকাশ যান ভূপাতিত হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। এই ঘটনাটি “হাইট সিক্স ইলেভেন” UFO ইনিসিডেন্ট নামে পরিচিত। আবার অনেকে একে রাশিয়ার রজওয়েল হিসেবেও নামকরণ করেছে।
UFO বিশ্বাসীদের মতে এই ঘটনায় উদ্ধার করা মহাকাশ যান এবং এলিয়েনদের মরদেহ কাপুস্টিনিয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। বিভিন্ন সময়ে অনেকেই জানিয়েছেন কাপুস্টিনিয়ারের আকাশে UFO দেখার অনেক ঘটনাই তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন। অনেক ত্রিকোণাকার এয়ারক্রাফট ওই বেইসে ল্যান্ড করেছে বাঁ খাড়া ভাবে উড়ে গেছে বলেও দাবি করেছেন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। এরিয়া ফিফটি ওয়ানের মতো কাপুস্টিনিয়ারের ইতিহাসও অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে আড়াল করে রাখা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছর গুলোতে অনেক UFO বিশারদই দাবী করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসি বাহিনীরই এরিয়া ফিফটি ওয়ানের মতো গোপন বেইস ছিলো। পোল্যান্ডের ওয়েনসেসলস খনির কাছে একটি পরীক্ষাগারে “ডাই ব্লক” নামের বিশাল পেলব আকৃতির একটি অত্যাধুনিক একটি ডিভাইসের পরীক্ষা চালিয়েছিল বলে জানা যায়। তবে ডিভাইসটি ঠিক কী কাজে ব্যাবহার করা হতো তা পরিষ্কার নয়। অনেকে বিশ্বাস করেন এটি এন্টি গ্রাভিটি ডিভাইস। আবার অনেকের মতে গোপন বিধ্বংসী কোনো মারণাস্ত্র। এমনকি ডিভাইসটি পরীক্ষা করতে গিয়ে ৫ জন বিজ্ঞানীও মারা গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত দাবীটি হচ্ছে এই ডিভাইসের সাহায্যে অতীতের ছবি দেখা যেত।
তবে যাই হোক, এখানে প্রশ্ন থেকে যায় নাৎসি বিজ্ঞানীরা কিভাবে এই প্রযুক্তি পেয়েছিল। এর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে নাৎসি বিজ্ঞানীরা একদল এলিয়েনের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিল। যারা এই প্রযুক্তি তৈরীর প্রাথমিক উপকরণ নাৎসি বিজ্ঞানীদের সরবরাহ করেছিল। কিন্তু প্রজেক্ট টি শেষ করার আগেই যুদ্ধে পরাজিত হয় নাৎসি বাহিনী। অনেকের মতে এরপর ডাই ব্লক ডিভাইসটি ধ্বংস করে ফেলা হয়। আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন তা পাচার হয়ে যায় আমেরিকায়।
এটা স্বাভাবিক যে এরিয়া ফিফটি ওয়ানের মতো এমন গোপণীয় একটি বেইসের ভেতর কী কর্ম কান্ড চলছে তা নিয়ে মানুষের কৌতুহল নানা ধরনের কাল্পনিক ঘটনার জন্ম দেবে। তাই যতদিন পর্যন্ত না এই বেইসের পুরো ইতিহাস জন সমক্ষে তুলে ধরা হবে তত দিন এমন ধারণা, অতি কল্পনা এবং গুজবও ছড়াতে থাকবে।
কিন্তু এতো সবের পরেও এটা মানতে হবে ইতিহাসে বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই বেইস বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অনেক সময় নতুন ধরনের ড্রোনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছে যা দেখেও UFO দেখার গুজব ছড়ানো স্বাভাবিক। স্যাটেলাইটের তোলা ছবি থেকে বোঝা যায় স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে এই বেইসের আয়তনও অনেক বেড়েছে। যা প্রমান করে যুক্ত্রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বা গোয়েন্দা কর্ম কান্ড বিষায়ক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য এই বেইস এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে সত্য যাই হোক, এরিয়া ফিফটি ওয়ান এখনো সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং সবসময় সতর্ক প্রহরার মধ্যে রাখা হয়েছে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এরিয়া ফিফটি ওয়ানের অস্তিত্ব থাকার বিষয় স্বীকার করেছে। তা সত্বেও এরিয়া ফিফটি ওয়ানের সব রহস্য যে খুব শীঘ্রই উদঘাটিত হবে তাও আশা করা যায় না।
[আপনি যদি এই লেখাটির প্রথম পর্ব পড়ে না থাকেন, তবে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার অনুরোধ থাকবে প্রথম পর্বটি পড়ে দেখার। সেখানে এরিয়া ফিফটি ওয়ানের শুরুর ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রকৃত এবং সরকারী রেকর্ড গুলো দেখানো হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে এরিয়া ফিফটি ওয়ান নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত কিছু কন্সপিরেসী থিওরী এবং সাড়া জাগানো সাক্ষাৎকার গুলোর ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।]
প্রথম পর্বঃ https://bigganbortika.org/real_history_and_story_behind_mysterious_area_51_ep1/
দ্বিতীয় পর্বঃ https://bigganbortika.org/area-51-epi-2/
রেফারেন্সঃ ১. https://www.amazon.com/Area-51-Uncensored-Americas-Military/dp/0316202304 ২. https://www.npr.org/sections/thetwo-way/2013/08/16/212549163/there-it-is-area-51-revealed-in-declassified-cia-report ৩. https://www.businessinsider.com/area-51-american-conspiracy-theories-aliens-history-animation-video-2017-7 ৪. https://en.wikipedia.org/wiki/Paul_Hellyer ৫. https://en.wikipedia.org/wiki/Bob_Lazar
Leave a Reply