কানের কাছে ছোট্ট মশার গুণগুণ শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও, চিকুনগুনিয়া নামক মহামারী তে বাঙালী অভ্যস্ত ছিলো না! হ্যা, ইদানীং চিকুনগুনিয়া বঙ্গদেশে মহামারীর আকার ধারণ করেছে। এর প্রকোপ এতই ভয়ঙ্কর হয়ে পড়েছে যে, ঢাকা মহানগরীতে প্রতি ১১ জনে ১ জন লোক চিকুনগুনিয়াতে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকুনগুনিয়া সাধারণত একটি ভাইরাসের নাম। তবে বর্তমানে এই ভাইরাসের উপসর্গগুলোকে চিকুনগুনিয়া বলা হচ্ছে।
চিকুনগুনিয়া নামক এই ভাইরসটি সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৫২ সালে তানজানিয়া নামক আফ্রিকান দেশে। চিকুনগুনিয়া শব্দটির অর্থ ‘কোমর বাঁকা’ কারণ, এর সংক্রমণে হাড়ের জোড়া বা সন্ধিতে এত ব্যথা হয় যে, রোগীকে কোমর বাঁকা করে হাটতে হয়। চিকুনগুনিয়া বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ধরা পড়ে ২০০৮ সালে। কিন্তু এর অস্তিত্ব হয়তো আরো আগে থেকেই ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রকোপ বিস্তার করছে জোরালো ভাবে। তাই আজ চিকুনগুনিয়া নিয়ে এতো মাতামাতি।
চিকুনগুনিয়া মূলত একটি মশাবাহিত ভাইরাস বা রোগ। এই ভাইরাসটি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করে। এডিস(Aedes) গণের দুটি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবপ্টিকাস এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত। এর প্রকোপ অনেকটা ডেঙ্গুর ন্যায়। ডেঙ্গুর মতোই চিকুনগুনিয়া এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। মানুষ ছাড়াও বানর , পাখি , তীক্ষ্ণ দন্ত প্রাণী যেমন ইঁদুরে এই ভাইরাসের জীবনচক্র বিদ্যমান। এখানেই ডেঙ্গু ভাইরাসের সাথে এর পার্থক্য কারণ ডেঙ্গু ভাইরাস শুধু স্তন্যপায়ীদের আক্রান্ত করে।
জ্বর-ফুসকুড়ি-গিরাব্যথা থাকলে এবং রক্তে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেন নেগেটিভ থাকলে চিকুনগুনিয়া হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হয়। জ্বরের প্রথম সপ্তাহে রক্ত পরীক্ষা করে ও তারপর আইজিএম অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করা সম্ভব। তবে এখনো আমাদের দেশে হাতে গোনা খুব কম সংখ্যক ল্যাবরেটরি তে এই পরীক্ষা হয়।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস টোগাভাইরিডি পরিবারের আলফাভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত একটি RNA ভাইরাস। এটি সেমলিকি ফরেস্ট ভাইরাস কমপ্লেক্স এর সদস্য এবং রস রিভার ভাইরাস, ও’নিয়ং’নিয়ং ভাইরাস ও সেমলিকি ফরেস্ট ভাইরাসের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। যেহেতু এটা আর্থ্রোপড যেমন মশার মাধ্যমে ছড়ায় তাই একে আর্বোভাইরাস ও বলে।
এই ভাইরাসের সুপ্তিকাল ২-১২ দিন, তবে বেশিভাগ ক্ষেত্রে তা ৩-৭ দিন হয়। অনেক সময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। সাধারণত ৭২-৯৭% ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা দেয়। রোগটি সাধারণত আকস্মিক উচ্চমাত্রার জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা ও ফুসকুড়ি নিয়ে শুরু হয়। ফুসকুড়ি রোগের শুরুতেই দেখা দিতে পারে তবে অনেক সময় রোগ শুরু হওয়ার দুই থেকে তিন দিন পর জ্বর কমতে শুরু করলে ফুসকুড়ির আবির্ভাব হয়। এছাড়া অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, পেটব্যথা, ফটোফোবিয়া বা আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা, কনজাংটিভাইটিস । বড়দের আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টে প্রদাহ হতে পারে। এই লক্ষণ বা উপসর্গগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার জন্য কোনো অনুমোদিত প্রতিষেধক পাওয়া যায়নি। তবে ঘুমানোর সময় নিয়মিত মশারির ব্যবহার চিকুনগুনিয়া কে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা যেতে পারে। মশা নিয়ন্ত্রণ ও ঘুমানোর সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, লম্বা হাতলযুক্ত জামা ও ট্রাউজার পরে থাকা, বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে না দেয়া ইত্যাদি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধু স্ত্রী মশা দিনের বেলা কামড়ায়। এরা একবারে একের অধিক ব্যক্তিকে কামড়াতে পছন্দ করে। একবার রক্ত খাওয়া শেষে ডিম পাড়ার পূর্বে তিন দিনের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।এদের ডিমগুলো পানিতে এক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।অল্প পরিমাণ জমে থাকা পানিও ডিম পরিস্ফুটনের জন্য যথেষ্ট।এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে তাই বালতি, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার প্রভৃতি স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এভাবে চিকুনগুনিয়া থেকে চাইলেই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।