4chan ( www.4chan.org) নামের অদ্ভুত একটি ওয়েবসাইট আছে। নাম পরিচয় গোপন করে যে কেউ যা খুশী ছবি আপলোড দিতে পারে। তো একদিন হঠাৎ করেই সে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক ছবি ঝড় তুলে দিলো সমস্ত ওয়েব জগতজুড়ে।
সেদিন ছিলো ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি। সিকাডা বা ঘুগড়া পোকার সংকেত দেয়া একটি ম্যাসেজ প্রকাশিত হলো হঠাৎ-
অর্থাৎ,
একটি ছোট্ট ধাঁধার পরীক্ষার মাধ্যমে তারা অতি বুদ্ধিমান কিছু মানুষজন খুঁজে পেতে চায়। এবং ছবির মাঝেই লুকিয়ে আছে সে ধাঁধার উত্তর। উত্তর খুঁজে পেলেই দেখা করার সুযোগ মিলবে গোপন এই চক্রটির সাথে!
ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়।এবং রোমাঞ্চকরও বটে। ক্রমেই এই ধাঁধা সিরিজটা ইন্টারনেটে “cicada 3301” নামে পপুলার হয়ে গেলো।এবং জুটে গেলো বহু কৌতূহলী মানুষজন।তারা একদম উঠে পড়ে লাগলো এই ধাঁধা সিরিজ সমাধানের জন্য।কিন্তু সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছিলো না একজনও!
তারপর কোন একদিন জুয়েল এরিকসন নামের এক যুবক হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে বসলেন অদ্ভুত মজার এক বিষয়।টেক্সট এডিটর এ ছবিটা আপলোড করতেই গোপন এক কোড বের হয়ে আসলো।
কোডটাতে ক্লিক করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি হাঁসের ছবি এবং সেই সাথে একটি লেখা –
“Woops! Just decoys this way. Looks like you can’t guess how to get the message out.”
অর্থাৎ, সে অসফল হয়েছে সঠিক তথ্য বের করতে।
কিন্তু দমে গেলেন না এরিকসন। নতুন উদ্যমে নেমে পড়লেন আবার ধাঁধা সমাধানের জন্য। এবং এবার পেয়ে গেলেন সঠিক জিনিসটি।
কোড ব্রেক করে Reddit নামের এক ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়লেন তিনি। পাওয়া গেলো “the mabinogion ” নামের মধ্যযুগীয় কাব্যমালার সমন্বয়ে রচিত একটি পুস্তক।
পুস্তকটিও এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললেন এরিকসন।ঘেঁটেঘুঁটে বের করলেন আরও কিছু গোপন কোড। এবং সে কোড থেকে বের হলো একটি অব্যবহৃত নাম্বার (214-390-9608)!
নাম্বারটিতে কল করতেই শোনা গেলো আগে থেকেই রেকর্ড করে রাখা একটি ভয়েস ম্যাসেজ –
” চমৎকার! অনেকদূর চলে এসেছো তুমি! বেশ বুদ্ধি আছে দেখছি তোমার!
এবার প্রথম ছবিটিতে ফিরে যাও। সেখানে লুকিয়ে আছে তিনটি সংখ্যা।
প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে – ৩৩০১।
বাকি দু’টো বের করার দায়িত্ব তোমার। এরপর তিনটি সংখ্যা একত্রে গুণ করে গুণফলের পর. com বসিয়ে দিলেই চলে যেতে পারবে তোমার পরবর্তী ধাঁধার জগতে।
গুড লাক।
এবং শুভ বিদায়। ”
বেশ বিরক্ত হলে এরিকসন।কিন্তু হার মানলেন না তিনি।
মাথা খাঁটিয়ে পাতিহাঁসের ছবির দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ বের করলেন। তারপর সিকাডার নির্দেশ অনুযায়ী ৩৩০১ এর সাথে গুণ দিয়ে গুণফল বের করলেন।ভাগ্য সহায় হলো তার।
তার সামনে উন্মোচিত হয়ে গেলো আর একটি রহস্যময় ওয়েবসাইট। সেখানে সিকাডার বহুল পরিচিত ছবির নিচে একটি ঘড়িতে সময় গণনা হচ্ছিলো দ্রুতগতিতে । এরিকসন ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলেন ঘড়ির ডিজিট শূন্যতে নামা পর্যন্ত
তারপর ঘটলো এক অবাক কাণ্ড।
হঠাৎ করেই পুরো ওয়েবসাইটের চেহারা বদলে গেলো। সিকাডার মথ গায়েব হয়ে গেলো।এবং তার জায়গাটা দখল করে নিলো কয়েকগুচ্ছ সংখ্যাধাঁধা। চতুর এরিকসন সংখ্যাগুলো দেখেই বুঝতে পারলেন, জিপিএস যন্ত্রের সাহায্যে বের করা ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক এসব। তিনি মানচিত্র বের করে জিপিএস স্থানাঙ্ক মিলিয়ে দেখলেন,
স্পেন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং পোল্যান্ডের বিভিন্ন স্থান নির্দেশ করা আছে সেই স্থানাঙ্কগুলোতে। কিন্তু তার পক্ষে এতগুলো দেশ ভ্রমণ করা সম্ভব নয় একদমই।
তাই বেঁছে নিলেন অন্যপথ। তিনি সিকাডা সমাধানকারীদের নিজস্ব ব্লগে চোখ রাখতে লাগলেন।
স্থানীয় সিকাডা সমাধানকারীরা সেই স্থানগুলোতে একটি টেলিফোন বুথের স্তম্ভে সিকাডা চিহ্ন সম্বলিত একটি কিউ আর কোড যুক্ত পোস্টার আবিষ্কার করলো।
সেই কোড স্ক্যান করে পাওয়া গেলো আর একটি বই এর লিঙ্ক।এবং বইটি থেকে বের হয়ে এলো আর একটি ওয়েবসাইট!
