ছোট কাল থেকে জেনে এসেছি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তাজিওডং। কিন্তু পরবর্তী সময়গুলোতে জানতে পেরেছি বাংলাদেশে আরো অনেক পর্বত শৃঙ্গ রয়েছে যা আমরা হয়ত কখনো কল্পনা করতে পারি নি। আজ তাদের মধ্যে একটিকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
কেওক্রাডং
কেওক্রাডং, বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটন স্থান যেখানে প্রতি বছর হাজারো মানুষের সমাগম হয়। কেউ আসে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আর কেউ হয়ত তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে। সকলেরই একটাই উদ্দেশ্য থাকে তাহলো উপর থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা। উপর থেকে যখন দেখতে যাবেন মনে হবে যেন সমুদ্রের মাঝে বড় বড় ঢেউ। পার্থক্য হচ্ছে সমুদ্রে নীল জলরাশির ঢেউ আর পাহাড়ের উপর সবুজ গাছপালায় মোড়ানো পলি মাটির ঢেউ। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় এমন চিত্র পাওয়া কিছুটা মুশকিলও বটে। তাছাড়া সিলেটের দিকে কিছু পাহাড় রয়েছে কিন্তু সেগুলো তেমন উঁচু পাহাড় নয়। কিন্তু কিছু প্রশ্ন তো মনের মাঝে উঁকি দিতেই পারে। কোথা থেকে আসলো এই পাহাড় পর্বতগুলো? কিভাবে তৈরি হলো আজকের এই কেওক্রাডং? আসুন আজ কেওক্রাডং এর কিছু পুরোনো ইতিহাস জেনে নিই।
কেওক্রাডং এর ইতিহাস
যদিও কেওক্রাডং সম্পর্কে জিওলোজিস্টরা অনেক পরে গবেষণা প্রকাশ করেছেন কিন্তু এটি বিষের দশকে আবিষ্কৃত হয়। কেওক্রাডং এর ইতিহাস আর তাদের বাসিন্দাদের পর্যবেক্ষন করে জানা যায় যে, মহাজন মাঙ্গকিপ হাউহেং এবং তার স্ত্রী কিমহাওয়ি ছাকছাউক সর্ব প্রথম দার্জেলিং পাড়ায় বসতি স্থাপন করেন ১৯৬৬ সালে (দার্জেলিং পাড়া কেওক্রাডং এর শৃঙ্গ থেকে ৪০-৪৭ মিটার নিচে অবস্থিত একটি গ্রাম)। তারা একসময় কাপ্তাই বসবাস করতেন। তাদেরকে সর্বপ্রথম কেওক্রাডং এর আবিষ্কারক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। মহাজন মাঙ্গকিপ হাউহেং ১০১ বছর বয়সে মারা যান এবং তার স্ত্রী কিমহাওয়ি ছাকছাউক ৮০ বছর বয়সে মারা যান।(তথ্য সূত্রঃ কেওক্রাডং এর চূড়ায় মেমোরিয়াল)
কিন্তু কিছু কিছু উপকথা রয়েছে যে ব্রিটিশরা এই সকল পাহাড়ি এলাকা ব্যবহার করতো তাদের নিজেদের প্রয়োজনে। এর জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের টোপোগ্রাফিক ম্যাপ তৈরি করেছিল। (তথ্য সূত্রঃ The British History) কিন্তু কথাগুলোর বাস্তবতা কতটুকু তা জানা খুবই মুশকিল কারণ কেওক্রাডং নিয়ে তেমন তথ্য ইতিহাসের পাতায় নেই।
যেহেতু এখানকার বসতিগুলো বেশি পুরোনো নয়। ৭০ বছর হবে। কিন্তু কেওক্রাডং তো আর ৭০ বছর আগে তৈরি হয় নি। তাহলে কবে তৈরি হয়েছিল এই বিশাল পর্বত শৃঙ্গ?
