HIV প্রতিরোধক এন্টিবডি আসবে গরুর রক্ত হতে

HIV ভাইরাসের কথা আমরা সবাই শুনেছি। এই ভাইরাসের ফলে মানুষের এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগ হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞগণ বহুদিন ধরেই খুঁজে চলেছেন এই ভাইরাসের প্রতিরোধককে। এবার হয়তো তাদের পাওয়া গেলো। এই প্রতিরোধক তৈরি করা হচ্ছে গরু হতে।

HIV প্রতিরোধকের সন্ধানে একদল বিশেষজ্ঞ প্রাথমিকভাবে ৪টি গরুর মধ্যে HIV ভাইরাস ইনজেক্ট করেছিলো। পরে দেখা গেলো গরুগুলোর শরীরে দ্রুতই কার্যকরী এন্টিবডি তৈরি হচ্ছিলো। আর সেখান থেকেই আসে আইডিয়া। গরুর দেহ থেকে এখন যদি মানবদেহ উপযোগী ভ্যাক্সিন তৈরি করা যায় তবেই মানবজাতি মুক্তি পাবে এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসের প্রকোপ থেকে।

গরুর দেহের এই এন্টিবডিকে বলা হচ্ছে নিষ্ক্রিয়কারী এন্টিবডি। শুধু HIV নয় বরং আরো প্রায় ৪২ ধরণের ইনফেকশন প্রতিরোধে সক্ষম এই এন্টিবডি। জুলাই মাসের ২০ তারিখেই বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারে অনলাইনে রিপোর্ট করেন।
Johns Hopkins University School of Medicine এর ইমিউনোলজিস্ট Justin Bailey বলেন,

 

এই পদ্ধতি HIV ভাইরাস প্রতিরোধের অন্য যেকোনো পদ্ধতি অপেক্ষা কার্যকরী হবে

 

যদিও তিনি এই গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

HIV এর ভ্যাক্সিন তৈরি করা বরাবরই কষ্টসাধ্য প্রমাণিত হয়েছে। ভাইরাস গুলো সময়ের সাথে সাথে নিজেদের রূপ বদলাতে সক্ষম। কিন্তু দেহের এন্টিবডি তো তার রূপ হঠাৎ করে পাল্টাতে পারে না। সমস্যাটা এখানেই। পৃথিবীজুড়ে এ ভাইরাসের রয়েছে বহু প্রজাতি। মানবদেহ কোন একটি প্রজাতির জন্য এন্টিবডি তৈরি করলেও বাকি প্রজাতির বেলায় সেটা আর কাজে আসে না। ইনফেক্টেড দেহেও খুব সহজেই এই ভাইরাস তার রূপ পাল্টাতে পারে। তাই এর আগেও অনেক ধরণের ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হলেও তা খুব একটা কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হয় নি।

HIV আক্রান্ত রোগীদের মাত্র ১ শতাংশ রোগী HIV ভাইরাস নিষ্ক্রিয়কারী এন্টিবডি তৈরিতে সক্ষম। এই এন্টিবডি বেশ কার্যকরীও বটে। তবে একজনের দেহে তৈরি এন্টিবডি আরেকজনের দেহে কাজ করে না। তবে বানরের দেহে HIV ভাইরাসের কাছাকাছি একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই এন্টিবডি দারুণভাবে কাজ করেছিলো।

