বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাফল্যে গাঁথা ২০১৯!

বিজ্ঞানের সাথে মানুষের পরিচয় হওয়ার পর থেকেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তাঁর মহিমান্বিত আবিষ্কার যা বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবন, রূপায়ণ করছে এক নতুন ভবিষ্যৎ। এই আবিষ্কার কোনোটা কোনোটা হয়ত হাজার বছরের পুরোনো রহস্যকে ভেদ করেছে অথবা খুলে দিয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দ্বার। আজ সেরকমই কিছু সাফল্য ও আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করব যা ২০১৯ সালকে মহিমান্বিত করে রেখেছে।

১। Homo luzonensis এর আবিষ্কার

আমরা মানুষ, কিন্তু আমরা বর্তমান যে বিবর্তনের ধারা বেয়ে এই দেহ অবকাঠামোতে উত্থিত হয়েছি তা কয়েক হাজার বছর আগেও এরকম ছিল না। কালের পর কাল বেয়ে এসেছে মানবজাতির নানা প্রজাতি যারা আমাদের পূর্বপুরুষ। এক প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার পর জন্ম দিয়েছে নতুন প্রজাতি এবং এভাবেই চলে এসেছে বিবর্তনের ধারা। ২০১৯ সালের একটা শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হচ্ছে Homo luzonensis প্রজাতির আবিষ্কার।

Homo luzonensis

তাঁরা প্রায় ৫০০০০ বছর আগে পৃথিবীতে অবস্থান করেছিল। সহজ বাংলায় খুব নিকটবর্তী পূর্বপুরুষ। ২০১১, ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে বিজ্ঞানীরা ফিলিপাইনের একটি গুহায় কিছু হাড় বিশেষ ও কঙ্কালতন্ত্র খুঁজে পান যেগুলোর গঠন ও বৈশিষ্ট্য ছিল কিছুটা আলাদা। অবশেষে জানা যায় তাঁদের আসল প্রজাতি। ১১ ই এপ্রিল Nature Journal এ প্রকাশিত হয় এই আবিষ্কারের কথা। উল্লেখ্য যে এই প্রজাতি Hominid বর্গের খুব কাছাকাছি একটি প্রজাতি Homo floresiensis এর মতোই। এই আবিষ্কার বর্তমান নৃ-তত্ববিদ্যার একটি বিশাল দরজা খুলে দেয় এবং এশিয়াতে মানব বিবর্তনের ধারার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটন করে।

২। পৃথিবী থেকে ডায়ানেসর বিলুপ্তির দিন ঘটে যাওয়া মুহূর্ত গুলো!

ডায়ানেসর নিয়ে আমাদের কমবেশি সবারই কৌতুহল রয়েছে। জুরাসিক পার্ক দেখেনি এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যায়। স্বভাবতই এত দানবাকৃতির ভয়ংকর প্রাণীদের বিলুপ্তির কারণ নিয়েও বেশ হৈ চৈ চলছে লম্বা একটা সময় ধরে। বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মত আবিষ্কার করেন যেদিন এই মহাপ্রলয় হয়েছিল, অর্থাৎ যখন উল্কাপিণ্ড এসে আঘাত করে পৃথিবীতে ঠিক কী কী পরিবর্তন সেসময় হয়েছিল এবং কেন ডায়ানেসররা মারা গেল। বিজ্ঞানীরা সেই গিরিখাত খনন করেন যেখানে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে অতিকায় উল্কাপিণ্ড আঘাত করে। এটি রয়েছে Gulf of Mexico তে। ২০১৬ সালে সেই জায়গা থেকে কিছু পাথর তুলে আনা হয়। বিশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করে৷ তাঁরা এই পাথরগুলো থেকে প্রমাণ পেয়েছেন যে উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে আঘাত করার প্রথমদিন ঠিক কী কী ঘটেছিল।

আঘাত করার পরপরই উল্কাপিণ্ড গুলো প্রায় ১৩০ মিটার মাটির গভীরে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এগুলোতে প্রধান উপাদান হিসাবে উপস্থিত ছিল কয়লা যেটা থেকে প্রমাণ মেলে যে প্রচন্ড বিস্ফোরণে চারিদিকে তীব্র দাবানলের সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়াও সমুদ্র গভীরে বালির স্তর এবং পানির গতিপথ লক্ষ্য করে বুঝা যায় প্রবল সুনামিও আঘাত করেছিল। উল্কায় যে জিনিসটা পাওয়া যায়না সেটা হচ্ছে সালফার। অর্থাৎ এতেই প্রমাণিত হয় যে আঘাত করার পর পরই সালফার গুলো বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে, সূর্য রশ্মি প্রতিহত হয় এবং পরবর্তীতে পৃথিবীর জলবায়ুকে ধীরে ধীরে শীতল করে দে। তাছাড়াও উৎপন্ন হয় ভয়াবহ মাত্রার ভূমিকম্প। এইসব কারণগুলোকেই বিজ্ঞানীরা দায়ী করেন ডায়ানেসরের বিলুপ্তির প্রধান কারণ হিসেবে যার বিস্তারিত আমরা পাই বিশাল অনুসন্ধানের ফলাফল হিসেবে।

৩। ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি দেখা গেল!

