বিগত কয়েক বছর ধরে ক্রিস্পার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং জগতের এক মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এটি শিরোনাম হয়ে থাকছে। বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কথা উঠলেই সবার আগে চলে আসে ক্রিস্পার এর নাম। আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হয়ে আছে এই ক্রিস্পার। বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করেন যে, জিন সম্পাদন প্রযুক্তি আমাদের পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আমাদের চারদিকের সমাজে, যেখানে আমরা বসবাস করছি, এবং আমাদের সাথে বসবাসকারী অন্যান্য প্রাণীদের সমাজে এক বিপ্লবের আবির্ভাব হতে পারে এই জিন সম্পাদন প্রযুক্তির দ্বারা। জিন সম্পাদনে ব্যবহৃত আরও নানা প্রযুক্তির মধ্যে ক্রিস্পার (প্রযুক্তিগতভাবে আরও বিস্তারিত বললে ক্রিস্পার-ক্যাস৯) হচ্ছে সবচেয়ে সূক্ষ্ম, সাশ্রয়ী, সহজলভ্য, ব্যবহার করা সহজ এবং এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালীও বটে।
১৯৯০ সালে আবিষ্কারের প্রায় সাত বছর পর সর্বপ্রথম প্রাণ-রাসায়নিক পরীক্ষায় এর ব্যবহার করা হয়। এরপর মনুষ্য জীববিজ্ঞান, কৃষি এবং অণুজীববিজ্ঞানের মত বিভিন্ন গবেষণা ক্ষেত্রে এই ক্রিস্পার খুব দ্রুতই সবচেয়ে জনপ্রিয় জিন সম্পাদন যন্ত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
বিজ্ঞানীরা এখনও ক্রিস্পারের উন্নত ও যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবীকে আরও উন্নত করে গড়ে তুলতে পারি তা নিয়ে চিন্তার একদম আদি পর্যায়েই রয়েছেন। ডিএনএ হচ্ছে আমদের জীব জগতের নীল-নকশা। আমাদের জীবনের সকল রহস্যের মূল গূঢ়লেখ এর ভিতর লুকিয়ে আছে। আমাদের এবং অন্যান্য প্রজাতির, হোক সে প্রাণী অথবা উদ্ভিদ, বা এককোষী থেকে বহুকোষী জীব, সকল প্রকার জৈবিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে এই ডিএনএ। জীব জগতের এই সর্বেসর্বা নিয়ন্ত্রকের অভ্যন্তরে যেকোনো প্রকারের ইচ্ছাকৃত পরিবর্তনে অবশ্যই উদ্বেগ এবং কিছু নৈতিকতার প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে। এই কথা মাথায় রেখেই এই লেখায় ক্রিস্পার কৌশলের সবচেয়ে মজার কিছু ব্যবহারের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে যার মাধ্যমে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। সাথে কিছু প্রতিবন্ধকতার কথাও উঠে আসবে, যেগুলো এই ক্রিস্পার প্রযুক্তিকে তার ব্যবহারের সম্ভাব্য শিখরে পৌঁছার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
যে পাঁচটি উপায়ে ক্রিসপার আমাদের পৃথিবীকে আমূলে বদলে দিতে পারে সেই দিকগুলো হল:
১. হারিয়ে যাওয়া প্রজাতির পুনরাবির্ভাব ঘটিয়ে
২. রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী জিনকে সঠিকভাবে বদলে দিয়ে
৩. রোগ সৃষ্টিকারী সকল অণুজীবকে চিরতরে সরিয়ে দিয়ে
৪. নতুন প্রজাতির স্বাস্থ্যকর খাবার উৎপাদন করে
৫. এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং ক্ষতিকর পোকাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে
