বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কি আছে এখানে?? কেন ই বা এখানে প্লেন বা জাহাজ গেলে ফিরে আসে না ?? তার রহস্য উদঘাটন করেছেন বিজ্ঞানীরা। চলুন তবে জেনে আসা যাক…..
গল্পটা ৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৫ এর একটি সাধারণ দিনের। সেদিন আমেরিকান নেভি এবং এয়ারফোর্স দলের কিছু সদস্য একটি যুদ্ধ প্লেন নিয়ে ফ্লোরিডা বেস ক্যাম্প থেকে প্রতিদিনের মতো ট্রেনিং এ বের হয়। যা পরিচিত ‘ফ্লাইট ১৯’ নামে। কিন্তু যাত্রা শুরু হওয়ার ৪৫ মিনিট পর ; কন্ট্রোল টাওয়ারের রেডিও তে একটি বার্তা আসে সেই প্লেনটি থেকে,
” কিছু ভয়ংকর ঘটছে। কম্পাস কাজ করছে না। আমরা বুঝতে পারছিনা পশ্চিম. দিক কোনটি। সবকিছুই অদ্ভুত মনে হচ্ছে। চেনা সমুদ্রটিও অচেনা হয়ে গেছে। “
এই বার্তাটির পর ‘ফ্লাইট ১৯’ এর আর কোনো খোজ পাওয়া যায় নি। ঠিক সেই দিন ই একটি সার্চ প্লেন তাদের খুঁজতে বের হয়। ঠিক ২৭ মিনিট পর ই প্লেনটির সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। এই দুটি ঘটনার পর ই পৃথিবীর মানুষ The Barmuda Triangle এর সাথে পরিচিত হয়।
সাধারণ মানুষ ভিনসেন্ট গ্যাডিস ১৯৬৪ তে “The Argosy Magazine ” এ বারমুডা ট্রাইএঙ্গেল নিয়ে লেখা একটি আর্টিকেল থেকে বিস্তারিত জানলেও; ক্রিস্টোফার কলম্বাস ও এর উল্লেখ করে গেছেন,। তিনি জায়গাটিকে একটি নতুন পৃথিবী নামে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন সেখানে তিনি একটি নতুন আলো দেখতে পান এবং এর কাছাকাছি অঞ্চল এ কোনো কম্পাস কাজ করছিল না। যা তার সাথীদের ব্যাপক ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
ফ্লোরিডা, বারমুডা এবং পুয়ের্তো রিকোর মধ্যবর্তী স্থানকে বারমুডা ট্রাইএঙ্গেল বলা হয়। এই স্থানটি ১৩-৩৯ লক্ষ বর্গকি.মি এবং ৫-১৫ লক্ষ মাইল বিস্তৃত। এই স্থানটিতে গত ১০০ বছরে ৭৫ টি প্লেন এবং ১০০ টিরও বেশি জাহাজ হারিয়ে গেছে । এছাড়া হাজারেরও বেশি মানুষ এখানে নিখোঁজ হয়েছে। যেসব বস্তু বা প্রাণী বারমুডা ট্রাইএঙ্গেল এর ভিতর প্রবেশ করেছে, তাদের আর তীরে ফিরে আসা সম্ভব হয় নি। তাই একে বারমুডা ট্রাইএঙ্গেল এর পাশাপাশি দ্য ডেভিলস ট্রাইএঙ্গেল ও বলা হয়।
The Barmuda Triangle গত ১০০ বছরে অন্যতম চর্চিত বিষয়। ফলে বিভিন্ন মানুষ ও বিজ্ঞানী এর সম্বন্ধে মত প্রকাশ করেছেন। কিছুপক্ষ ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর অন্যরকম আলো দেখাকে নিয়ে বিভিন্ন মত দিয়েছে। তাদের মতে UFO অর্থাৎ অন্যগ্রহের যান সেই স্থানে প্রবেশ করে এবং যেহেতু ঐ স্থান তাদের সাথে পৃথিবীর যোগস্থল, তাই পৃথিবীর কোনো বস্তু সেখানে প্রবেশ করলে তারা তাদের ভ্যানিশ করে নিয়ে চলে যায়। আর কলম্বাস সেই UFO এর আলো দেখেছিলেন বলেই তাদের মত।
কারো কারো মতে পৃথিবীর ইউনিভার্স এর সাথে যোগ করার পোর্টাল বা গর্ত সেখানেই অবস্থিত। তাই যে কোনো বস্তু ওই পোর্টাল এর আকর্ষণয়ে পৃথিবীর বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ তাদের মতে সেখানে আস্ত ফুটো আছে।
তবে যাই হোক বিজ্ঞানীরা এটাকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। যার ফলে বারমুডা ট্রাইএংগেল এর আসল সত্য টি পৃথিবী বাসির কাছে বিদ্যমান।
সম্প্রতি আমেরিকান বিজ্ঞানীরা দাবী করেছেন বারমুডা ট্রাইএংগেল এ ঘটা সকল দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, ঘণ্টায় ২৭৩ কি.মি বেগে প্রবাহিত হওয়া একটি ঝড়। এই ঝড় সৃষ্টি হয় Hexagonal Cloud বা ষড়ভুজই মেঘ থেকে। বলা হচ্ছে বারমুডা ট্রাইএংগেলের উপর ষড়ভুজ মেঘ এমনভাবে জমাট বাধছে যার ফলে Air Bomb বা বায়ু বোমা সৃষ্টি হচ্ছে। এই বিধ্বংসী ঝড়ের এতটাই ক্ষমতা যা জলের উপর আঘাত করলে সমুদ্রের পানির ঢেউ ৪০-৫০ ফুট উপরে উঠে যায়। যা সমুদ্রে চলতে থাকা জাহাজ কে নিমিষে ধ্বংস করে নিয়ে চলে যায়। এবং কোনো উড়োজাহাজ এই ঝড়ের মধ্যে চলতে পারে না, ফলে সমুদ্রের নিচে চলে যায়।
