ডাইনোসরের রং

কখনো কি জাদুঘরে গিয়েছেন? আপনার উত্তর যদি হয় হ্যাঁ। তবে আপনি অবশ্যই সেখানে কিছু বিশাল প্রানির কঙ্কাল সাজানো দেখেছেন। পাশে হয়তোবা সে প্রানির কিছু চমৎকার রঙ্গিন ছবিও দেখেছেন । আবার যখন আপনি “জুরাসিক পার্ক” অথবা “জুরাসিক ওয়ার্ল্ড” ছবি দেখেছেন তখন সেখানে নানা আকৃতি ও রং এর ডাইনোসর দেখেছেন এবং হয়ত মনে মনে ভেবেছেনও ,আহা ! মানুষের কল্পনার জগৎ কত বিস্তৃত, কিন্তু আসলেও কি এই আকৃতি ও রং মানুষের কল্পনার ফসল ? নাকি বিজ্ঞানের এক মজার খেলা?

আর তা জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে ফসিল কি ?

ফসিল শব্দটা প্রকৃতির এক বিশাল ক্ষেত্র জুড়ে বিরাজ করে । ফসিল হলো কোন  উদ্ভিদ, প্রানি বা পোকা-মাকড়ের সংরক্ষিত  ধ্বংসাবশেষ যা হাজার বা কয়েক লক্ষ বছর আগে মাটির নিচে চাঁপা পরেছিল অথবা দুর্ঘটনাবশত আম্বার এর মধ্যে আঁটকে গিয়েছিল।

ফসিল 

ফসিল অনেক ধরনের হতে পারে ,তবে প্রধান পাঁচ ধরনের ফসিল হল :

যার নাম প্রথমেই আসবে “মিনারালাইজেশন” এটি এমন একটি পদ্ধতি ,যখন জীবন্ত কোন বস্তু বা বস্তুর দেহাবশেষ মাটি বা বালির নিচে চাঁপা পড়ে যায় অথবা কোন নদীর প্রবাহের মধ্যে পড়ে যায় , তবে তখন সেই পানির মধ্যে যে নানা ধরনের মিনারেল বা খনিজ পদার্থ থাকে তা ঐ বস্তুর দেহের আসল উপাদান গুলোকে সরিয়ে সেটাকে প্রায় পাথরের মতো করে ফেলে।

দ্বিতীয়তে আসে ,  “কার্বনাইজেশন” . যখন কোন জীবন্ত বস্তু কোথাও আটকা পড়ে যায় এবং সময়ের বিবর্তনে অধিক চাপে তা সংকোচিত হয়ে যায়। সংকোচিত হবার সময় তা থেকে প্রথমে সকল ধরনের উদ্বায়ী রাসায়নিক পর্দাথের নিঃশেষ হয় , এরপর লিপিডের পলিমারাইজেশনের মাধ্যমে বস্তুটি একটি পাতলা পর্দার মত বস্তুতে পরিনত হয় । যা  স্থিতিশীল, পলিমারাইজড কার্বন অণু দ্বারা নির্মিত । তাই একে কার্বনাইজেশন ফসিল বলে।

Mold and Cast” যখন কোন প্রানি মারা যায় এবং সেখানে তার ধ্বংসাবশেষ থাকেনা কিন্তু সে ধ্বংসাবশেষের একটি ছাপ পড়ে। পরবর্তীতে সে ছাপ মাটির খনিজ পদার্থ দ্বারা পূর্ণ হয়ে , এক ধরনের ছাঁচের সৃষ্টি করে এবংপরবর্তীতে তা ফসিলে রূপ নেয় ।

অনেক সময় এ ছাঁচ কোন বস্তুর ধ্বংসাবশেষের না হয়ে হয়ত কোন প্রানির পায়ের ছাপ বা গড়িয়ে যাবার পথ হতে পারে। আর এই পদ্ধতিতে ফসিলে রূপান্তরিত হলে তখন তাকে “ট্রেস ফসিল” হিসাবে গন্য করা হয়।

সর্বশেষ  হলো “Original Materials” এটি এমন এক ধরনের ফসিল যা কোন প্রানির সম্পূর্ন দেহের আসল উপাদান গুলোকে ফসিলাইজড করে ফেলে । এই ধরনের ফসিলের সবচেয়ে বড় উদহরন হলো মমি । মমি তৈরির সময় মানুষ সবসময় চেষ্টা করে যেন সে প্রানির যতটুক সম্ভব দেহের আসল উপাদান সমূহগুলো অক্ষত থাকে । এর আর একটি উদাহরনের চিত্র হয়ত জুরাসিক পার্ক ছবির সেই মশার মাধ্যমে বুঝতে পারি, যা একটা পাথরের মধ্যে আটকে ছিল এবং যার থেকে সব কিছুর শুরু হয়েছিল।

সেই পাথরটি হলো আম্বার (Amber)। যার ভেতর কোন ক্ষুদ্র জীব বছরের পর বছর অক্ষত অবস্থায় থাকতে পারে। ফলে পাথরের মাঝে জীবের অস্তিত্ব আমরণ থেকে যায় আর এখান থেকেই ফসিলের সৃষ্টি। জুরাসিক পার্ক মুভিতে আমরা আম্বারের মাঝে আমরা একটি মশার অস্তিত্বকে পেয়েছিলাম।  

ডাইনোসরের রঙের সন্ধানে 

এতক্ষন ধরে ফসিল সম্পর্কে পড়ার পর হয়ত একটু ভাবতে পারেন , যে এর সাথে ডাইনোসরের রং সম্পর্ক কি ?

