মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু ও শক্তি যথাক্রমে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। এদের কবলে এই মহাবিশ্বের ৯৬ শতাংশ ভর। অথচ এরাই রয়েছে বিজ্ঞানীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরা ব্ল্যাকহোলও নয়। ভূতের ব্যাপারও বিজ্ঞানের চলে না। তবু কেনই বা এই আজগুবি বস্তু আর শক্তির অবতারণা? সেই ইতিহাস বহু পুরনো। বস্তুটির ভর আছে। ভর থাকা মানেই তার প্রভাব ছড়িয়ে থাকে আশেপাশে। থাকবে তার মহাকর্ষ শক্তিও। ভর শক্তির আকারে থাকায় গুপ্ত শক্তি যতই নিজেদের আড়ালে রাখুক, শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা তাদের যাচাই করেছেন মহাকর্ষ বলের কষ্টিপাথরে।
মহাকর্ষ বল যার থাকবে স্থান-কালের জালে তাদের জড়াতেই হবে। সাফল্য বলতে ওইটুকুই। বিজ্ঞানীরা জানেন ডার্ক মেটার ছড়িয়ে আছে মহাবিশ্বের এখানে ওখানে। তবুও তাদের দেখা মিলছে না। কেন ? কারণ কোন এক অজানা অচেনা বুঝতে দিয়ে তৈরি এই গুপ্ত পদার্থ ও গুপ্ত শক্তি। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক কিংবা অন্য কোনো ফার্মিয়ন কণার অস্তিত্ব নেই সে গুপ্ত বস্তুর ভেতরে। কিংবা গুপ্ত শক্তিগুলো, যা আকারে মহাবিশ্বের মোট ভর শক্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ, সেই শক্তির উৎস ফোটন বা অন্যান্য বোসন কণার মত কোন কণা নয়। তাহলে এর দেখা মিলবে কিভাবে? মিলবে কি মিলবে না সেটা পরের কথা, বিজ্ঞানীরা তো আর হাত গুটিয়ে থাকার পাত্র নন। ঘর তোর বৈজ্ঞানিক রহস্যের পেছনে তাদের নিরন্তর ছুটে চলা। ঘটনার শুরু গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে। গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ব্যবহার করে ডাচ বিজ্ঞানী ইয়ান ওট আর মার্কিন বিজ্ঞানী ফ্রীত্জ জুইকি ভর মাপার চেষ্টা করেন গ্যালাক্সি গুলোর।
সেখানেই বাধে গোল। মহাবিশ্বের মোটা বস্তুকণার হিসাব বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল। সেটা থেকেই বের করা যায় মহাবিশ্বের মোট ভর। সেই ভর অার ওর্ট-জুইকির মাপা ভর এক হওয়ার কথা। কিন্তু হিসাব থেকে মহাবিশ্বের মোট ভর অনেক অনেক গুণ বেশি পাওয়া গেল। এবার তো বরের যোগান কোথা থেকে এল? অনেক বিজ্ঞানীই এটা নিয়ে গবেষণা করলেন। কিন্তু হিসাব মিলল না।
১৯৭০- এর দশকে মার্কিন জ্যোতির্বিদ ভেড়া রবিন বললেন, দু’ভাবে বের করা মহাবিশ্বের ভর সমান হবে, যদি মহাবিশ্বে বিপুল বড় শক্তি লুকিয়ে থাকে। রুবিন বলেন, এসব গুপ্ত বস্তু তৈরি এমন কণা দিয়ে, যেগুলো আমাদের অজানা। আলোও এর উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই খুব সহজেই আমাদের চোখ ও শক্তিশালী ডিটেক্টর ও ফাঁকি দিতে পারে। এখন আমরা জানি, মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ দৃশ্যমান বস্তু দিয়ে গড়ে উঠেছে। ৯৬ শতাংশই রয়ে গেছে অদৃশ্য। অদৃশ্য ভোরের ২১ শতাংশ গুপ্ত পদার্থ বাকি ৭৫ শতাংশ গুপ্ত শক্তি। ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি কে আমলে নিয়েই বিগ ব্যাং, মহাবিশ্বের প্রসারণ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাখ্যা করা যায় আইনস্টাইনের মহাকর্ষও। অর্থাৎ এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। মহাবিশ্বের সৃষ্টি তত্ত্বের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মডেল প্রতিষ্ঠা করেন স্টিভেন ওয়েনবার্গ, আব্দুস সালাম আর সেলডন গ্ল্যাশো। সেই মডেল আমাদের পরিচিত সব বস্তুকণা ( ফার্মিয়ন) ও বল বাহী কণাদের (বোসন) স্থান হয়েছে।
কিন্তু গুপ্ত কণাদের খোঁজ ওই মডেল দিতে পারে না।১৯৭০- এর দশকে সুপার ‘সিমেট্রি’ নামের আরেকটি মডেল দাঁড় করানো হয়। উদ্দেশ্য কৃষ্ণ-গহবর কিংবা ডার্ক ম্যাটার মতো বিষয়গুলো- যেখানে নিউটন-আইনস্টাইন এর মডেল অকার্যকর, কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ও ঠিকঠাক কাজ করে না- সেসব বিষয়ে ব্যাখ্যা করা। সুপার সিমেট্রির সূত্র ধরেই বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটার এর জন্য এক ধরনের কণার কথা বলেন। পূর্ণাঙ্গ নাম দেন weakly interacting massive particles। অর্থাৎ দুর্বল মিথস্ক্রিয়াশীল ভারী কণা। বিজ্ঞানীদের দাবি, এটা এমন এক কণা শুধু মহাকর্ষ বয়স সঙ্গে এর মিথস্ক্রিয়া ঘটে। বিদ্যুৎ চুম্বকীয় সবল নিউক্লিয় বল, এমনকি দুর্বল বল এর সঙ্গে ও এর মিথস্ক্রিয়া নেই। তাই কঠিন পদার্থের কিংবা ফোটনের সঙ্গেও সংঘর্ষের কোন সুযোগ নেই। আর আলোর সঙ্গেই যদি সখ্য তৈরি না হয় সেটা আমাদের চক্ষু কর্ণের মানব- ভঞ্জন ঘটাবে কি করে?
অনেক পদার্থবিদদের ধারণা, খুব কম শক্তির দুর্বল নিউক্লিয় বলের সঙ্গে উইম্প কণার মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ গুপ্তকণা কে ধরার জন্য লাক্সের ডিটেক্টর নামে একটি শক্তিশালী ডিটেক্টর তৈরি করেন।
সম্প্রতি ডিটেক্টরের ধরা পড়া কিছু সিগনাল বিজ্ঞানীদের আশাবাদী করেছিল। ডিটেক্টরের ডাটা নিয়ে তারা কোমর বেঁধে গবেষণা শুরু করেন। সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স-এ। সে গবেষণাপত্র বলছে, যতটা আশা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ডেটা বিশ্লেষণে নেমেছিলেন, সেই আশার ফুল এখনই ফুটছে না। অর্থাৎ হিসাব বলছে লিক্সের জেননে এখনো আঘাত হানে নি উইম্প। তাই বলে রণেভঙ্গ দেননি বিজ্ঞানীরা। গুপ্ত কনা আজ ধরা দেয়নি তো কি হয়েছে, একদিন না একদিন ফাঁদে তাকে পড়তেই হবে। তাদের মতো গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানের প্রেমের আশায় বুক বাঁধছেন- দশকের পর দশক ঘুরিয়েও যেমন রকরে হিগস-বোসন কিংবা ভাইল ফার্মিওন ধরা পড়েছে বিজ্ঞানীদের জালে। উইম্পও একদিন লাক্সের জালে জড়িয়ে ফেলবে নিজেকে।