ব্যাপারটা অনেকটা ঈশপের গল্পের মতো যে অনেক অনেক আগে আমাদের এই মহাবিশ্ব একটা বিন্দুতে ঘনীভূত অবস্থায় ছিল যাকে বলা হয় সিংগুলারিটি। কিন্তু হঠাৎ হয় প্রচন্ড বিস্ফোরণ, বুম! এক সেকেন্ডের ট্রিলিয়নথ ভাগের একভাগ সময়ে পুরো মহাবিশ্ব আলোর চেয়েও বেশি গতিতে প্রসারিত হয়েছে এবং পরিণত হয়েছে বর্তমান মহাবিশ্বে যা আমরা এখন দেখছি। যাইহোক এই জনপ্রিয় থিওরিটি যা এতদিন ধরে সবাই জেনে আসছিল এবং বিজ্ঞানীরা যা জানতেন সেটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কোনো সিংগুলারিটি ছিল না। আবার মহাবিশ্ব প্রসারণ মাত্রা বিগ ব্যাং এর পর প্রায় শামুকের গতির মতো ধীর হয়ে গিয়েছে আগের তুলনায়। হ্যাঁ, বিগব্যাং মহাবিশ্বের সূত্রপাতের আসল এবং একমাত্র কারণ ছিল না।
বিগব্যাং থিওরির প্রতি কোনো অসম্মান নেই। কারণ এটি যে ঘটেছে তাঁর যথেষ্ট প্রমাণ বিজ্ঞানীদের কাছে আছে এবং সেগুলো সম্পূর্ণ যৌক্তিক। এডুইন হাবল, যিনি প্রথম উত্থাপন করেছিলেন মহাবিশ্বের প্রসারণের কথা। ১৯২০ সালের দিকেই বিজ্ঞানীরা প্রথম লক্ষ্য করেন যে আমাদের মহাবিশ্বের দূরবর্তী গ্যালাক্সি গুলো নিকটবর্তী গ্যালাক্সি থেকে দ্রুততর দূরে সরছে। এর কারণটাই হচ্ছে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, অর্থ্যাৎ আমাদের মহাবিশ্ব আগে অনেক ক্ষুদ্র ছিল!
যদি মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটে তাহলে অবশ্যই আলোরও প্রসারণ ঘটবে! এটাই হচ্ছে, মানে গ্যালাক্সি গুলো দূরে সরছে ও “রেড শিফট” বিকিরণ করছে। আলো প্রসারিত হতে হতে লাল আলোর বিকিরণের দিকে অগ্রসর হয়েছে; তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের সবচেয়ে স্বল্প শক্তিসম্পন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য। এর অর্থ হচ্ছে পূর্বে মহাবিশ্বে আরো বেশি শক্তি সম্পন্ন বিকিরণ ঘটেছিল। মানে বিগ ব্যাং এর সময় কালে সকল বস্তু প্রচন্ড উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল। এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে পরমাণুর গঠন হওয়া সম্ভব ছিলনা সে তাপমাত্রায়। এবং এর প্রমাণ হিসাবে আমরা পাই Cosmic Microwave Background(CMB) radiation এর উপস্থিতি।
তাছাড়াও বিগব্যাং এর আরো প্রমাণ হিসাবে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন এক ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে যেটা সেইসময়ে গঠিত হয়েছিল যখন মহাবিশ্ব যথেষ্ট পরিমাণে তাপ হারিয়েছে যাতে আলো নিজস্ব গতিতে মুক্তভাবে চলতে পারে। আর Dense Plasma Soup এর Recreation এর মাধ্যমে প্রাপ্ত অণু পরমাণুর অনুপাতের হিসেব তো আছেই।

কিন্তু? কিন্তু এখানেও রয়েছে দারুণ কিছু সংশয়। এই সংশয় গুলোর কারণে পাজলের টুকরো গুলো খাপে খাপ বসছেনা। যেমন CMB থেকে যে প্রমাণ গুলো পাওয়া যায় আদি মহাবিশ্বের সেটা বলে যে মহাবিশ্ব সমতল। কিন্তু বিগব্যাং বলে যে মহাবিশ্বের ধরনটা হওয়ার কথা বক্র। আবার আরেকটা ব্যাপার উঁকি দেয় সেটা হচ্ছে মহাবিশ্বের প্রায় সব বস্তুই একই তাপমাত্রিক অবস্থায় বিরাজ করছে। কিন্তু কিছু কিছু বস্তু এতোটাই দূরবর্তী যে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কোনো ধরনের তাপীয় আদান প্রদান ঘটাতে পারেনি। বিগব্যাং এর পর অতি উচ্চ চার্জযুক্ত কণা তৈরি হওয়ার কথা ছিল যাদেরকে বলা হয় ম্যাগনেটিক মনোপোল, কিন্তু সেটাও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না। তাহলে মহাবিশ্ব যদি সিংগুলারিটি থেকে উদ্ভব না হয় তবে আসল কোথা থেকে?