নিচে পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রতিটি পয়েন্টের বর্ণনা দেওয়া হল।
১. ক্রিস্পার হারিয়ে যাওয়া প্রজাতির পুনরাবির্ভাব ঘটাতে সক্ষম:
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, হার্ভার্ডের জিনতত্ত্ববিদ জর্জ চার্চ (George Church) ‘অ্যামেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’ (American Association for the Advancement of Science) –এর এক বাৎসরিক সমাবেশের পূর্বে একটি বিস্ময়কর ঘোষণা দিয়ে বসেন। তিনি দাবী করেন যে তাঁর গবেষকদল আর দুই বছরের মধ্যে একটি অভাবনীয় আবিষ্কার সম্পন্ন করতে চলেছেন। সেটি হচ্ছে, তাঁরা হাতি ও ম্যামথ সংকরের ভ্রূণ তৈরি করতে চলেছেন! চার্চ আশা করছেন যে যদি এই লোমশ ম্যামথদের আবার ফিরিয়ে আনা যায়, তবে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। নিউ সায়েন্টিস্ট (New Scientist) –কে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “ম্যামথরা তাদের বিশাল লোমশ শরীরের দ্বারা যে পরিমাণ স্থান দখল করে থাকবে তাতে বরফে উষ্ণ বাতাস সহজে প্রবেশ করার সুযোগ পাবে না এবং অনেক বরফ গলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচবে।”
চার্চ এবং তাঁর দল মনে করছেন যে ক্রিস্পার ব্যবহারেরে মাধ্যমে তাঁরা এশিয়ান হাতি (একটি বিপন্ন প্রজাতি) এবং লোমশ ম্যামথের জেনেটিক বস্তুর মিলন ঘটাতে সক্ষম হবেন। তাঁরা আরও ধারণা করছেন যে এর মাধ্যমে তাঁরা বিপন্ন প্রজাতির এশিয়ান হাতিকেও রক্ষা করতে সক্ষম হবেন। পরীক্ষাটির জন্য প্রয়োজনীয় ম্যামথের নমুনা সাইবেরিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সাইবেরিয়ার তীব্র ঠাণ্ডার অঞ্চলে পাওয়া বরফে জমে থাকা ম্যামথের চুল বা পশম থেকে প্রয়োজনীয় ডিএনএ নমুনা পুনরুদ্ধার করা হয়। ম্যামথের জিনোম এশিয়ান হাতিতে যোগ করার পর যে প্রাণীটির উদ্ভব হবে, ধারণা করা যায় যে তার মধ্যে লোমশ ম্যামথের সেই লম্বা পশমের বৈশিষ্ট্যটি অব্যাহত থাকবে। এই পশম মেরু অঞ্চলের মত তীব্র ঠাণ্ডার অঞ্চলে অন্তরক পদার্থ হিসেবে কাজ করবে। এখন সর্বশেষ লক্ষ্য হচ্ছে এই সংকর ভ্রূণটিকে হাতির গর্ভে স্থাপন করা এবং প্রাণীটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া।
কাজটি সম্ভাবনাময়, অর্থাৎ কাজের অগ্রগতি চলমান রয়েছে। তবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা একটু ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। তাঁরা মনে করছেন যে চার্চ সাহেব একটু বেশি বেশিই ভাবছেন! তাঁদের মতে যদিও গবেষকগণ একটি কার্যক্ষম ও সফল সংকর ভ্রূণ তৈরি করতে সক্ষম হনও, তারপর এই ভ্রূণটিকে চার্চ সাহেবের কথামত একটি কৃত্রিম মাতৃগর্ভে রাখাটা একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেবে যা কাটিয়ে ওঠাটাও ভীষণ কঠিন হয়ে পড়বে।
একটি ব্যাপার একদম পরীক্ষিত যে চার্চ সাহেবের ল্যাব একটি ইঁদুরের পরিষ্ফুটনরত ভ্রূণকে এর গর্ভধারণ সময়ের প্রায় অর্ধেককাল (প্রায় ১০ দিন)পর্যন্ত কৃত্রিম গর্ভে রাখতে সক্ষম। তবে এটা কখনই একদম নির্ভুলভাবে বলা সম্ভব নয় যে, একটি লোমশ সংকর ম্যামথের জন্ম আমরা আগামী দুই বছরের মধ্যেই দেখতে পারব।
