গত দুই পর্বে আমরা মানুষের শরীরের এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর সৌন্দর্য্য প্রকাশে সোনালী অনুপাতের সম্পর্ক দেখেছি। সেই সাথে আমরা সোনালী অনুপাতের বিভিন্ন জ্যামিতিক গঠন ও সেগুলোর সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক দেখেছি। এই পর্বে আমরা মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন বস্তুর দৃষ্টি নান্দনিকতার সাথে সোনালী অনুপাতের একটা সম্পর্ক আছে তা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। এপর্বে আমরা সোনালী অনুপাতের কোনো ব্যাসিক ধারনাতে যাব না। আগের দুই পর্বের ব্যাসিক ধারনাই এখানে কাজে লাগবে। আমরা এ পর্বে বিশেষ করে ডিজাইন, আর্কিটেকচার ও ইঞ্জিনিয়ারিং এ সোনালী অনুপাত খুজব।
যদি কোন স্ট্রাকচারের গাঠনিক কম্পোনেন্ট গুলো ১.৬১৮ অনুপাতে সোনালী অনুপাতের সাথে সম্পর্কিত হয় তা হলে সেই স্ট্রাকচারের ডিজাইনকে বলা হয় পারফেক্ট ডিজাইন। প্লেটো তার ” The Phaedo” বইয়ে যে ৫টি প্লাটোনিক সলিড,ডেকাহেড্রন এর কথা বলেছিলেন তিনি এখানে এমন একটি বল এর কথা বলেছিলেন যার ১২টি পেন্টাগোনাল ফেস আছে,আসলে তা বর্তমান সময়ের ফুটবলের একটা পূর্ব ধারনা ছিল চিত্রঃ১(b)। গিটার, ভায়োলিন এমনকি উচ্চমানের স্পিকারেও সোনালী অনুপাতের ব্যবহার হয়।
চিত্রঃ১
বিখ্যাত আর্কিটেক্ট লি করবুইজার তার চেইজ লং ডিজাইনে সোনালী অনুপাত ব্যবহার করেছিলেন চিত্রঃ১(h)। চার্লস ইমাস ১৯৪৬ সালে একটি প্লাইউড চেয়ার ডিজাইন করেছিলেন সেখানে সোনালী অনুপাতের ব্যবহার দেখা যায়। চেয়ারটি একটি সোনালী আয়তর সাথে নিখুঁত ভাবে মিলে যায়। ক্রেডিট কার্ডগুলোর আকৃতি সোনালী আয়ত এর মত। ক্রডিট কার্ড সাধারণত 54mm by 86mm হয় যার অনুপাত ১.৫৯২৬ যা প্রায় ১.৬১ এর সমান।
অ্যাপেল ২০০৫ সালে ৬মিলিয়ন আইপড বিক্রি করেছিল কিন্তু ২০০৬ সালে যখন আইপডের গঠনে সোনালী অনুপাত ব্যবহার করে তখন বিক্রির পরিমাণ দাড়ায় ১৪ মিলিয়নে। ২০০৫ সালে তারা চিত্রঃ১(f) এর NANO 1G iPod বাজারে ছাড়ে কিন্তু চিত্র: ১(g) এর ক্লাসিক 5G মডেল বাজারে ছাড়ার পর তাদের বিক্রি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
সেই ১৫০০ সালের আর্টিস্ট থেকে এখনকার গ্রাফিক আর্টিস্ট সবার কাছেই সোনালী অনুপাত সৌন্দর্য্য ও সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন পণ্যের লোগোতে ও সোনালী অনুপাত কাজে লাগানো হয়। পণ্যে কম্পানির লোগো সাধারণত কোনো নীতিবাচক এবং স্মরণীয় কিছু প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
টয়োটার লোগোয় তিনটি ওভাল (ডিম্বাকৃতি) আছে, লম্ব ওভাল দুইটি আসলে ক্রেতা এবং টয়োটার সম্পর্ক প্রকাশ করে এই দুটি ওভাল একটি T আকৃতি গঠন করে যা Toyota’র T। লোগোটির লম্ব এবং আনুভূমিক যেকোনো দুই অর্ধেকের অনুপাত ১.৬১৩। সোনালী অনুপাতের আরেকটি উদাহরণ হলো পেপসির লোগো ডিজাইন। পেপসির লোগো দেখে মনে হয় একটি হাসি মুখ।এই লোগো দুইটি বৃত্ত দিয়ে করা হয়েছে যার একটি অপরটির সাথে সোনালী অনুপাতে আছে। অ্যাপেলের iCloud এর লোগো ডিজাইনেও সোনালী অনুপাত খুঁজে পাওয়া যায় চিত্র: ১ (m)।
