চন্দ্রায়ন-২, চাঁদের অচেনা অংশের সন্ধানে

চাঁদের বুকে মানুষ হেটে বেড়িয়েছে সেই কবে। কিন্তু নিকট দশকে তেমন কোন সাড়াজাগানো চন্দ্রাভিযান হয়নি, কেন হয়নি সেটা না হয় তোলা থাকলো পরের জন্যে।

আমরা ফিরে আসি আমাদের চন্দ্রায়ন-২ এ, যা দিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ চাঁদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে, এতদিন চীন, রাশিয়া আমেরিকা করেছিল, এখন ভারত ও তাদের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। বাংলাদেশ অবশ্য এখনো সে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি এখনো। অদূর ভবিষ্যৎের জন্যে আশাবাদী আমরা।

যাই হোক আমরা আজকে জানবো কিভাবে এই অভিযান পরিচালিত হবে, কি লাভ ভারতের এত টাকা খরচ করে, বিশ্ব কেন তাকিয়ে আছে এর সফলতার দিকে, আর কিভাবেই বা ইসরো এত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে নাসার উন্নয়নের গতি থমকে আছে ইত্যাদি নিয়ে।

ট্রাভেল পাথ

১৩ বছর আগে এই রকেট পাঠানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকা সিই-টুয়েন্টি ইঞ্জিন ব্যবহার করতে বাধা দেয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। প্রায় তিন দশক নিয়ে ধরে এই প্রজেক্ট নিয়ে হয়েছে গবেষণা। ইসরোর এই সাফল্যই খুলে দেবে ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্র অভিযান চন্দ্রায়ন-২ এর পথ। যেখানে চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের।

এই অভিযান হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। সেই অভিযানে ভারতকে সাহায্য করার কথা ছিল রাশিয়ার। ঠিক ছিল যে ল্যান্ডার চন্দ্রপৃষ্ঠে সফট ল্যান্ডিং করবে সেটি তৈরি করবে রাশিয়া। কিন্তু, শেষ মূহূর্তে ২০১১ সালে রাশিয়া জানিয়ে দেয়, তাঁদের পক্ষে ওই ল্যান্ডার তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই ভারত একা ওই মিশন সম্পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক হয় ইসরোই ল্যান্ডার তৈরি করবে চন্দ্রযান ২-এর। আর সেইসব প্রস্তুতি শেষ করতেই সামান্য দেরি হয়ে যায় ভারতের। গত ১৫ জুলাই ওই যানটি প্রথমবারের মতো উৎক্ষেপণের চেষ্টা চালানো হয়। তবে উৎক্ষেপণের ৫৬ মিনিট আগে প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

প্রথমে যে সমস্যা হয়েছিল
GSLV Mk III 

  চন্দ্রায়ন-২

অভিযানের নাম চন্দ্রায়ন-২ রাখা হয়েছে,  এর আগে চন্দ্রায়ন-১ নামে একটি অভিযান পরিচালিত হয়েছে ২২ অক্টোবর, ২০০৮ সালে, প্রায় এক দশক আগে।

ল্যান্ডার, রোভার, পলিঅ্যামাইডের তৈরি, দেখতে সোনার মত

প্রায় ৩৮৬কোটি রুপি ব্যয়ে প্রজেক্টটি সম্পন্ন করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠের পাথরের উপাদান, লুনার আইস ওয়াটার, রাসায়নিক উপাদান ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করা, কিভাবে চন্দ্র তৈরি হয়েছিল এবং বর্তমান অবস্থায় আসতে কি কি ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সেদিকটায় আলোকপাত করার লক্ষ্যে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তবে এটি চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেনি। চন্দ্রযান-১ রাডার ব্যবহার করে চাঁদে পানির খোঁজ চালায়।

মাত্র ৩১২ দিন মেয়াদকালে এই মিশন তার ৯৫% লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে,যা ভারতের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রয়েছে।সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে চন্দ্রায়ন -২ অভিযান পরিচালিত করা হল গেল ২২্জুলাই, ২০১৯ যা সেপ্টেম্বর এর ৭ তারিখে চন্দ্রপৃষ্ঠে সফট ল্যান্ডিং করবে।

