সাগরতলের অদ্ভুত প্রাণিরা

সমুদ্র – মহাসমুদ্র, বরাবরই অদ্ভুত জায়গা। অদ্ভুত আর রহস্যে ঘেরা। পৃথিবীপৃষ্ঠের গুরুভাগ অংশ জুড়ে আছে (৫১ কোটি এক লাখ বা ৫১০.১ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার প্রায় ) সমুদ্র, নদনদী ও জলাধার। তাই এসব, বিশেষকরে সমুদ্র – মহাসমুদ্রকে ঘিরে আমাদের প্রশ্নের যেন শেষ নেই। রয়েছে অগণিত রহস্যও। চাক সেটা বার্মুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে হোক, বা হোক আটলান্টিস নিয়ে বা অতিকায় মেগালোডন নিয়ে। পৃথিবীপৃষ্ঠে ৭১% শতাংশ জুড়ে থাকা এই বিশাল রহস্যময় রাজ্যের বহু প্রাণীকুল, অনেক খাত, অঞ্চল অনেককিছু আমাদের এখনো অজানা। এই অজানা অংশের পরিমাণ এতটাই বেশি যা শুনলে আঁৎকে ওঠা লাগবে হয়তো।
২০০০ সালের National Oceanic and Atmospheric Administration (NOAA) এর করা এক জরীপ মতে ৯৫ শতাংশ সমুদ্রভাগ আর সমুদ্র তলদেশের ৯৯ শতাংশই অজানা!
ভাবতে পারেন তাহলে কতকিছু এখনো আমরা জানিনা এই রহস্যপুরীর ব্যাপারে! ঠিক তেমনি রহস্যে ঘেরা এখানকার জৈববৈচিত্র। তবে সময়ে সময়ে অনেক সমুদ্র অভিযান, অনুসন্ধান ও গবেষণায় উঠে এসেছে গভীর সাগরের বহু অদ্ভুত প্রাণীর তথ্য। চলুন তাহলে আজ জেনে নেয়া যাক গভীর সমুদ্র তলদেশের তেমন কিছু প্রাণীদের সম্বন্ধে…

১. গবলিন হাঙর বা ভ্যাম্পায়ার হাঙর (Goblin Shark or Vampire Shark)

প্রথমেই শুরু করা যাক, ১৩০০ মিটার (৪২৬৫ ফিট) গভীর সমুদ্রের বাসিন্দা গবলিন সার্ক দিয়ে। বিশ্বাস করুন এদেরকে দেখলে আপনার ভিনগ্রহের প্রাণী বলেই মনে হবে। এর কারণ হচ্ছে এদের মুখের গঠন! পাশাপাশি গবলিন সার্ককে জ্যান্ত ফসিলও বলা চলে। Stark Jordan দ্বারা ১৮৯৮ সালে আবিষ্কৃত হাঙরের এই প্রজাতিটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবার Mitsukurinidae এর অন্তর্ভুক্ত যার দ্বিপদ নাম রাখা হয় Mitsukurina owstoni
হাঙরের এই অদ্ভুতদর্শন প্রজাতিটিকে জ্যান্ত ফসিল বলার কারণ কোটি বছর ধরে এ প্রজাতির টিকে থাকা। এরা পৃথিবীতে সাড়ে ১২ কোটি (১২৫ মিলিয়ন) বছর ধরে নিজের বংশকে অবিকল টিকিয়ে রেখেছে! হাল্কা গোলাপি এই সার্কটি লম্বায় সচরাচর ১০ থেকে ১৩ ফুটের হয়ে থাকে।

২. ডাম্বো অক্টোপাস (Dumbo Octopus)

এবারের প্রাণীটা কিন্তু মোটেও ভয়ংকর না। বরঞ্চ অসম্ভব মায়াকাড়া কার্টুন টাইপের দেখতে। এদের দুইপাশে কানের মত পাখনা রয়েছে। আর সে থেকেই এমন নাম। এদের গণ Grimpoteuthis এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ১৩ টি প্রজাতি রয়েছে। আর প্রতিটাই খুব গভীর সমুদ্রের বাসিন্দা। এরা সাগরের মিডনাইট জোন এ (সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২৬০০ – ৪৮৭০ মিটার/ ১৩০০০ফিট গভীরে) বসবাস করে যেখানে আলো ঠিকমত পৌছায় না, বা পৌছায়ই না। এরা এমন তুলতুলে শরীর নিয়ে পানির এমন গভীর চাপে কিভাবে টিকে আছে তাও এক রহস্য!