জিওলোজিষ্টের চোখে কেওক্রাডং
আজ আমরা যে পৃথিবীকে দেখছি তা এমন ছিল না। এখন থেকে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবী ছিল শুধু মাত্র একটা আগুনের গোলক। এই আগুনের গোলককে বা গলিত অংশকে আমরা সকলে লাভা নামেই চিনি (অভ্যান্তরীন গলিত অংশকে ম্যাগমা বলে)। আজ থেকে প্রায় ৩.৫-৩ বিলিয়ন বছর পূর্বে প্রথম ক্রাস্ট (ভূমি) তৈরি হয় (তথ্যসূত্রঃ The plate tectonics theory- Alfred Wegner)।
তারপর থেকে ক্রাস্টগুলো ভাঙতে থাকে আবার পুনরায় তৈরি হতে থাকে। এভাবে এসেছিল প্রথম সুপার কন্টিনেন্ট “উর” যা ৩.১ বিলিয়ান বছর পূর্বে তৈরি হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে আসতে থাকে সুপার কন্টিনেন্ট রডিনা, পেঙ্গিয়া। পেঙ্গিয়া ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল লউরেশিয়া এবং গনওয়ানাল্যান্ড। গনওয়ানাল্যান্ড ভেঙ্গে ইন্ডিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের সৃষ্টি হয়। ১৩২ মিলিয়ন বছর পূর্বে টেকটনিক শিফটের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে থাকে। আর এর মাঝে ভারতীয় মহাসাগর খুলতে আরম্ভ করে। ঐসময় “কারগুলিয়ান হটস্পট” নামক একটি ম্যান্টাল প্লুমের সৃষ্টি হয় যা থেকে ইন্ডিয়ান কন্টিনেন্ট এবং অ্যান্টার্কটিক কন্টিনেন্ট আলাদা হয়ে যায়। বর্তমান থেকে পেছনে গেলে ১২০-৫৫ মিলিয়ন বছরের মাঝে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটে আঘাত করে। এর ফলে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচের দিকে সাবডাক্ট করে। কারগুলিয়ান হটস্পটের কারণে যে শিফট হয়েছিলো তার ফলাফল হিসেবে সিলেট আগ্নেয়গিরি এবং রাজমহল আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়। এটিই এই শিফটের একমাত্র প্রমাণ।
এখন আসি আমাদের বঙ্গোপসাগরের উৎপত্তি নিয়ে। বঙ্গোপসাগর, ভারতীয় প্লেটের উত্তরমুখী হয়ে পাশাপাশি উন্মুক্ত ও প্রসারিত হয়েছে প্রায় ৬ সে.মি./বছর হারে ১২০-৫৫ মিলিয়ন বছরের মধ্যে। স্যাটেলাইট থেকে পরিমাপ করে দেখা গিয়েছে বঙ্গোপসাগরের ক্রাস্টাল প্লেট প্রতি বছর প্রায় ২ সে.মি. করে সরে যাচ্ছে (তথ্যসূত্রঃ stecklar,2008)। বঙ্গোপসাগরের প্রায় মাঝ দিয়ে “90 east ridge” চলে গিয়েছে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মায়ানমারের পাহাড়ি এলাকাগুলো এর প্রভাবে তৈরি হয়েছে।
বঙ্গোপসাগর খোলা বা জন্ম নেওয়া শুরু হয় আজ থেকে ১২০-৫৫ মিলিয়ন বছর পূর্বের মাঝামাঝি সময়ে 90 east ridge নামক একটি খাদের চওড়া হওয়ার মাধ্যমে। বঙ্গপোসাগরের সামুদ্রিক প্লেট পূর্ব দিকে অবস্থিত বার্মিজ প্লেটের সাথে ধাক্কার পর পূর্ব অংশ (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ ও মায়ানমারের দিকে ভূমি উপরের দিকে ভাজ হয়ে উঠে আসে যাকে আপলিফটমেন্ট বলে। ভূমির মাঝে ভাজটাকে “ফোল্ড অফ দ্যা ক্রাস্টাল ব্লক” বলা হয়ে থাকে। এই ফোল্ডের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্বত শ্রেণীগুলো তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে। ৫৫-১০ মিলিয়ন বছর পূর্ববর্তী সময়ের মধ্যে ব্লকগুলো ফোল্ড হতে থাকে।
এমনকি এখনো সেই ক্রাস্টাল ব্লকগুলো নিজের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। কেওক্রাডং সেই ক্রাস্টাল ব্লকের একটি অংশ মাত্র। কেওক্রাডং এর উচ্চতা আজ যতটুকু আছে ততটুকু ছিল না। তার উচ্চতার বর্তমানের উচ্চতা থেকে প্রায় ২,২০০ ফিট কম ছিল। কারণ হচ্ছে, যত সময় এগিয়ে গিয়েছে বঙ্গোপসাগরের ক্রাস্টাল ব্লক তত অগ্রসর হয়েছিল। তাই ৫৫ মিলিয়িন- ১০,০০০ বছর পূর্ববর্তী সময়ের মাঝে আস্তে আস্তে করে আজকের উচ্চতায় কেওক্রাডং অবস্থান করছে। অবশ্য এর মাঝে প্রাকৃতিক কারণে কয়েকবার এই বিশাল পর্বত শৃঙ্গের ক্ষয় হয়েছে বটেই তবুও আজকের কেওক্রাডং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে।
কেওক্রাডং এর মূল গঠন উপাদান
বাংলাদেশে যতগুলো পাহাড় পর্বত রয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোই পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। মনের মধ্যে প্রশ্ন আসতেই পারে বাংলাদেশের পাহাড়-পর্বতগুলোই কেন আগ্নেয় শিলা বা রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত নয় কেন?