HIV ভাইরাসকে সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করতে এন্টিবডির বেশ কিছু বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, এন্টিবডিতে দীর্ঘ প্রসারণক্ষমশীল এমাইনো এসিড থাকতে হবে যাকে এন্টিবডি তার সার্ফেস থেকে বের করে দিতে সক্ষম হবে। এন্টিবডি তার এই প্রসারণক্ষমশীল অংশ দ্বারা ভাইরাসের বাইরের অংশ আক্রমণ করে। কারণ প্রায় সব প্রজাতির ভাইরাসের ভেতরের অংশ প্রায় একই থাকে। পার্থক্যটা গড়ে দেয় বাইরের পুরু আবরণ। আর মানব কোষের ভেতরে প্রবেশের জন্য ভাইরাসের তার বাইরের মুক্ত অংশ লাগবেই। HIV ভাইরাসের বাইরের পুরু আস্তরণের সুগার সার্ফেসের ফলে বাইরের অংশকে আক্রমণ করে বেধে রাখা কষ্টসাধ্য। অধিকাংশ এন্টিবডির পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে দীর্ঘ প্রসারণক্ষমশীল এমাইনো এসিডের পক্ষে সম্ভব বলে মনে করা হয়। মলিকিউলার ইমিউনোলজিস্ট ভন স্মাইডার বলেন, “আইনের হাত যেরকম লম্বা, ঠিক সেভাবেই এমাইনো এসিড তার লম্বা হাত দিয়ে এক্ষেত্রে ভাইরাস আক্রমণ করে”।

HIV ভাইরাসের শিকার হওয়া রোগীদের মধ্যে যারা এন্টিবডি তৈরি করতে পেরেছেন, তাদের সেই এন্টিবডি রিজিওনকে বলা হচ্ছে HCDR3। এতে রয়েছে প্রায় ৩০টি এমাইনো এসিড। মানবদেহের অন্য স্বাভাবিক এন্টিবডির তুলনায় এই এন্টিবডি দৈর্ঘ্যে প্রায় দ্বিগুণ। স্মিডারের মতে, “মানবদেহের এই বড় আকৃতির এন্টিবডি গরুর দেহের স্বাভাবিক এন্টিবডির তুলনায় বেশ ছোট”।

বলা হয় জন্মের পর থেকেই একটি গরু স্বাভাবিকভাবেই তার দেহে দীর্ঘ HCDR3 এন্টিবডি তৈরিতে সক্ষম।

স্মিডার ও তার সঙ্গীরা গরুর সিরাম নিয়ে তাদের গবেষণা শুরু করে। টেস্টটিউবে গরুর রক্ত দিয়ে তাদের পরীক্ষা চালাতে থাকে। পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো, গরুর রক্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে কতটুকু কাজ করতে পারে তা নির্ণয় করা। বহু প্রজাতির বহু ভাইরাসের বিরুদ্ধে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তারপর ৩৮১ দিন গবেষণার পর ফলাফল চূড়ান্ত হয়। ১১৭ প্রজাতির HIV ভাইরাসের বিরুদ্ধে শতকরা ৯৬ ভাগ ক্ষেত্রে গরুর রক্তের এন্টিবডি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। সফলভাবেই সেই এন্টিবডি ভাইরাসকে প্রতিরোধ করেছে। গবেষণার কাজে গরুর রক্ত হতে আলাদাভাবে ৬০ টি এমাইনো এসিড বিশিষ্ট একটি HCDR3 এন্টিবডি দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিলো। এটিও ৭২ শতাংশ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।

গবেষকরা যদি গরু দেহ হতে HCDR3 নামের দীর্ঘাকৃতির এই এন্টিবডিকে মানবদেহ উপযোগী করে তুলতে পারে, তবে নিঃসন্দেহে HIV ভ্যাক্সিন তৈরিতে আর বেগ পেতে হবে না। HIV কে ঘাতক ভাইরাসের তালিকা থেকে সরিয়ে দিতে তাত্ত্বিকভাবে আমরা আর মাত্র এক স্টেপ পেছনে। তবে এখন ধারণা করা হচ্ছে গরু হতে যদি আমরা এরকম অসাধারণ এন্টিবডি পেতে পারি, তবে বাকি গবাদিপশু হতেও কিছু পাওয়া যেতে পারে।

দেখা যাক, গবেষকেরা তাদের পরবর্তী গবেষণায় আমাদের জন্য কি নিয়ে আসে।

ধন্যবাদ। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আর বিজ্ঞানের পাশে থাকুন।

 

তথ্যসূত্র: সাইন্সনিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>