আর তা জানতে হলে আমাদের যেতে হবে প্যালিয়নটোলজি  (paleontology) বা জীবাশ্ম বিজ্ঞানের পৃথিবীতে ।

প্যালিয়নটোলজি  হল এমন একটি বিজ্ঞান যেখানে জীবাশ্ম বা ফসিল নিয়ে পড়া এবং গবেষণা করা হয় , এবং যারা করেন তাদের প্যালিয়ন্টোলজিস্ট বলা হয় ।

অনেকের ধারণা প্যালিয়ন্টোলজিস্টরা সবসময় হাড় নিয়ে গবেষণা করেন কিন্তু না , সব প্যালিয়ন্টোলজিস্টরা হাড় নিয়ে  গবেষণা করেন না । অনেক প্যালিয়ন্টোলজিস্ট জীবাশ্ম অনুজীব নিয়ে , কেউবা আবার জীবাশ্ম উদ্ভিদ বা অমেরুদন্ডী প্রানী নিয়ে গবেষণা করেন।

প্যালিয়ন্টোলজিস্টরা তাদের নানা ধরনের অনুসন্ধানের মাধ্যমে কোন প্রানির সম্পূর্ন আকৃতিও তৈরি করেন । যেমন আমরা জাদুঘরে যে বিশাল বিশাল ডাইনোসরের কঙ্কাল কাঠামো দেখি তা কিনতু কখনই সেভাবে আবিষ্কৃত হয়নি । এমন কি এখন পর্যন্ত কোন সম্পূর্ন ডাইনোসরের কঙ্কাল পাওয়া যায়নি ।

কখনো হয়তো কোন ডাইনোসরের পায়ের একটা হাড় পাওয়া গিয়েছে , কখনো বা চোয়াল ,দাঁত , মেরুদন্ডের কোন অংশ পাওয়া গিয়েছে । তাহলে তারা এমন বিশাল বিশাল আকৃতি তৈরি করল কিভাবে?

যখন প্যালিয়ন্টোলজিস্টরা কোন ডাইনোসরের হাড় খুজে পায় , তখন তারা তা নিয়ে এর ভূতাত্ত্বিক সময় নির্নয় করার চেষ্টা করে । অর্থাৎ ঐ হাড়টি কোন সময়ের তা নির্নয় করার চেষ্টা করেন । এরপর সেসময়ের আবিষ্কৃত সব নমুনার সাথে মিলিয়ে তার চোয়াল ,দাঁত , চেহারার গঠন তৈরি করেন ।

আকৃতি তৈরি হবার পর তারা ঐ ডাইনোসরের রং কি ছিল বা তার কি কোন ধরনের পালক ছিল কিনা তা খুজতে শুরু করেন ।

পাখা বা পালকের জন্য তারা সেই হাড়ের মধ্যে একধরনের ছোট ছিদ্র খোজার চেষ্টা করেন , যেখানে সেই পালক আটকিয়ে ছিল  যাকে “Quill barb” বলে ।

বিজ্ঞানীরা Velocirptor ডাইনোসরের হাড়ে এই “Quill barb” পেয়েছিলেন । এমনকি  প্যালিয়ন্টোলজিস্টরা “Microraptor” নামের একটি মাংসাশী , চার পাখার , কালো রং এর পালক যুক্ত ডাইনোসরের ফসিলে কার্বনাইজড পাখার সন্ধান পেয়েছিলেন ।

প্রশ্ন হলো তাঁরা এই কার্বনাইজড পালক থেকে কি করে এর রং কালো ছিল তা নির্নয় করলেন ?

এর জন্য তারা প্রথমে যা করলেন তা হল , তারা সেই পালকের ফসিলটা কে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাইক্রস্কোপের নিচে নিয়ে পরীক্ষা করার পর খুবই ক্ষুদ্র ন্যানো আকৃতির মেলানোসম সদৃশ বস্তু দেখতে পেলেন । মেলানোসম হলো কোন কিছুর রং হবার জন্য প্রধান উপাদান।

এরপর তাঁরা সে মেলানোসমের এক্সরে পরীক্ষা করলেন এবং সেখানে তাঁরা একধরনের মিনারেল জাতীয় পদার্থ পেলেন যা মেলানিন(Melanin) এর বহুবছরের রূপান্তরিত রূপ ।

এরপর তাঁরা ২০ টি পালক নিল এবং সেগুলোতেও তারা একই উপাদান পেল এর মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিত হলো যে এই ডাইনোসরের সম্পূর্ণ দেহ একই রং এর ছিল ।

এরপর তাঁরা এই মেলানোসম কে বর্তমানের পাখিদেরটার সাথে মিলানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো । কিন্তু প্রত্তেক পাখিরই স্বকীয় রং এর বৈচিত্রতা আছে ।

খুঁজতে খুঁজতে তারা একট ধরনের হাঁসের মধ্যে একধরনের কালো রং এর পালক পেল , যা এক এক অবস্থানে বা আলোর তারতম্যের কারনে রং এর পরিবর্তন হয় । এই রং এর মেলানোসমের গঠন আকৃতির সাথে সেই ডাইনোসরের মেলানোসমের আকৃতিও সম্পূর্ণ মিলে গিয়েছিল , যার থেকে তাঁরা সে ডাইনোসরের রং সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিল ।

আর ঠিক একই ভাবে প্রতিটি ডাইনোসরের রং নির্নয় করা হয় এবং তা প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের কাছে জীবন্ত করে তুলে ধরার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ে যায় অন্য এক কল্পনার রাজ্যে ।

তথ্যসূত্র :

1.  Proceedings of the National Academy of Sciences

2. National Geographic Magazine

3. Royal Society of Chemistry

Comments are closed.