ব্ল্যাকহোল হচ্ছে এই মহাবিশ্বের অন্যতম রহস্যময় বস্তুগুলোর একটা। মহাবিশ্বে এর অস্তিত্ব নিয়ে রীতিমতো সবসময়ই চলত নানাবিধ মতান্তর। কখনো বা অনুকল্পনা আবার কখনো বাস্তবতা দুইয়ের মাঝে পাল্টাপাল্টি যুক্তি বিনিময় হলেও বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন! ২০১৯ এর এপ্রিলে প্রায় ৪০ টি দেশের বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগে Event Horizon Telescope প্রজেক্টের মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন করা হয়। M87 গ্যালাক্সি যেটি রয়েছে Virgo মণ্ডলে সেই গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকেই ধারণ করা হয় অতিদানবীয় ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের ছবি।

ব্ল্যাকহোল 

আমরা জানি ব্ল্যাকহোল থেকে কোনো কিছু বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনা, এমনকি আলোও। যখন নক্ষত্র, বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু প্রায় আলোর বেগে ব্ল্যাকহোলের চারিপাশে ঘুরতে থাকে তখন প্রচন্ড ঘর্ষণ ও মহাকর্ষের ফলে সেগুলো উজ্জ্বল রেডিও তরঙ্গ বিকিরণ করে যা ধরা পড়ে EHT এর মাধ্যমে। প্রায় ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে ১ সপ্তাহ ধরে কাজ করে বিভিন্ন স্থানে বসানো ৮ টি বিশেষ টেলিস্কোপ এবং ফলাফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই ব্ল্যাকহোলের প্রথম চিত্র। অবশ্যই এটি শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারের একটি।

৪। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সুপ্রিমেসি!

কম্পিউটার চেনে না এমন মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে নেই। খুব সহজ অর্থে আমরা যদি বলি, গণনা করার যন্ত্রই হচ্ছে সাধারণত কম্পিউটার। মানব ক্ষমতার বাহিরে যে হিসাব গুলো সেগুলো অতিদ্রুত করতে কম্পিউটারের কোনো বিকল্প নেই। এই হচ্ছে আমাদের সম্যক ধারণা কম্পিউটার জগৎের। কিন্তু এমন যদি হয় যে একটা হিসাব করতে একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের লাগল ২০০ সেকেন্ড যেখানে এটি সমাধান করতে IBM এর
সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের সময় লাগবে ১০ হাজার বছর! ভাবা যায়?

ঠিক এই কাজটাই করে ফেলেন গুগলের একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা দাবি করেন রিসার্চ ল্যাবের বাহিরে এরকম অত্যাধুনিক ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যেটাকে আমরা জানি কোয়ান্টাম কম্পিউটার হিসেবে। সাধারণ কম্পিউটার কাজ করে শুধু মাত্র ০ অথবা ১ এর মাধ্যমে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার ০ এবং ১ দুটোই একসাথে ব্যবহার করতে পারে যা অন্যতম অনন্য এবং শক্তিশালী একটি বৈশিষ্ট্য। এটি অন্যতম সেরা একটি মাইফলক এবং খুবই শীঘ্রই প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসির বিপ্লব ঘটবে বলে ধারণা প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীদের।

৫। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিপ্লবী পরিবর্তন!

মানুষের নতুন নতুন রোগ যেভাবে হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিনিয়তই চালিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর নিরাময় খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা। তাছাড়া যেসকল রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, বিজ্ঞান সর্বদাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে যা থামিয়ে দিবে মহামারী। ২০১৯ সালে ভয়ংকর ইবোলা ভাইরাস এর জন্য দুটি ঔষধ তৈরি করা হয় যা প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে সঠিক প্রভাব ফেলে। এই বিপ্লবী আবিষ্কার ইবোলার মতো ভয়ংকর রোগকে করে তুলবে প্রতিরোধযোগ্য। তাছাড়াও Bubble Boy নামক এক প্রকার রোগ যেখানে বাচ্চারা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই জন্ম নেয়। এর ফলে হয় Cystic Fibrosis এবং অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারের মতো রোগ; সেই ক্ষেত্রেও কার্যকরী প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়েছে।
তাছাড়াও CRISPR জিন এডিটিং সিস্টেম দ্বারা ক্যান্সারের মতো রোগ নিরাময় এক সেরা আবিষ্কার। জিন থেরাপির মাধ্যমে ডিএনএ পরিবর্তন করে যে ডিফেক্টিভ কোষ বা যে কোষ ক্যান্সার তৈরি করতে পারে সেগুলো সারানোর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অভিনব কৌশল দেখিয়েছে। একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে এই জিন এডিটিং থেরাপি প্রয়োগ করে ৮৯% সঠিকভাবে ডিএনএ পরিবর্তন করা যায় যা দায়ী থাকে লিউকোমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারের জন্য!
তাছাড়াও আরো রয়েছে অসংখ্য আবিষ্কার এবং উদ্ভাবন যা এখানে বলে শেষ করা যাবেনা। এভাবে যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞান তাঁর জাদু দেখিয়ে আমাদের জীবন করছে সহজতর, অজানাকে এনে দিচ্ছে হাতের একেবারে মুঠোয়।…
Source: Nature Journal, sciencefocus,weather

Comments are closed.