৩. দানব স্কুইড বা জায়ান্ট স্কুইড (Giant Squid)

আমরা অনেকেই হয়তো এই প্রাণীটার নাম শুনেছি। Architeuthidae গণ ভুক্ত Architeuthidae dux বা জায়ান্ট স্কুইড আসলে জলজ্যান্ত কিংবদন্তি। বহুকাল একে জ্যান্ত দেখার জন্যে বহুজন হন্যে হয়ে খুঁজেছে। প্রথম আবিষ্কারের পর থেকে দেড়শ বছর মানুষ বহু চেষ্টা চালিয়েছে এই দানবের জলজ্যান্ত ছবি নেয়ার জন্যে। কিন্তু গভীর সমুদ্রে deep – sea gigantism এর নিয়মে বৃহৎ আকার পাওয়া এই দানবের দেখা অত সহজে মেলেনি। ২০০৪ সালে জাপানের একটি রিসার্চ টিম এই দানবের জ্যান্ত অবস্থায় এবং প্রকৃতিতে পাওয়া সর্বপ্রথম ছবি তুলতে সক্ষম হোন। এবং ২০১২ সালে জাপানের Chichijima তে এদের সর্বপ্রথম ভিডিও ধারণ করা হয়। আটটা বাহু আর দুইটা বিশাল টেন্টাকল শুড়ের এই দানবের এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য স্ত্রীর ১৩ মিটার বা ৪৩ ফুট আর পুরুষের ১০ মিটার বা ৩৩ ফুট। এদের চোয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী যা হাড়গোরকেও নিমিষে গুড়িয়ে দিতে পারে!

৪. স্বচ্ছমাথা মাছ (Spook Fish)

গভীরজলের এই মাছদের অনেকগুলো প্রজাতি আছে যা Barreleye পরিবারভুক্ত। তবে এদের মাঝে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল Macropinna microstoma বা স্বচ্ছমাথা ব্যারিলিয়ি। ব্যারিলিয়ি পরিবারের Macropinna গণের একমাত্র প্রজাতির এই মাছটির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল এদের মাথার দিকটা অস্বাভাবিকরকমের স্বচ্ছ। যার ফলে মাথার ভেতরটাতো দেখা যায়ই, সাথে বেলনাকৃতির চোখদুটোও দেখা যায়। হুট করে দেখলে মনে হবে বুঝি কোনো খেলনা বা রোবট মাছ বা ফ্যান্টাসির জগত থেকে উঠে আসা কিছু! এরা খুব বেশী গভীর না হলেও যথেষ্ট গভীর জলের মাছ। সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ মিটার গভীরে এদের বসবাস। ১৯৩৯ সালে এই প্রজাতিটা আবিষ্কৃত হলেও ক্যামেরার চোখে প্রথম জ্যান্ত ধরা পড়ে ২০০৪ সালে।

৫. দানবাকৃতি আইসোপড (Giant Isopod)

বিশালাকৃতির এই পোকার সাইজ আর আবাসস্থল জানলে সত্যিই আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না। মেক্সিকো অঞ্চলে বসবাসকারী এই আইসোপড পোকারা সমুদ্রপৃষ্ঠের এক কিলোমিটারের নীচেও বসবাস করে যার গভীরতা প্রায় ৩৫০০ ফুট! আর সাইজে এরা ১৪” পর্যন্ত বড়ও হতে পারে! অর্থাৎ আপনার বাসায় থাকা স্টিলের স্কেলখানার চাইতেও বড়! এদের বৈজ্ঞানিক নাম Bathynomus giganteus। বিশাল তেলাপোকা সদৃশ এই ভয়ানক প্রাণীরা মূলত মৃতভোজী বা Scavengers।

৬. Pink Swimming Sea Cucumber

না না, ভাববেন না আবার এটা কোনোধরণের Cucumber বা শষা। এরা আদতে প্রাণি। Sea Cucumber‘দের ১১০০’রো বেশি প্রজাতির মধ্যে Enypniastes গণের এই প্রজাতিটা অত্যন্ত গভীর জলের প্রাণী। যাদের দেখা পাওয়া যায় প্রায় ৩২০০ মিটার বা ১০৫০০ ফিট গভীর জলে! আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল এই অসম্ভব সুন্দর অদ্ভুত প্রাণীটা যে গভীরতায় বসবাস করে সেখানে সূর্যের আলো না পৌঁছানোর ফলে সেখানকার পানি প্রচন্ডরকমের ঠাণ্ডা থাকে। তবু সেখানে দিব্যি এদের বসবাস!