২. ক্রিস্পার রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী জিনকে সঠিকভাবে বদলে সক্ষম:
হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Hypertrophic cardiomyopathy , HCM) এক ভয়াবহ ধরনের হৃদরোগ। বিশ্বব্যাপী প্রতি ৫০০ জন মানুষে ১ জন মারাত্মকভাবে এই রোগে আক্রান্ত হন। এর উপসর্গগুলো যন্ত্রণাদায়ক এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রাণঘাতীও বটে। কয়েকটি প্রকট জিনে মিউটেশনের ফলে হৃদপেশি বা হৃদপিণ্ডের টিস্যু শক্ত ও অনমনীয় হয়ে পড়ে। যার ফলে বুকে ব্যাথা, দুর্বলতার মত লক্ষণ দেখা যায়। আর অবস্থা মারাত্মক হলে তা হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে এখন এইচ-সি-এম এর রোগীরাও সাধারণের মতই গড় আয়ুষ্কাল পেয়ে থাকেন। কিন্তু অবহেলা করলে পরিস্থিতি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
তবে একদিন আমরা জিন সম্পাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করে অবশ্যই এই জিনঘটিত রোগটিকে চিরতরে মুছে দিতে পারব, যাতে করে আর কেউ এ রোগে পরবর্তীতে আক্রান্ত হতে না পারে।
২০১৭ সালের এক গ্রীষ্মে, অরিগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির (Oregon Health and Science University) বিজ্ঞানীরা প্রস্ফুটিত মনুষ্য ভ্রূণে ক্রিসপার ব্যবহার করে এইচ-সি-এম এর জন্য দায়ী জিনগুলোর একটিকে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। মোট ৫৪ টি ভ্রূণ, যেগুলো নিষেকের পর ১৮ ঘণ্টা অতিবাহিত করেছে, তাদের মধ্যে ক্রিসপার-ক্যাস৯ প্রবেশ করানো হয়। আর এর ফলাফলও ছিল ইতিবাচক। ৩৬ টি ভ্রূণে কোনো মিউটেশনই পরিলক্ষিত হয় নি (রোগ বিকাশ করার কোনো সুযোগই নেই), এর ১৩ টি ভ্রূণ আংশিকভাবে মিউটেশন থেকে মুক্ত হয়েছে (৫০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে রোগটিকে বংশানুক্রমে বহন করার)।
পরীক্ষিত ৫৪ টির মাত্র ১৩ টি ভ্রূণে টার্গেট জেনেটিক মিউটেশন অচল হয়ে যায় এবং মোজাইক প্রভাব অর্থাৎ টার্গেট জিনকে অচল করে দিলেও তা বাহিত হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পরবর্তীতে এই সম্ভাবনা কমিয়ে আনতে ভ্রূণ কোষগুলোতে অবশ্যই কিছু পরিবর্তন করার প্রয়োজন রয়েছে। এবং বিজ্ঞানীরা এজন্য আরেকটি পরীক্ষা করেন, যেটিতে ভ্রূণের একই জিনকেই ঠিক করা হয়। তবে এবারের পরীক্ষাটি করা হয় সরাসরি নিষেকের পরপরই। এবার তারা এক অত্যাশ্চর্য ফলাফল পেলেন। তারা দেখলেন যে, এবার মাত্র একটিতেই মোজাইক দেখা গেছে! ২০১৫ সালে চীনে এমনই একটি পরীক্ষা করা হয়, কিন্তু তখন বিজ্ঞানীরা মোজাইক প্রভাব দূর করতে সক্ষম হননি। সে তুলনায় অরিগনের বিজ্ঞানীরা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন বলা চলে।
[চলবে…]
তথ্যসূত্র: futurism.com
One Comment
CRISPR এর ভবিষ্যৎ। পর্ব-০২ | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] [গত সংখ্যার পর…] […]