রাজা-রানীদের নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেক দিনের। তাদের লাইফস্টাইল, চরিত্র, রাজ্য শাসন করার কায়দাকানুন,ব্যক্তিগত জীবন ইত্যাদি নিয়ে জানার আগ্রহ কমবেশি সবার মধ্যেই থাকে। তাহলে জেনে নেয়া যাক এমন কিছু বিখ্যাত রানীর ইতিহাস।
১.স্কটল্যান্ডের রানী মেরি
স্কটসের রানী মেরি যিনি খুব সম্ভবত স্কটল্যান্ডের রাজকীয় ইতিহাসের সর্বাধিক পরিচিত ব্যক্তি। তার জীবনে ট্র্যাজেডি, রোম্যান্স কোন অংশে নাটকীয়তার চেয়ে কম ছিলো না।
তার বাবা স্কটল্যান্ডের কিং জেমস মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে ১৫৪২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তাৎক্ষণিকভাবে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির ছেলে প্রিন্স এডওয়ার্ড এর সাথে মেরির বিবাহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে স্কটিশরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নারাজ। এই সিদ্ধান্তে কেউই খুশি ছিলেন না। তাই তথাকথিত লোক দেখানোর জন্য এবংনিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্য ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি যুদ্ধের ডাক দেয়। যার নাম দেয়া হয় “Rough Wooing“। তিনি ভেবেছিলেন এই যুদ্ধে তাদের শক্তি দেখে যদি স্কটিশরা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে!
এই ঘটনার মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ১৫৪৮ সালে ফ্রান্সের প্রিন্স ডাউফিন এর নববিবাহিতা স্ত্রী হয়ে মেরি ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। ফ্রান্সে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিলো প্রোটেসট্যান্ট ইংল্যান্ডবাসীর হাত থেকে ক্যাথোলিক গোষ্ঠীকে রক্ষা করা। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ১৫৬১ সালে ডাউফিন, একজন কিশোর প্রিন্স মারা যাওয়ায় অল্পবয়সী মেরি বিধবা হয়ে পড়েন এবং নিজ দেশ স্কটল্যান্ডে ফিরে আসেন।
এই সময়ে স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন নিয়মকানুন, রীতিনীতির সংশোধন করা হচ্ছিলো এবং পাশাপাশি ক্যাথোলিক জনগোষ্ঠীও আলাদা হয়ে যাচ্ছিলো। মেরি আবেগের বশে হেনরি লর্ড ডার্নলির প্রেমে পড়েছিলেন। তবে তাদের সম্পর্ক সফল হয় নি। ডার্নলি একজন দুর্বল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং দিনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মদ্যপ অবস্থায় থাকতেন। যার কারণে মেরিকেই পুরোপুরি একা রাজ্য শাসন করতে হতো। ডার্নলির মাতলামোর কারণে তাকে দেশের কোন সত্যিকারের কর্তৃত্ব দেয়া হয়নি।
মেরির খুব কাছের একজন ছিলেন মেরির সেক্রেটারি ডেভিড রিক্সিয়ো যাকে নিয়ে ডার্নলির হিংসে হতো। ঈর্ষান্বিত হয়েই ডার্নলি ও তার সঙ্গীরা মিলে হলিরুড হাউসে মেরির সম্মুখেই রিক্সিয়োকে হত্যা করে। তখন মেরি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
মেরির স্বামী লর্ড ডার্নলি পরে এডিনবার্গে রহস্যজনক উপায়ে মারা গিয়েছিলেন। ১৫৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি যে বাড়িটি ভাড়া রেখেছিলেন তা এক রাতেই বোমা বিস্ফোরণ করে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিস্ফোরণের পরে তার লাশ বাড়ির বাগানে পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু ধারণা করা হয় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল।
ডার্নলির মৃত্যুর পর আরও প্রাণচাঞ্চল্যকর ঘটনা উঠে আসে। মেরি তখন জেমস হেপবার্ন (Earl of Bothwell) প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আদালতে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি তার দ্বারাই গর্ভবতী হয়েছিলেন। ফলে ডার্নলির হত্যার অভিযোগে জেমস হেপবার্নকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তবে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিলো। তিনি খালাস পাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই মেরি এবং হেপবার্ন বিয়ে করেছিলেন। মণ্ডলীর লর্ডস অফ কংগ্রেগেশন হেপবার্নের সাথে মেরির বিয়েকে অনুমোদন দেন নি। এমনকি মেরিকে লেভেন ক্যাসেলের কারাগারে বন্দী করা হয়। বন্দী কারাগারেই তিনি যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।
মেরি কারাগারে বন্দী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে হেপবার্ন মেরিকে বিদায় জানিয়ে ডানবারে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর আর কখনো মেরি ও হেপবার্ন এর দেখা হয় নি। জানা যায় হেপবার্ন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং ১৫৭৮ সালে সে অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
১৫৬৮ সালের মে মাস এর দিকে মেরি লেভেন ক্যাসলের কারাগার থেকে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান।
[প্রথম এলিজাবেথ এবং কুইন মেরি]
ইংল্যান্ডে গিয়ে মেরির ভাগ্যে নেমে এলো আরও বিপদ এবং শেষমেশ ভয়াবহ মৃত্যু। জানা যায় ইংল্যান্ডের প্রথম রানী এলিজাবেথের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এমনকি মেরির কাছ থেকে এমন কিছু চিঠিপত্র পাওয়া গিয়েছিলো যা এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো যে তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ফলে মেরি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন দুর্গে ১৯ বছর ধরে কারাবাসে ছিলেন। তাকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দোষী বলে মনে করা হয়েছিল।
মেরিকে ফাদারিংহায় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং সেখানেই ১৫৮৭ সালে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কথিত আছে যে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরে যখন জল্লাদ উৎসুক জনতাকে মেরির চুল ধরে তার বিচ্ছিন্ন গর্দান দেখাচ্ছিলেন তখন চুল থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো। ফলে সাথে সাথেই মেরির দেহকে পিটারবোরো ক্যাথেড্রালে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
১৬০৩ সালে এলিজাবেথের মৃত্যুর পরে মেরির পুত্র ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস এবং ৬ষ্ঠ স্কটল্যান্ডের রাজা অধিষ্ঠিত হোন। জেমসের কাছে তার মা মেরির কোনো স্মৃতি ছিলো না। ১৬১২ সালে জেমস মেরির দেহ পিটারবারোর কবরস্থান থেকে থেকে তুলে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সম্মানের সাথে পুনরায় সমধিস্থ করেন। মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে তিনি একই সময়ে রানী এলিজাবেথ এর সমাধিস্থ দেহ তুলে কাছাকাছি অবস্থিত কম সম্মানজনক জায়গায় সমাধি দেন।
রেফারেন্স লিঙ্কঃ history-uk.com
One Comment
ইতিহাসের বিখ্যাত কিছু রানীর জীবনী : ২য় পর্ব | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] ইতিহাসের বিখ্যাত কিছু রানীর জীবনী : ১ম… […]