রেডিওকার্বন ডেটিং সাধারণত কার্বন ডেটিং বা কার্বন-১৪ ডেটিং ও বলা হয়। এটি কার্বনের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ C-14 এর তেজস্ক্রিয় ধর্ম কাজে লাগিয়ে কোন বস্তু যাতে জৈব পদার্থ উপস্থিত আছে তার বয়স নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি।
উইলার্ড লিব্বি ( Willard Libby) ১৯৪০ সালে এই পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন এবং ১৯৬০ সালে তার কাজের জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। এটি মূলত এই বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, বায়ুমণ্ডলে মহাজাগতিক রশ্মির ( Cosmic Ray) সাথে বায়ুমণ্ডলীয় নাইট্রোজেনের বিক্রিয়ায় কার্বনের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ C-14 তৈরি হয়। এই কার্বন (C-14) বাতাসের অক্সিজেনের(O) সাথে যুক্ত হয়ে তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই-অক্সাইড(CO2) তৈরি করে। যা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে গাছপালা কর্তৃক শোষিত হয় এবং প্রাণীরা এই উদ্ভিদ খাওয়ার মাধ্যমে প্রাণীদেহে এই তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রবেশ করে। কিন্তু যখন উদ্ভিদ ও প্রাণী মারা যায় তখন তাদের এই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ ওই উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ আর বৃদ্ধি পায় না। আবার তেজস্ক্রিয় কার্বন যেহেতু তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাই মৃত্যুর পর থেকে ওই উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের তেজস্ক্রিয় কার্বনের পরিমাণ ক্রমাগত কমতে থাকে। কার্বনের এই কমে যাওয়ার হার এবং দেহে অবশিষ্ট কার্বনের পরিমাণ থেকে ওই উদ্ভিদ বা প্রাণী কখন মৃত্যু বরণ করেছে তা নির্ণয় করা যায়। উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের নমুনা যত বয়স্ক হয় সেখানে তেজস্ক্রিয় কার্বনের পরিমাণ ও তত কম পাওয়া যায়। C-14 আইসোটোপের অর্ধায়ু প্রায় ৫৭৩০ বছর অর্থাৎ কোন নমুনা পরিমাণ C-14 থেকে তার অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে প্রায় ৫৭৩০ বছর সময় লাগে। তাই এই প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ৫০,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত কোন তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব।
উদ্ভিদ এবং প্রাণী জীবিত অবস্থায় পরিবেশ থেকে বায়ুমণ্ডলের মাধ্যমে অথবা খাবারের মাধ্যমে C-14 গ্রহণ করতে থাকে ফলে উদ্ভিদ এবং প্রানীর দেহে C-14 এর পরিমান পরিবেশে উপস্থিত C-14 এর সমানুপাতিক থাকে এবং সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্ষেত্রে এ পরিমান সমুদ্রের পরিবেশের সমানুপাতিক। যখন এরা মারা যায় তখন এরা C-14 গ্রহণ করা বন্ধ করে কিন্তু এদের দেহের C-14 এর তেজস্ক্রিয় ক্ষয় চলতে থাকে তাই এদের দেহে C-14 এর পরিমান কমতে থাকে। এখন C-14 এর ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার হার আমরা জানি এবং এই সমীকরণের সাহায্যে নির্নয় করতে পারি।
এখানে N0 হলো মূল নমুনায় উপস্থিত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের সংখ্যা এবং N হলো t সময় পর ওই নমুনায় অবশিষ্ট আইসোটোপের সংখ্যা। λ হলো একটি ধ্রুবক সংখ্যা এটি প্রত্যেক আইসোটোপ এর জন্য একটি ভিন্ন মানের হয়।এটি ওই আইসোটোপের গড় আয়ুর ( নমুনার সম্পূর্ন আইসোটোপ শেষ হতে যে সময় লাগে) উপর নির্ভর করে এবং তার বিপরীত সংখ্যা হয়। C-14 এর গড় আয়ু প্রায় ৮২৬৭ বছর।
এখন এই সমীকরণটিকে এভাবে লেখা যায় ।
এই সমীকরণে যদি আমরা N0 অর্থাৎ নমুনার মুল আইসোটোপ এর সংখ্যা এবং t সময় পর অবশিষ্ট আইসোটোপের সংখ্যা N বসায় তাহলে কত সময়( t) ধরে ওই নমুনাটি ক্ষয় হয়ে N সংখ্যক আইসোটোপে পরিণত হয়েছে তা আমরা নির্নয় করতে পারি।
ধরুন আমরা কোন একটি প্রানীর মৃতদেহ খুজে পেলাম এবং পরীক্ষার মাধ্যমে তার দেহে এখন কত C-14 আইসোটোপ আছে (N) তা নির্নয় করলাম তাহলে উপরের সমীকরণ অনুযায়ী ওই প্রানীটি কখন মারা গিয়েছিল তা বের করতে হলে আমাদের ওই প্রানী মৃত্যুর সময় তার শরীরে কি পরিমান C-14 ছিল ( N0 ) তা নির্নয় করতে হবে। কিন্তু ওই প্রানীর মৃত্যুর সময় তার শরীরে কি পরিমান C-14 ছিল তা আমরা এখন কিভাবে জানবো?
এর জন্য একটি পদ্ধতি আছে, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবী যে সময় পার করছে এবং পৃথিবী যে পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে সেই সময়কালকে কয়েকটি ভাগে ( কালে) ভাগ করা হয়েছে। এবং কোন কালে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কি পরিমান C-14 উপস্থিত থাকতে পারে তার একটি আনুমানিক ধারনা করা হয়েছে। এখন ওই ধরনের প্রানী কোন সময়কালে পৃথিবীতে ছিল তা আমরা জানি। তাহলে ওই প্রানীর দেহে N0 এর মান আমরা ধারণা করতে পারি কারণ কোন উদ্ভিদ বা প্রানী দেহে তার পরিবেশে সমানুপাতিক C-14 আইসোটোপ থাকে যা আমরা আগেই জেনেছি।
তাহলে ধরুন আমরা যে প্রানীর মৃত্যুর সময় হিসাব করছিলাম সেটি মৃত্যুর সময় তার দেহে দশ লক্ষ (N0=1000000) C-14 আইসোটোপ ছিল এবং আমরা তার দেহাবশেষে দশ হাজার( N=10000) C-14 আইসোটোপ পেলাম তাহলে উপরের সমীকরণ থেকে আমরা t এর মান পাবো প্রায় ৩৮০৭০ বছর অর্থাৎ ওই প্রানীটি প্রায় ৩৮০৭০ বছর পূর্বে মারা গিয়েছিল।
উল্লেখ্য , এই পদ্ধতি যে শতভাগ নির্ভুল এমন নয়। এই পদ্ধতির ও সমালোচনা রয়েছে। এটি একটি যৌক্তিক পদ্ধতি মাত্র ।