বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জীব সৃষ্টি প্রক্রিয়া: ক্লোনিং

ক্লোনিং শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কোন জীব থেকে সম্পূর্ণ অযৌন প্রক্রিয়ায় হুবহু নতুন জীব সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্লোনিং। ক্লোনিং শব্দটি এসেছে “ক্লোন ” থেকে। যার অর্থ অনুরূপ প্রতিলিপি। আর এই ক্লোন তৈরির প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্লোনিং। ড. আয়ান উইলমুটকে ক্লোনিং এর জনক বলা হয়। ১৯৯৬ সালে উইলমুট তার ২৭৩ তম প্রচেষ্টায় প্রথম ক্লোনিং পদ্ধতিতে সৃষ্ট ভেড়া ডলিকে প্রাণ দিতে সক্ষম হয়। তার এরূপ সৃষ্টি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ডলির নামকরণ করা হয় বিখ্যাত গায়িকা ডলি পার্টনের নাম অনুসারে এবং ডলির সাঙ্কেতিক নাম ছিল 6LL3

তবে প্রথম ক্লোন মানব সৃষ্টিতে সফলতা অর্জন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানব গবেষণা কেন্দ্র ক্লোনেইড। ২০০২ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইভ নামক একটি কন্যা শিশু জন্মদানে সক্ষম হয় এই মানব গবেষণা কেন্দ্রটি যাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে ক্লোনেইডের প্রধান ব্রিজিট বোইসেলিয়া।

ক্লোনিংয়ের প্রকারভেদ :

কাজের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি তিন প্রকার ক্লোনিং উদ্ভাবন করেছেঃ

১। মলিকিউলার ক্লোনিং

২। রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং

৩। থেরাপিউটিক ক্লোনিং

মলিকিউলার ক্লোনিং:

এ পদ্ধতিতে একটা নির্দিষ্ট ডিএনএ অণুর অনুরূপ আরেকটি ডিএনএ অণু তৈরি করা হয়, এ কারণে এটিকে অনেক সময় ডিএনএ ক্লোনিং বা জিন ক্লোনিং ও বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রথমে কোন কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ অণুকে নির্দিষ্ট স্থানে কাটা হয়, এরপর, উক্ত (খণ্ডিত ও কাঙ্ক্ষিত) ডিএনএ অণুকে কোন ভেক্টরের (এক ধরনের বৃত্তাকার ডিএনএ অণু যা ব্যাকটেরিয়ার কোষের অভ্যন্তরে পাওয়া যায় এবং এটাকে সাধারণত প্লাজমিড বলা হয়) সাথে জুড়ে দেওয়া হয়, এরপর সেটি পুনরায় ব্যাকটেরিয়ার দেহে প্রবেশ করানো হয়। এখন ব্যাকটেরিয়ার কোষ বিভাজনের সাথে সাথে প্লাজমিড তথা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ অণুটিও কপি হতে থাকবে। প্রাকৃতিক ভাবে আমাদের প্রতিটি কোষেও এই ধরনের ক্লোনিং প্রক্রিয়া চলছে আর এজন্যই আমাদের প্রতিটি কোষের ডিএনএ পুরোপুরি অভিন্ন। তবে PCR এর মাধ্যমে এটা পরীক্ষাগারেও করা সম্ভব। কোন কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ নিয়ে কাজ করার সময় এই ক্লোনিং করা হয়।

রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং:

এ ক্ষেত্রে একটা পুরা জীবকেই ক্লোন করা হয়, অর্থাৎ সূক্ষ্মভাবে বললে কোন জীবের সম্পূর্ণ জিনোম কেই ক্লোন করা হয়। রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিংয়ে উপরে উল্লেখিত সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। মানব ক্লোনিংও একই পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। আমরা সাধারণত ক্লোনিং বলতে এটাকেই বুঝি। হলিউডের সাম্প্রতিক সাইন্স-ফিকশন মুভি গুলোতে আমরা এই ধরনের ক্লোনিং দেখে থাকি। এটাকে আবার অর্গানিজম ক্লোনিং ও বলে।

থেরাপিউটিক ক্লোনিং:

এটাও অনেকটাই রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং এর মতই, তবে এক্ষেত্রে শুধু ভ্রূণ কে পূর্ন বিকাশিত করা হয়না এবং ভ্রূণকে গর্ভাশয়ে স্থাপন না করে ল্যাবরেটরিতে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়। নিষিক্ত ডিম্বাণু বিভাজন শুরু করার কয়েকদিন পর এটা থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয়। এ ধরনের ক্লোনিং এর প্রধান উদ্দেশ্য হল স্টেম সেলের উপর গবেষণা করা এবং দেখা হয় যে গবেষণাগারে কৃত্রিম ভাবে এই সেল কে অন্য ধরনের সেলে রূপান্তরিত করা যায় কিনা কারণ এটি যদি সম্ভব হয় তাহলে যে সব রোগ বিভিন্ন কোষের কারণে হয়ে থাকে সেগুলো কৃত্রিমভাবে রূপান্তরিত কোষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে, ফলশ্রুতিতে রোগটা নিরাময় করা সম্ভব হবে, যেমনঃ আলঝেইমার, যা কিনা নিউরন কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীদেহের সকল ধরনের কোষ তৈরি হয় স্টেম সেল থেকে তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ক্লোনিং বলতে আমরা বুঝি…

একটা প্রাণীর হুবহু প্রতিলিপি কিন্তু ক্লোনিং পদ্ধতিতে তৈরি করা প্রাণী কি আসলেই পুরোপুরি পূর্বের প্রাণীর মত হবে ? না হবেনা, জিনগত দিক থেকে তো অবশ্যই নয়। কারণ, এক্ষেত্রে আমরা দাতার দেহ কোষ থেকে শুধুমাত্র নিউক্লিয়াস তথা ক্রোমোজোমটাই নিচ্ছি, অপরদিকে, অন্য প্রাণী থেকে প্রাপ্ত ডিম্বাণু থেকে শুধুমাত্র নিউক্লিয়াসটি বাদ দিচ্ছি কিন্তু ডিম্বাণুতে মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে যাচ্ছে – মাইটোকন্ড্রিয়াতেও ডিএনএ বা জিন আছে এবং সেগুলো খুব দুর্লভ কিছু ক্ষেত্রে ফিনোটাইপিক ইফেক্ট দিতে পারে। সত্যি বলতে কি! মাইটোকন্ড্রিয়া কে বাদ দিয়ে ক্লোনিং করা সম্ভবও না কারণ মাইটোকন্ড্রিয়া কোষের সকল শক্তির উৎস – মাইটোকন্ড্রিয়া কে অপসারণ করলে কোষটি মারা যাবে। তাই ক্লোন তার দেহের প্রতিটা মাইটোকন্ড্রিয়া ওই ডিম্বাণু থেকেই পেয়ে থাকে। সবথেকে মজার বিষয়, সেক্সুয়াল রিপ্রোডাকশনের (যেহেতু, শুক্রাণুর নিউক্লিয়াস সম্বলিত মাথাটাই শুধুমাত্র ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করে) ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে – অর্থাৎ, আমরা আমদের দেহের সব মাইটোকন্ড্রিয়া আমাদের মাতার কাছ থেকে পেয়েছি, তারাও পেয়েছে তাদের মায়ের কাছ থেকে।

মাতার গর্ভের পরিবেশও জীবের অনেক কিছুই নির্ধারণ করে যেমন, মানসিক বিকাশ। ক্লোন করা জীব কে ফিনোটাইপিক দিক থেকে দেখলেও কিছু অসাদৃশ্য দেখা যেতে পারে, যেমন মানব শিশুর ক্ষেত্রে আঙ্গুলের ছাপ (এটা মাতার গর্ভের পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়) । সুতরাং, দাতার জিনোমের সাথে নতুন উৎপন্ন ক্লোনের জিনোমের একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য থেকেই যায়। তাই আপাত দৃষ্টিতে কোন ক্লোনকে ১০০% একই রকম দেখতে হলেও আসলে জিনগত দিক থেকে তারা পুরোপুরি হুবহু প্রতিলিপি নয়। তবে, প্রকৃতিতে আপনা-আপনিই সম্পূর্ণ সদৃশ ও নিখুঁত ক্লোন তৈরি হতে পারে – মোনোজাইগোটিক টুইন বা সদৃশ যমজ কারণ এক্ষেত্রে তাদের মাইটোকন্ড্রিয়া জিনোম ও একই।

তবে মানব ক্লোনিং সৃষ্টি সমাজ জীবনের জন্য হুমকিস্বরুপ তাই বিশ্বের অনেক দেশেই মানব ক্লোনিং সৃষ্টিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>