অন্ধপ্রদেশের সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার, শ্রীহরিকোটা, থেকে GSLV Mk III  রকেটের সাহায্যে নিক্ষেপ করা হয় ৩৮৫০ কেজি ভরের মহাকাশযান কে। ৬৪০ টন ওজনের রকেটটির আনুষ্ঠানিক নাম জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেইকেল মার্ক– ৩ (জিএসএলভি এমকে- ৩), যা মূলত ‘বাহুবলী’ নামেই পরিচিত, ইসরোর সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট,। এই রকেটটি ৪৪ মিটার দীর্ঘ বা একটি ১৫ তলা ভবনের সমান লম্বা। তবে এটি উৎক্ষেপণ নিয়ে ইসরোর বিজ্ঞানীরা এখনো উদ্বিগ্ন। একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, বাহুবলীর ওজন ৬৪০ টন। এত বড় রকেটের নিচের অংশের থেকে মাটির ফাঁক খুব বেশি থাকবে না। তাই উৎক্ষেপণ একশ’ শতাংশ নিখুঁত হতে হবে।

প্রায় ৯৭৮ কোটি রুপি বাজেট ছিল এর জন্যে যার মধ্যে ৬০৩ কোটি মহাকাশ অংশে আর বাকি ৩৭৫ কোটি রকেটের নিক্ষেপণ খরচ। ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১২০টি শিল্পক্ষেত্র থেকে আর্থিক সাহায্য এসেছে বলে জানিয়েছেন কে শিবন। চাঁদের পথে পাড়ি দিতে চলা মহাকাশযানটির ওজন ৩.৮ টন আটটি হাতির সমান। । ১৬ দিন ধরে যাত্রা করবে চন্দ্রায়ন-২।

সম্পূর্ন বিশ্লেষন

 এবার ১ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে পরিচালীত এই চন্দ্রাভিযান সফল করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের পর চতুর্থ দেশ হিসাবে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের ইতিহাস গড়তে পারবে ভারত। চলতি বছরের শুরুতেই চাঁদে যান ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেছিল ইজরায়েল। কিন্তু চাঁদের খুব কাছাকাছি এসে ভেঙে পড়ে এই যান।

তিনটি অংশ নিয়ে স্পেসক্রাফটটি তৈরি করা হয়েছে যার মধ্যে একটি অরবিটার, যা প্রদক্ষিণ করবে, একটি সফট ল্যান্ডার যা রোভার টিকে বহন করে চাদের মাটিতে নিরাপদে অবতরণ করতে সাহায্যে করবে।

গঠন

ইসরোর ‘মিশন চন্দ্রযান-২’-এর এক বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ বলছেন, এতে ব্যবহার করা সোনা আসলে ‘পলিমাইড’ (যা ‘পলিঅ্যামাইড’ বা ‘পলিইমিড’ও হয়) এবং অ্যালুমিনিয়ামের একটি মিশ্র ধাতু বা সংকর ধাতু (অ্যামালগ্যামেট)। যার সামনের দিকটায় রয়েছে পলিমাইড পদার্থ। আর পেছনের দিকটায় রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম।

কোন অংশ কি করবে এই মিশনে

অরবিটার টি ভারতের ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক এর সাথে যোগাযোগ করে এবং এর একটি ল্যান্ডার আছে, যার নাম রাখা হয়েছে ভিক্রম(রোভারসহ যার ভর ১৪৭১কেজি) এবং ৬৫০ওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন রোভারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে।

পাশাপাশি প্রজ্ঞান নামে ৬চাকা বিশিষ্ট ২৭ কেজি ভর সম্পন্ন রোভার রয়েছে যা ৫০ ওয়াট সোলার পাওয়ারে চলে এবং ৫০০মিটার পর্যন্ত যেতে পারে, গতিবেগ ১সেন্টিমিটার /সেকেন্ড বেগ নিয়ে।

এই ছিল এর কথাবার্তা। এবার এর উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু কথা:

– মূল উদ্দেশ্যে হল চাদের মাটিতে কিভাবে সফট ল্যান্ডিং করা যায় সেটা প্রদর্শন করা,সাথে লুনার টপোগ্রাফি, মিনেরোলজি, উপাদানের প্রাচুর্যতা, লুনার এক্সোস্পিয়ার, ওয়াটার আইস ও হাইড্রোজেল এর উপস্থিতি নিশ্চিত করে পরীক্ষা করে রেজাল্ট পৃথিবীতে প্রেরণ করা।

চাঁদের যে অংশে এই যান যাবে, সেখানে এর আগে কোনও দেশের যান পৌঁছতে পারেনি। মহাকাশবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভারতের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করবে এই অভিযান।এখন পর্যন্ত যতগুলো চন্দ্রযান চাঁদে গেছে, সেগুলোর বেশির ভাগই চাঁদের উত্তর মেরুতে অবতরণ করেছে। তবে চন্দ্রযান-২ প্রথমবারের মতো চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করার প্রত্যাশা করছে। চাঁদে পানি ও খনিজ পদার্থের খোঁজ করা চন্দ্রযান-২–এর প্রধান লক্ষ্য।