এরিকসন উত্তেজিত ভঙ্গিতে ঢুকে পড়লেন ওয়েবসাইটটিতে এবং হতাশ হলেন ভীষণভাবে।
কারণ প্রথম কয়েকজন ধাঁধা সমাধানকারীদের খুঁজে পাবার পর বাকি সবার প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছে তারা!
এরিকসন না পারলেও অনেকেই সেই লিংকে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। তাদের সবাইকে সমাধান করতে হয়েছিলো আরও কিছু জটিল ধাঁধা রহস্যের। তারপর একসময় বের হয়ে আসে কিছু সংখ্যক বিজয়ী।তাদের নিয়ে ডার্ক-ওয়েবে বসে এক গোপন বৈঠক।
গোপন সে বৈঠকের পর হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় সিকাডা। এবং আর কখনও যোগাযোগ করেনি তার বিজয়ীদের সাথে।
কিন্তু পরের বছরগুলোতে ঠিকই নিয়ম করে ফিরে আসতো সে তার নতুন ধাঁধার জাল নিয়ে! খুঁজে বেড়াতো কাঙ্ক্ষিত বিজয়ীদের।
রহস্যময় এই সিকাডাকে নিয়ে নানান মানুষের নানান মতামত।অনেকেই বলে এটা ইলুমিনাতির সাথে জড়িত। আবার অনেকেই বলে গোপন কোন হ্যাকারদের সংস্থা এটা।
অনেকে তো স্রেফ বইয়ের মার্কেটিং ট্রিক্স বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলো সিকাডাকে।
কিন্তু বাস্তবে সিকাডা আসলে কি? কি এর উদ্দেশ্য? কারা নিয়ন্ত্রণ করে এটা? আর কেনোই বা খুঁজে বেড়ায় তার বিজয়ীদের?
এর উত্তর জানা নেই কারও। যতদিন পর্যন্ত সিকাডা নিজে থেকে এসে তার পরিচয় উন্মোচন করবে না, ততদিন পর্যন্ত এ রহস্য অমিমাংসিতই থেকে যাবে।
তবে সিকাডা রহস্যের পেছনে যে অতি বিত্তশালী এবং অতি বুদ্ধিমান কারও হাত আছে,তা নিয়ে সংশয় নেই একদমই। কারণ সিকাডা ধাঁধা রহস্যের বহু ক্লু কায়দা করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিশ্বের বহু দেশে। বিত্তশালী না হলে এটা সম্ভব নয় কিছুতেই।
আর সিকাডার পাজলের জালগুলিও ভীষণরকমের আলাদা। কবিতা, শিল্পকর্ম, সঙ্গীত, অনুমাননিভর্র কথাসাহিত্য, অষ্টাদশ শতকের অজ্ঞাত এবং রহস্যময় সাহিত্য, মায়ান ক্যালেন্ডার, দর্শন, গণিত, ক্রিপ্টোগ্রাফি, প্রযুক্তিবিদ্যা, তথ্য নিরাপত্তা, স্টেগেনোগ্রাফি এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপি- কি নেই এর মাঝে! যেনো সব কিছুর মিশেল এই সিকাডা।
আর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যাপার হলো এই ধাধার সূত্রপাত ইন্টারনেটে হলেও এর কার্যক্রম কিন্তু পরিচালিত হয় টেলিফোনে, সঙ্গীতে, অপ্রকাশিত এবং দুস্প্রাপ্য কিছু বইতে, ডিজিটাল ছবি এমনকি বিভিন্ন জায়গায় ছাপানো কাগজের মাধ্যমেও! কিন্তু এর সবটাই লুকানো হয়েছে এনক্রিপশন এবং এনকোডিং করে। এই ধাধার সিরিজগুলো শুধুমাত্র কম্পিউটারে বসে সমাধান করা যাবে না, এর জন্য প্রতিযোগীকে যেতে হবে বিভিন্ন জায়গায়। ধাধার সূত্রগুলো কিউআর কোড হিসেবে লাগানো থাকে টেলিফোন/ইলেকট্রিক পোল অথবা ডাকবাক্সে। এর জায়গা ইউএস, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া, জাপান, পোলাণ্ড, মেক্সিকো এবং দক্ষিণ কোরিয়া-তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানানভাবে।প্রতিটি ধাধা এবং সূত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ে এবং পর্যায়ক্রমে শেষ করতে হয়। এতে কোন ধরণের ভুল গ্রহণযোগ্য নয় একদমই!
কি অদ্ভুত!
আর কি রোমাঞ্চর,তাই নাহ?
আরও একটা মজার ব্যাপার আছে সিকাডার।সময়ের ব্যাপারে বড্ড সতর্ক সে।প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি সময়েই উঁকি দেয় ওয়েব জগতে। যেমন :
সিকাডা প্রথম এসেছিলো ৪ জানুয়ারি ২০১২ তে।
এরপর দ্বিতীয়বার এলো ২০১৩ এর ৪ জানুয়ারি।
তৃতীয়বার ও তাকে প্রথমবার দেখা গেলো ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি।
২০১৫ তে হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলো সিকাডা। মানুষ ভেবেছিলো হয়তো আর পাজল আপলোড করবে না। খুঁজে বেড়াবে না কেউ রহস্যময়ভাবে তার বিজয়ীদের।
কিন্তু নাহ! পরেই বছরই আবার ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফিরে এলো সিকাডা সবার মাঝে! এবং আপলোড করে ফেললো আর একটি রহস্যময় পাজল!
Leave a Reply