রহস্যের এক অন্যতম নাম : বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পৃথিবীর রহস্যঘেরা অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত এই অঞ্চলটিকে ডেভিলস ট্রায়াঙ্গল (Devil’s triangle) বা শয়তানের ত্রিভুজও বলা হয়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল যে তিনটি প্রান্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ, তার মধ্যে একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা আরেক প্রান্তে পুয়ের্তো রিকো এবং অপর প্রান্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপ অবস্থিত। ত্রিভুজাকার এ অঞ্চলটির মোট আয়তন ১১৪ লাখ বর্গ কিলোমিটার বা ৪৪ লাখ বর্গ মাইল। এটি ২৫-৪০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৫৫-৫৮ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। তবে অনেকের মধ্যেই এই বিন্দু নির্ধারণ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক রয়েছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে নিয়ে রয়েছে এক রহস্যের মোড়ক। এই রহস্যময়তার কারণস্বরূপ কেউ কেউ অলৌকিক ঘটনার কথা বলেছেন, আবার কেউ কেউ সাধারণ ঘটনার মতোই বিষয়টিকে দেখে থাকেন।

চলুন প্রথমেই জেনে নেয়া যাক বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে নিয়ে রয়েছে কী কী রহস্য?

আজ অবধি বহু জাহাজ, বিমান এই অঞ্চলে গিয়ে কোথায় যে অন্তর্হিত হয়েছে তা কারোই জানা নেই। জাহাজ বা বিমান যখন এ অঞ্চলে এসে পৌছায়, তখন তাদের রিডার, ওয়্যারলেস রেডিও সিস্টেম, কম্পাস সহ যাবতীয় যন্ত্রাংশ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলে জাহাজ বা বিমানের সাথে কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। তারপর যে জাহাজ বা বিমান কোথায় মিলে যায় তার কোন হদিশ আজো পাওয়া যায় নি, এমনকি এসবকিছুর ধংসাবশেষ কিংবা মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায় না।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কথা বলেন। ১৪৯২ সালে তিনি যখন সামুদ্রিক অভিযানে বের হন, তখন ওই অঞ্চলে তার জাহাজের কম্পাস আর ক্রিয়াশীল ছিলো না, এছাড়াও তিনি ও তার সাথে থাকা অভিযাত্রীর দল লক্ষ করেন রহস্যময় এক আলোর ছটা এবং একটি বড় আগুনের গোলা, যেটি আকাশ থেকে বেড়িয়ে সোজা সমুদ্রের দিকে পড়ছে। এটি কলম্বাসের নিজের জার্নাল থেকেই পাওয়া যায়। অবশ্য আধুনিক বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাটিকে তার মনের ভুল বলেই গণ্য করে। অনেকে আবার মনে করেন, নাবিকেরা যে আলো দেখেছেন, তা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নৌকায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত আগুন এবং কম্পাসে সমস্যা হয়েছিল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময়তাকে ঘিরে থাকা আরো দুই একটি ঘটনার কথা জেনে নেয়া যাক, ব্রিটিশ-আমেরিকার বিশ্ব বিখ্যাত জাহাজ ম্যারি সেলেস্ট। ১৮৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর ম্যারি সেলেস্টকে আটলান্টিক মহাসাগরে মনূষ্যহীন ও যাত্রার জন্য তৈরি অবস্থায় পাওয়া যায়। জাহাজের ৭ জন নাবিকের একজনকেও খোঁজে পাওয়া যায় নি এবং একটি লাইফবোট পাওয়া যায় নি যদিও সেদিনের আবহাওয়া ভাল ছিল ও জাহাজের প্রত্যেকে অভিজ্ঞ নাবিক ছিলেন। ম্যারি সেলেস্টও যাত্রার উপযোগী ছিল এবং যখন পাওয়া যায় তখন জাহাজটি জিব্রাল্টার অভিমুখে যাত্রার জন্য তৈরি অবস্থায় ছিল। জাহাজটি যখন পাওয়া যায় তার এক মাস আগে সমুদ্রে নামানো হয়েছিল এবং তখনো জাহাজের ডেকে ছয় মাসের খাবার মজুত ছিল। শুধুই কি ‘দ্যা ম্যারি সেলেস্ট’? বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের শিকার হয় আমেরিকার ফ্লাইট নাইনটিনের ( Flight-19) ৫টি যুদ্ধ বিমান। ফ্লাইট নাইনটিন উধাও হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বিমান থেকে যে বার্তাগুলো পাওয়া গেছিলো সেগুলো কিছুটা এরকম, “সবকিছুই খুব অদ্ভুত লাগছে। আমরা জানি না, কোন দিক পশ্চিম। সাগরকেও স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। আমাদের মনে হচ্ছে আমরা…”। তারপর আর কোন খোজ মেলে নি ফ্লাইট নাইনটিনের। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা হচ্ছে, আজ অবধি যেসব জাহাজ এ অঞ্চলে অন্তর্হিত হয়েছে, তাদের কোনটিরই ধংসাবশেষ বা মানুষের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় নি। সব মিলিয়ে হিসাব করলে দেখা যায় ৫০ টিরও বেশী জাহাজ, ২০ টিরও বেশী প্লেন এবং হাজারের উপর মানুষ এই অঞ্চলে এসে বিলুপ্ত হয়েছে।