অরবিটার, ল্যান্ডার ও রোভার নামে তিনটি আলাদা অংশ আছে চন্দ্রযান-২–এর। অরবিটারের কাজ চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি নেওয়া। বিক্রম নামে ল্যান্ডারের কাজ চাঁদে মাটির খোঁজ করা। আর প্রজ্ঞান নামে রোভারের কাজ পৃথিবীতে বিশ্লেষণের জন্য চাঁদের ছবি ও তথ্য পাঠানো।

সোলার অ্যারে ব্যবহার করে ব্যাটারি চার্জ করে কাজ চালাবে

চন্দ্রযান-২-এর সঙ্গে থাকছে ‘বিক্রম’, ল্যান্ডার। চাঁদের কক্ষপথে গিয়ে চন্দ্রযান-২ ছুঁড়ে দেবে বিক্রমকে চাঁদের দিকে। চন্দ্রযান-২ থেকে আলাদা হয়ে ল্যান্ডার বিক্রম নেমে পড়বে চাঁদের পিঠে। চাঁদের ভূমিকম্প ও চাঁদের তাপমাত্রা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ করবে এটি। পাশাপাশি প্রজ্ঞান নামের ২৭ কিলোগ্রামের ছয় চাকার চলমান যানের মাধ্যমে চাঁদের মাটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।

৬ সেপ্টেম্বর চাঁদে অবতরণ করবে বিক্রম নামে চন্দ্রযানের ল্যান্ডার অংশটি। হিসেব মতো, রওনা দেয়ার ৫৪ দিন পরে চাঁদে পৌঁছনোর কথা।

এবার নাসা বনাম ইসরো নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাকঃ

বিষয়বস্তু নাসা ইসরো
ধরণ মহাকাশ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা গবেষণামূলক সংস্থা
স্বতন্ত্রতা কম, বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বানায় বেশী, যেহেতু নিজেদের রকেট,লঞ্চিং ভেহিকল নিজেরাই বানায়
বার্ষিক বাজেট প্রায় ১২১৪.৩৪ বিলিয়ন ডলার প্রায় ১০০বিলিয়ন ডলার
মিশন সংখ্যা ২০০ মনুষ্যবাহী, ১০০০ মনুষ্যবিহীন মিশন সম্পন্ন করেছে, যার মধ্যে ২ টি ব্যর্থ ৮৪ টি মহাকাশযান মিশন,৫৯ টি লঞ্চ মিশন, যার মধ্যে ৮টি ব্যর্থ, ৮ টি আংশিক সফল
মিশনের ধরণ রিসার্স বেসড উন্নয়নকেন্দ্রীক
কর্মী বহুদেশের মেধাবীদের নিয়ে গঠিত বেশিরভাগ ই ভারতীয়
মিশনের সফলতার দিক দিয়ে ইসরো চেয়ে পিছিয়ে ৯৩% সাক্সেস রেট
মার্স অর্বিটার মিশন খরচ মাভেন মিশন, ৬৭২মিলিয়ন ডলার মঙ্গলায়ন মিশন, ৭৪মিলয়ন ডলার মাত্র
হেভি লিফটিং ক্যাপাসিটি ইসরোর চেয়ে বহুগুনে বেশী তুলনামূলক কম
নেভিগেশন সিস্টেম জিপিএস আইআরএনএসএস
কমার্শিয়াল স্যাটেলাইট লঞ্চ এর দিক দিয়ে পিছিয়ে এগিয়ে
খরচের দিক দিয়ে নাসা পিছিয়ে ইসরো এগিয়ে
দক্ষতার হার কম বেশী
বেষ্ট মিশন অ্যাপোলো মিশন মঙ্গলায়ন, চন্দ্রায়ন-২

দুটো প্রতিষ্ঠানের ধরণ আলাদা হওয়ার পরেও আমরা তাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখানো চেষ্টা করেছি মাত্র। উভয়েই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সেরা, এটা মানতেই হবে।

একটি মিশনে ভারত যে ভাবে ১০৪টি স্যাটেলাইট সফল ভাবে মহাকাশে পাঠিয়েছে, তাতে নিঃসন্দেহে মহাকাশ গবেষণায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। ঘণ্টায় ১৭০০ মাইল গতিবেগের রকেট থেকে rapid fire-এর ধরনে ১০৪টি স্যাটেলাইট নিখুঁত ভাবে মহাকাশে স্থাপন করতে কতটা পারদর্শিতার প্রয়োজন হয়, তা ইসরো দেখিয়ে দিয়েছে। সামান্য এদিক-ওদিক হলে স্যাটেলাইটগুলোর নিজেদের মধ্যে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থেকে যায়।

এই ছিল আমাদের আজকের মূল আলোচনা।

সোর্সঃ

Comments are closed.