ফটোগ্রাফিতে একটি প্রচলিত নিয়ম হলে থার্ড রুল, এটার মানে হলো কোন ব্যক্তি বা বস্তুর ছবি তোলার সময় ওই অবজেক্টটি কে ক্যামেরা ফ্রেমের এক- তৃতীয়াংশে রেখে ছবি তুললে সবথেকে দৃষ্টিনন্দন ছবি পাওয়া যায়,ফ্রেমের কেন্দ্রে রাখলে তেমন হয় না। পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু চিত্রকর্ম এবং আর্কিটেকচারে সোনালী অনুপাত যোগ করেছে সৌন্দর্য্য ও সাম্যতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি থেকে সালভাদর ডালি সহ অনেক আর্টিস্ট তাদের চিত্রকর্মকে সোনালী অনুপাতে ভাগকরে কাজ করেছেন বিশেষ করে সোনালী আয়তক্ষেত্র তে। ভিট্রুভিয়ান ম্যানকে বলা হয় পিকচার অব পারফেকশন,যা একটি মানুষের ক্লাসিক ছবি এবং এর শরীরের প্রত্যেক অংশের অনুপাতে রয়েছে সোনালী অনুপাত। মিশরের বিখ্যাত পিরামিডে ও সোনালী অনুপাত দেখা যায়। পিরামিডের নিচের অর্ধাংশ ১.৬২ এর গুণিতক। অবশ্য পিরামিডে এই সোনালী অনুপাতের প্রকাশ নিয়ে মতভেদ আছে এই নিয়ে যে এটা এক্সিডেন্টাল ছিল নাকি পরিকল্পিত ছিল।
মাইস ভ্যানডার রোহ্ তার স্টিল এবং কাচের তৈরি আকাশচুম্বী স্থাপনার জন্য বিখ্যাত, তিনি Illinois Institute of Technology (IIT) এর স্কুল অব আর্কিটেকচার এর পরিচালক ছিলেন। তিনি IIT ক্যাম্পাসের বেশকিছু ভবনের নকশা করেন। IIT এই ভাবন গুলোকে সোনালী অনুপাতের নিখুঁত উদাহরণ ধরা হয়। তিনি ভাবননে সোনালী আয়তের ৫টি কলামের প্যাটার্ন তৈরি করেন। চিত্র: ২(f) এর ভবনটিকে বলা হয় The Core যেটি ফিবোনাচি সংখ্যা এবং গোল্ডেন স্পাইরাল এর ডিজাইনে করা হয়েছে। ৩০০মিলিয়ন বছর বয়স্ক The Seed যার ওজন ৭০টন চিত্রঃ২(f) কে এই ভবনের কেন্দ্রে বসানো হয়েছে।
চিত্র: ২
প্যারিসের নটরডেমের নকশায় ও সোনালী অনুপাত দেখা যায় যা ১১৬৩সাল থেকে ১২৫০সাল এর মাঝে নির্মিত। ভারতের তাজমহলের নকশায় ও সোনালী অনুপাত পাওয়া যায়। জাতিসংঘ ভবনে তিনটি সোনালী আয়তক্ষেত্রকে একটির পর একটি করে বসিয়ে মিলিয়ে দেয়া যায়। টরেন্টোর CN টাওয়ারের গঠনে আছে সোনালি অনুপাত। এর অবজারভেশন ডেক ৩৪২ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এবং এর মোট উচ্চতা ৫৫৩.৩৩ মিটার এই দুই অংশের অনুপাত ১.৬১৭৯ = সোনালী অনুপাত। চিত্র: ২ (c),(d)এবং (e) এ নটরডেম,জাতিসংঘ ভবন এবং CN টাওয়ার দেখানো হয়েছে।
পলিক্লেইটোসের( Polykleitos) ডরিফোরাস( Doryphoros) এর নাভি থেকে হাঁটু এবং নাভি থেকে সোলের দূরত্বের অনুপাত ১.৬১। নাভি থেকে সোলের এবং নাভি থেকে মাথার দূরত্বের অনুপাত ও ১.৬১। জেরুজালেমে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ান স্থাপত্যবিদ অ্যান্ড্রু রজারের 50-ton ston and gold চিত্রঃ২(g) এ সোনালী অনুপাত দেখা যায়। এর প্রত্যেকটি পাথরের স্তম্ভ ফিবোনাচি ধারায় ১,১,২,৩,৫ এবং ৮ সংখ্যায় কেন্দ্রের দিকে বৃদ্ধি পেয়েছে। কায়রোর বিখ্যাত মসজিদের জ্যামিতিক নকশায়ও সোনালী অনুপাতের ছোয়া রয়েছে,যেটি উকবা ইবনে নাফি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই নকশা বিশ্লেষণ করেছিলেন বোয়শোররা এবং মাজোওজ, তারা বলেন এখানে মূল পরিকল্পনায়, নামাজের জায়গায় এবং কোর্টে সোনালী অনুপাতের প্রকাশ পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়ার জাভায় অবস্থিত The Stupa of Borobudur যা বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে বড় মন্দির যা অষ্টম- নবম শতকে তেরি করা হয়েছিল। এর বর্গ আকৃতির বেজমেন্ট যে বৃহত্তম বৃত্ত করে তার ব্যাসের এবং ওই বর্গের বাহুর অনুপাত ১.৬১৮ঃ১। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স এর ট্যুরিজম বিষয়ক ওয়েবসাইট এর তথ্য অনুযায়ীতৈরি হয়েছে সোনালী অনুপাতের উপর ভিত্তি করে, যেটি ডিজাইন করেছিলেন ইটালিয়ান আর্কিটেক্ট মারিও পালান্টি।