আরেকটা থিওরি যেটা এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে সেটা হচ্ছে “Theory of Inflation”। Inflation বা অস্বাভাবিক স্ফীতির কারণেই শূন্য থেকেই হঠাৎ এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি।
Inflation Theory পুরোপুরি যে ব্যাপারটির উপর নির্ভরশীল সেটা হচ্ছে ভ্যকুম এনার্জি এর উপর। অর্থাৎ বিগব্যাং এর আগে যখন কোনো বস্তু বা বিকিরণই ছিল না তখন ছিল শুধু এই ভ্যকুম এনার্জি। মূলত এই শক্তিটাই সহায়তা করেছে মহাবিশ্বকে সূচকীয় হারে প্রসারিত হতে। এবং পরবর্তীতে এই শক্তিটাই পরিণত হয়েছে বস্তু এবং বিকিরণে যা সেই সময় প্রবল উত্তপ্ত স্তরে টিকেছিল এবং বর্তমানের ক্রমবর্ধমান মহাবিশ্বে অবস্থান করছে।

Inflation Theory অনেক সমস্যারই সমাধান করে দেয় বিগব্যাং থিওরি সম্পর্কে। এটা বলে যে মহাবিশ্ব সমতল, যে গতিতে প্রসারিত হয়েছে এবং যেভাবে প্রায় মহাবিশ্বের সব বস্তুই একই তাপমাত্রা সম্পন্ন তাঁরা একবার হলেও নিজেদের মধ্যে তাপীয় আদান প্রদান করেছে। এই থিওরি আরো বলে যে ম্যাগনেটিক মনোপোল এর অস্তিত্ব হয়ত ছিল কিন্তু ঘনত্বের পরিবর্তনের ফলে সেগুলো ক্রমশই আনডিটেক্টেবল রয়ে গিয়েছে। ভ্যকুম এনার্জির হ্রাস বৃদ্ধি কীভাবে এই গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ইত্যাদি তৈরি করেছে সেটাও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে। যদি এই অতিরিক্ত শক্তি না থাকত তবে কখনোই মানবজগৎ অস্তিত্বশীল হতো না।
সুতরাং আমরা এখন বিগব্যাং থিওরির বেলায় নতুন করে বলতে পারি, অনেক অনেক বছর আগে সেখানে এক প্রকার রহস্যময় শক্তি ছিল যখন কোনো বস্তু বা বিকিরণ অস্তিত্বমান ছিল না। এই শক্তিরই হঠাৎ অতি দ্রুত প্রসারণ যা ঘটে চোখের পলক ফেলার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেকেন্ডের মধ্যে তৈরি করে আমাদের মহাবিশ্ব এবং সেভাবেই বিশেষ শক্তি পরিণত হয় গ্যালাক্সি, ক্লাস্টার, নক্ষত্র সহ যা কিছু আছে আমাদের চোখে দৃশ্যমান এবং বাকীটুকু ইতিিহাস…
তথ্যসূত্রঃ curiosity.com