[ স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি ]
তবে আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারর যে- এতদিন ধরে শত শত জাহাজ বা প্লেন এই অঞ্চলে ধ্ব ংস হয়েছে। তাহলে তাদের ধ্বংসাবশেষ খুজে পাওয়া যায় নি কেন??? এর কারণ দুটি :
1. গলফ স্ট্রিম :
আমরা জানি সমুদ্রে দু ধরনের স্রোত রয়েছে। একটি হল উষ্ণ স্রোত, আরেকটি হল শীতল স্রোত। গলফ স্ট্রিম হলো একধরনের উষ্ণ সমুদ্র স্রোত ; যা মেক্সিকো উপসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর এর দিকে প্রবাহিত হয়। এই স্রোতের বেগ খুব বেশি। তাই একে বলা হয় মহাসমুদ্রের মাঝে একটি নদী। নদীর স্রোতের মত এটিও ভাসমান বস্তুকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেই কারণে প্লেন বা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ স্রোতের সাথে ভেসে অন্যত্র চলে যায়।
২. পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্চ :
আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরতম খাদ হলো পুয়ের্তো রিকো ট্রেঞ্চ। এটি বারমুডা ট্রাইএংগেল এর মধ্যেই পড়ে। এটি সমুদ্রতলদেশে অবস্থিত সুগভীর গর্ত। যার গভীরতা ২৮৩৭৩ ফুট বা ৮,৬৫০ মিটার। যদি কোনো প্লেন বা জাহাজ এর ধ্বংসাবশেষ এই খাদের মধ্যে জমা হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই তার খোজ পাওয়া সম্ভব হয় না।
আরেকটা প্রশ্ন আমাদের মনে আসে। তা হলো –
কম্পাস কেন কাজ করে না? ?
কারণ: লেখক গেন কুইজার মনে করেন এখানকার বায়ুমণ্ডলে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক এ্যানোমিলিস আছে যার ফলে ম্যাগনেটিক কম্পাস কাজ করেনা। তবে এরকম কিছু সেখানে পাওয়া যায় নি।
তবে এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে,
কম্পাস থেকে চুম্বক মেরুর দূরত্ব এর উপর ভিত্তি করে এর দিক নির্দেশনায় বিচ্যুতি ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় : যুক্তরাষ্ট্র এর কেবল উইকনসিন এবং মেক্সিকো উপসাগর [ Gulf of Mexico ] পর্যন্ত সরলরেখা বরাবর চুম্বক [ কম্পাস ] উত্তরমেরু সঠিকভাবে ভৌগলিক উত্তরমেরু নির্দেশ করে। এই সাধারণ তথ্য যে কোনো দক্ষ পথপ্রদর্শক এর জানার কথা। তবে সমস্যা হলো সাধারণ মানুষ নিয়ে যারা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। বারমুডা ট্রাইএংগেল জুড়ে কম্পাসের এমন বিচ্যুতি সবার কাছে রহস্যময় লাগে। কিন্তু আসলে এটি একটি সাধারণ ঘটনা। সেখানে কম্পাস কাজ করে না, এটি একটি ভুল ধারনা। আসলে সেখানে কম্পাস সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেনা। যার ফলে পাইলট বা নাবিকরা সঠিক পথ নির্ণয়ে ব্যর্থ হন।
US Government এর মতে বারমুডা ট্রাইএঙ্গেলের মত কোনো জিনিসের অস্তিত্ব ই নেই। তাদের মতে এ অঞ্চলে কার্গো শিপের চলাচল সবচেয়ে বেশি। আর এই অঞ্চলে যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে; জাহাজ বা উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তার পরিমাণ পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্রের তুলনায় বেশি নয়। আর বারমুডা ট্রাইএঙ্গেলের অন্তর্গত যে সমস্ত স্থলভাগ রয়েছে, সেখানে বসবাসকারী মানুষ দের উপর এর কোনো খারাপ প্রভাব পরে না।
তো সবশেষে এটা বলা যায়, বারমুডা ট্রাই-এঙ্গেলকে রহস্যময় জায়গার তকমা দেয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় হাত লেখক দের। অনেক লেখকরা বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা তে কল্পনার রং ছড়িয়েছেন। এবং বারমুডা ট্রাই-এঙ্গেলকে ডেভিলস ট্রাইএঙ্গেল এ পরিণত করেছে।
ভাল লাগলে এই লেখাটি শেয়ার করবেন এবং বিজ্ঞানবর্তিকার সাথে থাকবেন।
References :
1. brightside.me
2. bigthink.com