ভেনাস দ্যা মিলো চিত্র: ২(m) স্থাপনাকে সোনালী অনুপাতে বাকানো হয়েছে। অ্যাথিনার স্ট্যাচুর মাথার সামনের অংশ থেকে কানের দূরত্ব এবং কপাল থেকে থুতনির দূরত্ব সোনালী অনুপাতে চিত্রঃ২(n)। এর নাক থেকে কানের লতির দূরত্ব এবং নাক থেকে থুতনির দূরত্ব ও সোনালী অনুপাতে আছে।
পার্থেনন এবং এক্রোপলি সম্পর্কে গবেষণা ও আছে। যেমন পার্থেনের বিভিন্ন অংশের অনুপাতে সোনালী অনুপাত খুজে পাওয়া যায়।যেটা তাদের আর্কিটেক্ট দের যে সোনালী অনুপাত সম্পর্কে জ্ঞান ছিল তাই নির্দেশ করে। আবার এটাও হতে পারে যে ওইসব আর্কিটেক্ট রা তাদের নিজস্ব সৌন্দর্য্য জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছিলেন যা স্বয়ংক্রিয় ভাবে সোনালী অনুপাতের সাথে মিলে গেছে।
বিখ্যাত সুইস আর্কিটেক্ট লি করবোজার মনে করেন মহাবিশ্বের গণিত সোনালী অনুপাত এবং ফিবোনাচি ধারার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তিনি তার আর্কিটেকচারাল সিস্টেমে খোলামেলা ভাবেই সোনালী অনুপাত ব্যবহার করেন। তিনি এই ব্যবহারকে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, ভিট্রুভিয়াস এবং লিওন বাতিস্তা আলবার্টি যারা তাদের সৃষ্টির জন্য অমর হয়ে আছেন তাদের কাজের পরম্পরা হিসেবেই দেখেন।
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি তার “The last supper” ছবির প্রত্যেকটি প্রান্তে এমনকি টেবিলেও সোনালী অনুপাত ব্যবহার করেছেন। সালভাদার ডালি তার ” The sacrament of the last supper” ছবিটি একটি সোনালী আয়তক্ষেত্রের ভিতরেই এঁকেছেন। দ্যা ভিঞ্চি কে অনুসরণ করে ডালি টেবিলটিকে ছবির উচ্চতার সোনালী অনুপাতের অংশেই রেখেছেন। এছাড়া পিছনের জানালাগুলোও একটি বড় ডেকাহেড্রন থেকে করা হয়েছে। চিত্রঃ৩(a)এবং (e) এ ছবি দুটি দেখানো হয়েছে। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির চিত্রগুলোর শারীরিক গঠন থেকে বেশির ভাগ গবেষক মনে করেন তিনি এসব চিত্র কর্মতে সোনালী অনুপাত ব্যবহার করেছেন। তার মোনালিসার জ্যামিতিক ব্যাখ্যায় সোনালী অনুপাতের প্রকাশ আছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু ভিঞ্চি তার চিত্রকর্মের ভিত্তি কি তা প্রকাশ করে যান নাই।
কালার (রং) স্পেকট্রামে সোনালী অনুপাতের সম্পর্কের ফলে এক উচ্চমানের কালার কম্বিনেশন পাওয়া যায়। মাইকেল সেমপ্রিভিবো PhiBar নামক একটি ধারনা প্রকাশ করেন যা দৃশ্যমান আলোর কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাথে ফাই( Phi) এর সম্পর্ক ব্যবহার করে। স্পেকট্রামে সোনালী অনুপাতের সাথে সম্পর্কিত দূরত্বের আলো খুবই উজ্জ্বল এবং দৃষ্টিগ্রাহী কালার সৃষ্টি করে।
আসলে সোনালী অনুপাতকে বলা যায় গণিতের সৌন্দর্য্য আরো ভালোকরে বললে সৌন্দর্যের গণিত বলা যায়। প্রকৃতির বিভিন্ন সৃষ্টির মাঝে সমন্বয় সাধন করে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করতে সোনালী অনুপাত হলো প্রকৃতির একটি লিখিত সংবিধানের সাথে তুলনীয়। একটি দুইটি আর্টিকেলে এতকিছু তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। আগ্রহীরা এসম্পর্কিত অনেক বই পাবেন,এছাড়া ইন্টারনেটে ও প্রচুর তথ্য পাওয়া যাবে সেখানে হয়ত আমার থেকে আরো ভালো ব্যাখ্যাও পাবেন। এখানে তিন পর্বে সোনালী অনুপাতের সাথে আপনাদের সামান্য পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র, গণিত এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী করার প্রত্যয়ে।
পর্ব-১ যারা মিস করেছেনঃ
পর্ব-২ যারা মিস করেছেনঃ