মাকড়সার রস দিয়ে নেশাঃ টারেন্টুলার গল্পকথা

  মাকড়সা তো আমরা সবাই চিনি। খুবই নিরীহ একটি প্রানি। আর আমাদের বাসা বাড়িতে যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলো তো একেবারে নিরীহ। কিন্তু অনেক বিষাক্ত মাকড়সাও রয়েছে যার এক কামড়ে আপনার মৃত্যুও হতে পারে। আজ কথা বলবো টারান্টুলা নামের এক মাকড়সা নিয়ে। এই মাকড়সা নিয়ে গল্পের শেষ নেই। ইটালীর ঐতিহ্যবাহী টারান্টুলা ডান্সের উৎপত্তিও  এই মাকড়সা থেকেই। এমনকি এই মাকড়সার রস/বিষ মাদক হিসেবেও ব্যবহৃত হত। এই সম্পর্কে নিচের দিকে আলোচনা করা হয়েছে। 

টারান্টুলা মাকড়সা

এই মাকড়সাকে উষ্ণ অঞ্চলগুলোতেই বেশি পাওয়া যায়। সাউথ আমেরিকা, নর্থান সাউথ আমেরিকা, সাউথার্ন ইউরোপ, আফ্রিকা, সাউথার্ন এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া। তবে ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি সাউথ আমেরিকার দেশগুলোতে অর্থ্যাৎ ল্যাটিন আমেরিকায়। এরা মূলত Theraphosidae গোত্রের অন্তর্গত। এখন পর্যন্ত এর প্রায় ৯০০টি স্পিশিজ আবিষ্কৃত হয়েছে। এরা আকারে ২.৫ থেকে ১০ সেঃমি পর্যন্ত হয়ে থাকে তবে এদের পায়ের দৈর্ঘ্য ৮ থেকে ৩০ সেঃমি হয় আর গড় ওজন ১৭০ গ্রাম। এই আর্টিকেলে মূলত lycosa tarantula এবং  latrodectus tredecimguttatus স্পিশিজের টারান্টুলা নিয়ে কথা বলা হবে। পরবর্তী অংশে ইটালীতে টারান্টুলা মাকড়সা নিয়ে অনেক কথাই হবে। তো সেই মাকড়সাগুলো এই দুই স্পিশিজের। এদের বেশ শক্তিশালী বিষদাঁত থাকায় এরা দূর হতেও বিষ ছুড়তে পারে। আর সেই বিষ শরীরে আঘাত করলে যদি দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা হয় তবে মৃত্যু অনিবার্য।

টারান্টুলা মাকড়সা

টারান্টুলা ডান্স ও মাকড়সা

ইটালির টারান্টো শহরের নাম থেকে এই মাকড়সার নাম। পৃথিবীর অন্যতম বিষাক্ত একটি মাকড়সা এই টারান্টুলা। তবে এই জন্য তার এতো খ্যাতি নয়।

ইটালীতে এই মাকড়সার আধিক্য অনেক বেশি ছিলো। প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যেতো। এ মাকড়সা কামরালে রোগীকে এক বিশেষ উপায়ে সুস্থ করা হতো। অতি বিষাক্ত হওয়ার কারণে, মাকড়সার আক্রমণের ১০-১৫ সেকেন্ডের মধ্যে শিকার হওয়া ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতো। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি মন্থর হয়ে যেতো। শরীর ঠান্ডা হয়ে যেতো। তখন তাকে সুস্থ করার জন্য কোন বৈদ্য বা ডাক্তার ডাকা হতো না। মিউজিশিয়ান বা সঙ্গীতজ্ঞদের ডাকা হতো। তারা হারমোনিয়াম, বাঁশি, ম্যানডোলিন ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রোগীর ঘরে বিভিন্ন সুর তুলতো।

টারান্টুলার কামড়ে আক্রান্ত রোগীর সুরের মাধ্যমে চিকিৎসা

আগেই বলে রাখি, যাকে টারান্টুলা মাকড়সা কামড়াতো তাকে স্থানীয়রা টারান্টাটা বলে ডাকতো। যাহোক, এভাবে কয়েকটা সুর তুলার পরে রোগী অচেতন অবস্থাতেই পাগলের মতো নাচা শুরু করতো। এভাবে একটানা ২-৪ দিন বাদ্যযন্ত্রের সাথে নাচলে রোগী সুস্থ হয়ে যেতো। মাকড়সার সব বিষ নেমে যেতো। বিষ নামানোর এই পদ্ধতিকে বলা হয় টারান্টিসম। সুস্থ হওয়ার পর কোন রোগীই তার পাগলের মতো নাচের কথা মনে করতে পারতেন না। মোটামুটি ২০শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রোগ সারানোর এই ব্যবস্থা অনুসরণ করা হতো। কিছু অনুন্নত এলাকাতে এখনো এই পদ্ধতি বেঁচে আছে। তবে সুরের সাথে রোগী কেনোই বা নাচতেন আর নাচলেও তাতে বিষ কিভাবে নামতো সেটা আজও একটি রহস্য।