৭. প্যাসিফিক ভাইপার মাছ (Pacific Viper Fish)

 


মাত্র আট ইঞ্চি গড় দৈর্ঘ্যের Pacific Viperfish (Chauliodus macouni) দেখতে ছোট হলেও সাঙ্ঘাতিক রকমের বিভৎস!
সরু দেহের তুলনায় বড়সড় মাথা, ঠিকরে বের হয়ে আসার মত চোখ আর অস্বাভাবিকরকম বড় বড় কাটার মত দাঁত এদের দিয়েছে একেবারে ভিলেইন লুক! ভাইপারফিশের এ প্রজাতির আবাস প্রশান্ত মহাসাগরের ২০০ থেকে ৫০০০ মিটার গভীরে! অর্থাৎ একেবারে হিম অন্ধকার জগতের বাসিন্দা এরা।

৮. ভ্যাম্পায়ার স্কুইড (Vampire Squid)

 


মাত্র ফুটখানেক লম্বা এই ভ্যাম্পায়ার স্কুইড (Vampyroteuthis infernalis) আর দশটা স্কুইডের চাইতে আলাদা! হাঁসের লিপ্তপাদের মত এদেরও বাহুগুলো লিপ্ত বা পাতলা চামড়া দ্বারা জোড়া লাগানো। ফলে এরা বাহু প্রসারিত করলে ভ্যাম্পায়ার ভ্যাম্পায়ার একটা লুক আসে। সত্যি বলতে কি দেখতে কিন্তু বেশ স্টাইলিশই লাগে। বেশ ভাবওয়ালা এই ছোট্ট স্কুইড সমুদ্রপৃষ্ঠের ৬০০ থেকে ৯০০ মিটার (২০০০-৩০০০ ফিট) গভীরে বসবাস করে।

৯. ফ্যাংটুথ ফিশ (Fangtooth Fish)

 


এদের মুখটা অনেকটা ভাইপার ফিশের মত দেখতে হলেও, এরা আকারে ভাইপার ফিশের অর্ধেক, অর্থাৎ ৬ ইঞ্চির মত আর আকৃতিতেও ভিন্ন। BBC Blue Planet ডক্যুমেন্ট মতে ফ্যাংটুথের দাঁত শরীরের অনুপাতে সমুদ্রের অন্য যেকোনো মাছের চাইতে বড়। তবে এত বীভৎস দর্শন হলেও এরা মানুষের ক্ষতি করার মত নয়। এরা খুবই গভীর জলের মাছ। এদের আবাস্থলের গভীরতা ২০০০ থেকে ৫০০০ মিটার (৬৫০০-১৬৫০০ ফিট)। এপর্যন্ত আবিষ্কৃত এদের দুটো প্রজাতি রয়েছে। যথা : Anoplogaster brachycera (shorthorn fangtooth)
A. cornuta (common fangtooth).

১০. গাপলার ঈল/ পেলিক্যান ঈল (Gupler Eel/Pelican Eel)

এই জন্তু আপনাকে নির্ঘাত বিভৎসদর্শন কোনো এলিয়েনের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। ২.৫ ফুট লম্বা এই পেলিক্যান ঈল বা গাপলার ঈল (Eurypharynx pelecanoides) হল Eurypharynx গণের এপর্যন্ত আবিষ্কৃত একমাত্র সদস্য। সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০০০ থেকে ২১০০ মিটার (৩২৮১-৬৮৯০ ফিট প্রায়) নীচে বসবাস করা এই বিভৎস প্রাণীর চোয়াল সারা দেহের তুলনায় অস্বাভাবিকরকম বড় আর অস্বাভাবিকরকম সম্প্রসারণশীল। কিন্তু এরা খুব বড় কিছু খেতে পারেনা বিধায় তুলনামূলক ছোট শিকারকেই ধরে আটকে ফেলে। এদের মাথার দিক চওড়া, কিন্তু পেছানে দিকে গিয়ে সরু আর ক্রমশ চিকন।

১১. ব্ল্যাক স্যালোয়ার (Black Swallower)

 


