বিংশ শতাব্দির যে আবিষ্কারটি কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে যাচ্ছে সেটির ব্যবহারেই হয়তো একসময় কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে।
এন্টিবায়োটিকের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নিজেই এ ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন।
১৯২৮ সালে এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৫ সালে যখন তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় তখন ফ্লেমিং বলেছিলেন,
‘The thoughtless person playing with penicillin treatment is morally responsible for the death of the man who succumbs to infection with the penicillin-resistant organism.’
এন্টিবায়োটিক কী?
এন্টিবায়োটিক হলো এন্টিব্যাক্টেরিয়াল অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বা ইনফেকশন জাতীয় রোগে এন্টিবায়োটিক নেওয়া হয়। ভাইরাসজনিত রোগের বিপরীতে এন্টিবায়োটিক কাজ করে না। একটি এন্টিবায়োটিক একাধিক জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না। ভিন্ন ভিন্ন জীবাণুর বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন এন্টিবায়োটিক সক্রিয়।
এন্টিবায়োটিক দেহে প্রবেশ করার পরে বিভিন্ন জীবাণু এটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। জীবাণুগুলো সাময়িকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিলে আমাদের দেহ সুস্থ হতে শুরু করে। পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার জন্য চিকিৎসকের বিহিত ডোজ সম্পূর্ণ করা আবশ্যকীয়।
এন্টিবায়োটিক কখন কার্যকর হয়?
ব্যাক্টেরিয়া গুলো নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও কোনোরূপ লক্ষন তৈরির আগে মানব দেহের immune system সাধারনত তাদের মেরে ফেলে। যদি লক্ষণ সংঘটিত হয়েও থাকে শ্বেত রক্ত কণিকা (WBCs) ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া গুলোকে আক্রমণ করে এবং immune system তাদের বিপরীতে আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে।
মাঝে মাঝে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যায় ফলে immune system সবার সাথে সম্পূর্ণ লড়তে পারে না। এই অবস্থায় এন্টিবায়োটিক কার্যকর হয়।
এন্টিবায়োটিক কিভাবে শরীরে নেওয়া হয়?
ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা তরল এন্টিবায়োটিক আকারে – যা শরীরের সংক্রমণ মাইল্ড থেকে মোডারেট করতে ব্যবহার করা হয়।
ক্রিম, লোশন, স্প্রে বা ড্রপ হিসেবে- যা চর্ম সংক্রমণ, চোখ ও কান সংক্রমণ এর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
ইনজেকশনস- যার মাধ্যমে এন্টিবায়োটিকটি রক্তে বা পেশীতে সরাসরি পুশ করা হয়। সাধারনত খুব জটিল সংক্রমণে ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়।
এন্টিবায়োটিক কিভাবে কাজ করে?
ব্যাক্টেরিয়া কোষে উপস্থিত কিন্তু মানব কোষে নেই এমন অঙ্গানু আক্রমণ করে এন্টিবায়োটিক কাজ করে। প্রতিটি এন্টিবায়োটিক আবার ভিন্ন উপায়ে কাজ করে।
যেমন-Penicillin ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করে ব্যাক্টেরিয়াল কোষ প্রাচীর বা এর কোষীয় উপাদান তৈরির মাধ্যমে। যেহেতু মানব কোষের কোষ প্রাচীর অবর্তমান।
Erythromycin শ্বাসনালী ও স্কিন সংক্রমণ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি ব্যাক্টেরিয়াল রাইবেজোম ব্লক করে এবং তাদের প্রোটিন তৈরিতে বাঁধা প্রদান করে ব্যাক্টেরিয়াল কার্যক্রম নষ্ট করে।
Ciprofloxacin and Levofloxacin নিমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিস চিকিৎসায় নেওয়া হয়। এটি ব্যাক্টেরিয়ার ডিএনএ অনুকরন এবং এর পুনঃরুদ্ধারে বাধা প্রদান করে ব্যাক্টেরিয়ার কার্যক্রম নষ্ট করে।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কী?
এন্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। কোনো বিশেষ জীবাণুর জন্য যেসব গুণাবলী ওষুধে (এন্টিবায়োটিকটিতে) থাকা প্রয়োজন তা পরিমিত রয়েছে এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণও করা হয়েছে, কিন্তু তারপরও ওই জীবাণুর বিপক্ষে এন্টিবায়োটিকটি কাজ নাও করতে পারে।
কারণ, এন্টিবায়োটিকটি রেজিস্ট্যান্স হারিয়ে ফেলেছে। অনেক সময় দেখা যায়, একটু জ্বর কিংবা ঠান্ডা-কাশি হলে না বুঝেই অসুস্থ ব্যক্তি এন্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলে, আবার অনেকেই ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী এটি সেবন করা শুরু করলেও মাঝপথে গিয়ে খাওয়া বন্ধ করে দেয় বা কোর্স সম্পূর্ণ করে না। যার ফলে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে পড়ে বা তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নোবেল পুরষ্কার গ্রহনের দিন এটাও বলেছিলেন যে,
“Then there is the danger that the ignorant man may easily underdode himself and by exposing his microbes to non-lethal quantities of the drug, make them resistant.”
তাই যখন তখন এন্টিবায়োটিক সেবন করা কিংবা বন্ধ করা উচিত নয়।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কিভাবে প্রতিরোধে করা যায়?
১. চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত ডোজ ও সময় অনুসারে এন্টিবায়োটিক সেবন করুন। সংক্রমণের উন্নতি হলেও এন্টিবায়োটিক সেবন বন্ধ না করে কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে। কিছু এন্টিবায়োটিক আছে খুব দ্রুত বা কয়েক ঘন্টার মধ্যে সংক্রমণের বিরোধিতা করে। তাই বলে ডোজ অসম্পূর্ণ রেখে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না। নয়ত সংক্রমণটি পুনরায় সংঘটিত হবে। তাই কোনো সন্দেহ হলে চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করতে হবে।
২. কিছু এন্টিবায়োটিক আছে যেগুলো খাবার বা পানীয় দ্রব্যের সাথে খাওয়া ঠিক নয়।
কিছু এন্টিবায়োটিক খালি পেটে অর্থাৎ খাবারের ২ ঘন্টা আগে বা ২ ঘন্টা পরে খেতে হয়।
তাই এন্টিবায়োটিক সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারকে জানিয়ে নিতে হবে। ফার্মেসিস্ট বা দোকানদার বললেও হুটহাট ওষুধ খাওয়া যাবে না।
৩. অন্যের ব্যবস্থাপত্র দেখে এন্টিবায়োটিক সেবন কখনই করবেন না। সেই ব্যক্তির অসুবিধার সাথে সাথে আপনার অসুবিধা সম্পূর্ণ এক হলেও আপনাদের দেহের কার্যকলাপ ও ধারন ক্ষমতা এক না।
৪. অতীতে অসুস্থতার জন্য দেওয়া এন্টিবায়োটিক চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আবার ব্যবহার করা যাবে না।
৫. সাধারণত সর্দি-কাশি, ভাইরাস জ্বরে (ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা) এসব রোগে এন্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না।
৬. প্রতিটি এন্টিবায়োটিক এর ভিন্ন ব্যবস্থাপনা আছে। যেমন-Metronidazole এন্টিবায়োটিক গ্রহনকারী এলকোহল পান করতে পারবে না।
–Tetracyclines এন্টিবায়োটিক গ্রহনকারী দুগ্ধজাত দ্রব্য খেতে পারবে না।
সুতরাং এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স রোধে চিকিৎসকের দেওয়া ব্যাবস্থাপত্র সঠিক ভাবে মেনে চলা আবশ্যক।
এন্টিবায়োটিকের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কিরূপ ভয়াবহ?
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি যা ক্যান্সার কিংবা এইডস এর চেয়েও ভয়াবহ।
এন্টিবায়োটিক যেমন সব রোগের জন্য প্রযোজ্য নয় তেমন একই এন্টিবায়োটিক আবার একাধিক রোগের বিপরীতে সক্রিয়ও নয়। রোগী যদি না বুঝে নিজে নিজে ভুল ওষুধ কিনে খায়, রোগ তো সারবেই না, উল্টো মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে এবং রোগ হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি।
ভুল রোগে বা অনিয়মিত এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে হতে পারে –
ডায়রিয়া,
নোওজিয়া, ভমিটিং,
স্টমাক আপসেট,
র্যাশ প্রভৃতি।
নিয়মিত বা দীর্ঘমেয়াদী এন্টিবায়োটিক গ্রহন ঘটাতে পারে মুখ, পরিপাক নালী ও স্ত্রীযোনিতে ফাংগাল ইনফেকশন হতে পারে।
তুলনামূলক কম প্রচলিত কিন্তু জটিল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যেমন-
Sulphonamides গ্রহনে কিডনিতে পাথর গঠন,
Cephalosporins গ্রহনে অস্বাভাবিক রক্তজমাট,
Tetracyclines গ্রহনে সূর্যালোক বা রৌদ্র সংবেদনশীলতা,
Trimethoprim গ্রহনে রক্ত বিশৃঙ্খলা,
Erythromycin এবং Aminoglycosides গ্রহনে বধিরতা। Penicillins, cephalosporins ও erythromycin অন্ত্রপ্রদাহও ঘটায়।
অন্ত্রপ্রদাহ বিশেষ করে বয়স্কদের হতে দেখা যায় যা পরে তীব্র ও রক্তাক্ত ডায়রিয়াতে রুপ নেয়।
কিছু মানুষের এন্টিবায়োটিক (বিশেষত্ব Penicillin) গ্রহনে এলার্জি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যাদের এন্টিবায়োটিক গ্রহনে এলার্জির সমস্যা আছে, তাদের উচিত অন্য রোগের ওষুধ নেওয়ার আগে ডাক্তার কিংবা ফার্মাসিস্টকে কথাটা জানানো। কেননা এলার্জি থেকে তা পরবর্তীতে জটিল ও প্রাণনাশক প্রতিক্রিয়া যেমন র্যাশ, মুখ ও গলা ফোলা, শ্বাসকষ্টে পরিনত হতে পারে। এন্টিবায়োটিক এলার্জির এই ধরনের প্রতিক্রিয়াকে anaphylactic প্রতিক্রিয়া বলা হয়।
এন্টিবায়োটিক এরকম আরো অনেক মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে থাকে। এন্টিবায়োটিককে ঠিক যাতটা প্রাণরক্ষক মনে করি এটি ঠিক ততটাই প্রাণঘাতক।
দূর্ঘটনাবসত হাত পায়ে হওয়া ক্ষত আর কখনোই সারবে না কিংবা শরীরের কোন অঙ্গে ইনফেকশন হলেই ধীরেধীরে তার মৃত্যু নিশ্চিত! এসব কথা এখন হাস্যকর শোনালেও এন্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার ভয়াবহতার দরুন এমনই একসময় ঘটবে।
Leave a Reply