ইন্ডিয়ান ক্রাস্টাল ব্লক ইউরেশিয়ান প্লেটকে আঘাত করার পূর্বে সেখানে হিমালয় বা অন্যান্য পর্বত শৃঙ্গ ছিল না। কিন্তু তখনো সেডিমেন্টেশন হতো (সেডিমেন্টেশন হচ্ছে কোনো পাহাড়ের প্রাকৃতিক ক্ষয়ের পর তার উৎস হতে পানি, বায়ু অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে পলল বা মাটি সমুদ্রে ফেলাকে বুঝায়)। এই পলল বা সেডিমেন্টগুলো আসতো বর্তমান তিব্বতের মালভূমি। যদিও ১২০-৫৫ মিলিয়নের মধ্যে তিব্বতের মালভূমি ছিলো না। তাহলে পলল বা মাটি আসলো কোথা থেকে?
সূত্র লুকিয়ে আছে আজ থেকে প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বের শিফটের ঘটনায়। গনওয়ানাল্যান্ডে তখন প্রচুর সেডিমেন্টেশন হতো যার উৎস ছিলো “শিবুমাসু”। এটা একটি ক্রাস্টাল ব্লক ছিল যার উৎস পাওয়া যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর দিকে। জিওলোজিস্ট রা মনে করেন যে, গনওয়ানাল্যান্ডের পলল এর উৎস হচ্ছে এই “শিবুমাসু”।
একইভাবে ইউরেশিয়ান প্লেটের দক্ষিণভাগে যে ক্রেটনগুলো ছিল, সেখান থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার বিলিয়ন টন মাটি জমা হতো “তেথ্যিস” সাগরের মধ্যে। সেই “তেথ্যিস” সাগর আজকের হিমালয়। একই ব্যাপার ঘটেছিল বার্মিজ প্লেটের উপর। সেখানে প্রচুর পাললিক শিলা জমা হতো। এক পর্যায়ে যখন বঙ্গপোসাগর খোলা শুরু করে তখন বার্মিজ প্লেট ভাজ হয়ে যায় এবং “চট্টগ্রাম হিল ট্যাক্টস” তৈরি হয়। (তথ্যসূত্রঃ প্রফেসর ড. আফতাব আলম খান)
কেওক্রাডংয়ের শিলাগুলো পর্যবেক্ষন করে দেখা যায়, শিলাগুলো একসময় সামুদ্রিক পরিবেশে ছিল (পানির নিচে)। পরবর্তী সময়ে তা উপরে চলে আসে এবং অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে। তারপর থেকে তাদের রং হলদে সোনালি হয়ে যায়। এছাড়া কিছু শিলা পাওয়া গিয়েছে যেগুলো কিছুটা ধূসর রঙয়ের। কারণ এগুলো অনেক বেশি সময় ধরে পানির নিচে ছিল আর অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে পারে নি। ভূমি ধস বা এরূপ কোনো কারণে এরা প্রকৃতিতে উন্মুক্ত হয়ে আছে।
কেওক্রাডংয়ের শিলার মাঝে অনেকগুলো সেডিমেন্টের স্তর দেখা যাবে। এক একটি স্তর এক একটি সময়কে নির্দেশ করে। কিন্তু সবগুলো পাহাড়ই টারশিয়ান যুগে গঠিত। কারণ এদের গঠনে যে সেডিমেন্ট গুলো পাওয়া যায় তা একমাত্র টারশিয়ান যুগে পাওয়া যেতো।
বর্তমানের কেওক্রাডং
আজকের কেওক্রাডংয়ের উচ্চতা ৯৮৬ মিটার (৩২৩৫.২৭ ফিট)(তথ্যসূত্রঃ স্যাটেলাইট ডাটা, ১১ মার্চ, ২০২০)। এটি বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত। এই উপজেলা আরো বিভিন্ন সৌন্দর্যে মুখরিত থাকে নীলাচলের পাহাড়, বগালেকের মত জলরাশি, পাহাড়ি এলাকার জনজীবন। এই ৯৮৬ মিটারের ইতিহাস তৈরি হতে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন বছর লেগেছিল। কঠিন পাললিক শিলাগুলো তৈরি হতে সমুদ্রের উপর থেকে নিচে আবার উপরে আসতে হয়েছিল। আজ আমরা সেই সৌন্দর্য ১০-১২ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে দেখতে পারছি। অপরূপ এই সৌন্দর্যগুলো এসেছে অপরূপ বিজ্ঞানের মাধ্যমে। আর সেই বিজ্ঞানের শুরু আমাদের এই পৃথিবী সৃষ্টির মাধ্যমে।
খোদা হাফেজ
One Comment
বাাংলাদেদের অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদগুলো এবং তাদের উৎপত্তিস্থল | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] কেওক্রাডং এর উৎপত্তি […]