টারান্টিসমের উৎপত্তি একাদশ শতাব্দীতে। তবে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে এই টারান্টিসম ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। উপরের ঘটনাটি সাউথার্ন ইটালীর এক স্থানীয় ডাক্তার কাপুতোর লেখা একটি বই থেকে সংগ্রহ করা। আর কাপুতোর লেখনী অনুযায়ী ঘটনাটি ১৭২৮ সালের।

টারান্টুলার গল্পকথা এখানেই শেষ নয়। ইটালীর টারান্টুলা বেইলী ডান্স পৃথিবী বিখ্যাত আর ইটালীতে অনেক জনপ্রিয়। ইটালীবাসীরা তাদের এই ঐতিহ্যবাহী নৃত্য নিয়ে অনেক গর্ববোধও করে। ইটালীর টারান্টুলা সম্পর্কিত বিভন্ন বইয়ে উল্লেখ আছে, টারান্টুলার আক্রমণে রোগীরা যখন সুরের সাথে নাচতো তখন তারা এক  ভিন্ন ভঙ্গিমায় নাচতো। টারান্টুলা মাকড়সা এক ধরণের তালের সাথে হাঁটাচলা করে থাকে। দেখে মনে হবে মাকড়সাটি নাচছে। রোগীও ঠিক সেভাবে টারান্টুলার হাঁটার মতো করে নাচতো। প্রাচীন ইটালীয়রা বিশ্বাস করতো, টারান্টুলা যখন কাউকে কামড় দেয় তখন তার মধ্যে সেই কামড় দেওয়া টারান্টুলার আত্মা বাস করে। অর্থ্যাৎ রোগীকে ইটালীয়রা টারান্টুলা মাকড়সার একটি রূপ বলে মনে করতো। আর তাদের ধারণা অনুযায়ী এ কারণেই রোগী ওভাবে নাচতো।

ইটালীর ঐতিহ্যবাহী টারান্টুলা নাচের দৃশ্য

ধীরে ধীরে টারান্টুলা মাকড়সার চলনের ধরণ তাদের ঐতিহ্যবাহী নাচে পরিণত হল।

টারান্টুলার রসে নেশা

টারান্টুলার বিষে রোগীর নেচে সুস্থ হওয়ার কথা তো আগে বলেছি। কিন্তু এই বিষয়টি সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমি নিজেও কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম এই কথা শুনে। সঠিক স্থান জানা না গেলেও ধারণা করা হয় স্পেনবাসী সর্বপ্রথম টারান্টুলার রস দিয়ে নেশা করা শুরু করেন। সরাসরি মাকড়সার বিষ সংগ্রহ করে আবার মাকড়ষা মেরে তাকে ছেঁচেও তার রস সংগ্রহ করা হত। বিভিন্ন উৎসবে নারী-পুরুষ সকলেই এই রস পান করতেন আর ব্যান্ডপার্টির মিউজিকের তালে পাগলের মতো নাচতেন। আর এই রসের নেশা অনেকক্ষণ থাকতো। যারা নিয়মিত মাকড়সার রস দিয়ে নেশা করতো তারা খুব অল্পসময়ের মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হতো।  স্পেনে এর যাত্রা শুরু হলেও এক সময় পুরো ল্যাটিন আমেরিকা এই নেশায় বুদ হয়ে যায়। কম-বেশি প্রায় সকল ল্যাটিন দেশেই এই নেশার প্রচলন ছিলো। এখন অবশ্য এই নেশা উঠে গিয়েছে এবং এটি নিষিদ্ধ। প্রস্তুতকৃত রসের বর্ণ লালচে হওয়ায় যখন দোয়াত কালীর প্রচলন ছিলো তখন লাল রঙের কালী বলে দোয়াতে ভরে এই রসের পাচারও করা হতো। তবে নিষাধাজ্ঞার পাশাপাশি এখন এই রস তৈরীর প্রণালীও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

মাকড়সার বিষ থেকে ঔষধ

অনেক কিছুই তো বললাম, তবে শেষ করার আগে কিছু ইতিবাচক কথাও জানানো প্রয়োজন। এতে অবশ্য জানানোর কিছু নেই। কম-বেশি সকলেই জানে। অনেক গবেষকই ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছেন যে, টারেন্টুলার মতো বিষাক্ত মাকড়সার বিষ থেকেও ঔষধ তৈরী সম্ভব। মাসকিউলার ডিসট্রফি, ইউরিনারি ইনকনটিনেন্স, কার্ডিয়াক আর্থিমায়াসের মতো জটিল সব রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব এই বিষ দিয়ে। এদের শরীরে GsMTx4 নামের এক কম্পাউন্ড পাওয়া যায় যা মানবদেহের মেমব্রেনে কোষের ভেতরের রাস্তা ব্লক করতে পারে। বিজ্ঞানীর চেষ্টায় আছেন যাতে এই কম্পাউন্ড দিয়ে কিছু করা যায় কি না। আশা করছি বিজ্ঞানীরা দ্রুতই তাদের গবেষণায় সাফল্য লাভ করবেন।

আজ এপর্যন্তই। ধন্যবাদ।

রেফারেন্সঃ britannica.com, wikipidea, animalcorner.co, spokesman.com, altasobscura.com।

Comments are closed.