১৯৫০ সালের ১৬ ই সেপ্টেম্বর যখন প্রথমবার সংবাদপত্রে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের খবর প্রকাশিত হয়, তখন বিষয়টি সকলের নজরে আসে। এর পর অনেক পত্রিকাতেই এই বিষয়ে নানান খবরাখবর প্রকাশ হয়। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে জলসেনার অধিকারীদের পক্ষ থেকে লেখা হয়েছিল যে ফ্লাইট নাইনটিনের বিমান অন্য কোন গ্রহে চলে গেছে, যার মাধ্যমে প্রথমবারের মত আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে স্বীকার করা হয়।

বারমুডা রহস্যের কারণ হিসেবে যা সন্দেহ করা হয়: বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের এসব ঘটনার পিছনে সন্দেহজনক তো কিছু থেকেই যার। তার মধ্যে একটি হলো এলিয়েন অর্থাৎ ভিনগ্রহের প্রাণী । এরা চায় না মানুষ এসে সেখানে কোন হস্তক্ষেপ করুক। অবশ্য এর কোন প্রমাণ মেলে নি। পরবর্তী কারণ রূপে বলা যায় টাইম পোর্টাল বা unknown dimension। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের উপর ডকুমেন্টারি বানান রিচার্ড রিনার। তিনি তার এক ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারে এ বিষয় সম্বন্ধে বলেন যে এসকল জাহাজ ও বিমানগুলো প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্বশীল আছে কিন্তু এরা এমন জায়গায় চলে গেছে যা সাধারণ মানুষের অন্তরায়। এটাকে এভাবেও বলা যায় যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়। যার ফলে ওই জাহাজ বা বিমান এক টাইমজোন থেকে অন্য টাইমজোনে স্থানান্তরিত হয়। যদিও এর স্বপক্ষেও কোন যুক্তি কেউ দেখাতে পারে নি।

আধুনিক বিজ্ঞান অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারলেও, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্য উদঘাটনের বেলায় শূন্যতায়ই পড়ে রয়েছে। আজ পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানীই এ রহস্যের কারণ স্বরূপ কোনো পূর্ণ তথ্য প্রদান করতে পারে নি। এদিক দিয়ে তারা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। যদিও কেউ কেউ এলিয়েন কিংবা টাইম ট্রাভেলের মতো ঘটনাগুলোকে এই রহস্যের সাথে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছে, তবে এর প্রমাণস্বরুপ কোনো যুক্তিসম্মত কারণ তারা দর্শাতে পারে নি।

One Comment

  1. বারমুডা ট্রাইএঙ্গেলের রহস্যভেদ | বিজ্ঞানবর্তিকা

    […] বারমুডা ট্রাইএংগেল নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।  কি আছে এখানে??  কেন ই বা এখানে প্লেন বা জাহাজ গেলে ফিরে আসে না ??  তার রহস্য উদঘাটন করেছেন বিজ্ঞানীরা।  চলুন তবে জেনে আসা যাক….. […]

Comments are closed.