পেলিক্যান ঈল বড় কিছু মুখের থলিতে নিতে পারলেও গিলতে পারেনা। কিন্তু কেমন হয় যদি বলি, এমনো মাছ আছে, যেগুলো নিজের চাইতেও বড় কিছুকে গিলে যেতে পারে?!
Black Swallower (Chiasmodon niger) এমনই একটা মাছ, যে তার শরীরের চাইতেও বড় কিছুকে গিলে ফেলতে সক্ষম! সমুদ্রপৃষ্ঠের ৭০০ থেকে ২৭৪৫ মিটার (২২৯৭-৯০০৬ ফিট) নীচে বসবাস করা এই প্রাণীদের দৈর্ঘ্য সবে ৯.৮ ইঞ্চি। অথচ এরা নিজ ভরের (mass) চাইতে দশগুণ বেশি ভরের আর কয়েকগুণ বড়/লম্বা প্রাণীকে গিলে খেতে সক্ষম। এদের চোয়ালের গঠনের ফলে এদের মুখে ঢুকে পড়া সরু কোনো প্রাণি সহজেই আটকে দাতগুলোর ভিতরমুখী ধাক্কায় ভেতর দিকে চলে যায়। ২০০৭ সালে কেইমেন দ্বীপের উপকুলে পাওয়া ৭.৫ ইঞ্চির এক স্য়্যালোয়ারের পেট থেকে একটি Snake mackerel মাছ পাওয়া যায় যার দৈর্ঘ্য ছিল ৩৪ ইঞ্চি! মানে নিজে দেহের চাইতেই প্রায় সাড়ে চার গুণ লম্বা!
উল্লেখ্য যে এমাছ বিশ্বজুড়ে গভীর সমুদ্রের সর্বত্রই দেখা যায়।

১২. ফ্রিলড সার্ক (Frilled Shark)

 

প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের পাওয়া Frilled Shark (Chlamydoselachus anguineus) এর বসবাস সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫০ থেকে ১৫৭০ মিটার (১৬০ – ৫১৫০ ফিট) গভীরে। অন্যান্য বহু হাঙরের মত এটিও যেন জ্যান্ত ফসিল! আসলে হাঙরের গোটা জাতটাই খুব খুব প্রাচীন। প্রচলিত হাঙরদের চাইতে এদের শরীর অনেক সর্পিল। মানে একেবেকে চলার মত। চেহারা ভুতুড়ে আর বেড়িয়ে থাকা ক্ষুরধার দাঁতগুলো ভেতরের দিকে বেকে গিয়ে একে করেছে আরো ভয়ানক! যাতে একবার শিকার পড়লে আঙটার মত আটকে যায়! এদের সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত দৈর্ঘ্য ৬.৬ফিট।

১৩. সুচালোমুখো ভুতুড়ে হাঙর (Pointy nosed ghost shark)

হাঙরের আরো একটা অদ্ভুত প্রজাতি হল এই Pointy nose ghost shark বা Pointy nose blue Chimaera (Hydrolagus trolli)। এদের কুতকুতে চোখ আর অদ্ভুত কারুকার্যের মাথা দেখলে মনে হবে যেন অন্যরকম কোনো কিছু! যেন বেশ বুদ্ধিদীপ্ত কোনো প্রাণী! প্রশান্ত ও দক্ষিণ মহাসাগর, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসহ বিশ্বের অনেক জায়গাতেই সমুদ্রের ৬১০ থেকে ২০০০ মিটার (২০০০-৬৫৬০ ফিট) গভীরে এদের দেখা মেলে। এরা ৪৭” বা প্রায় ৪ ফিট পর্যন্তও বড় হতে পারে।

তো এই ছিল আজকের আলোচনা আমাদের কিছু গভীর সমুদ্রের প্রাণীদের নিয়ে। যদিও সাগরের অপামর রহস্য আর প্রাণীকুল সম্বন্ধে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। তবু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে আমরা আগামীতে আরো অনেক কিছু জানতে পারবো গভীর সাগরের রহস্যপুরীর ব্যাপারে। আবিষ্কৃত হতে পারে অকল্পনীয় রকমের বড় কোনো প্রাণি, বা অদ্ভুত কোনো কিছু। জানবো এই অজানা দেশ সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য।
তো আবার আসবো নতুন কোনো বিষয় নিয়ে। ততদিন, ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিজের খেয়াল রাখুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>