ডাইনোসর বইয়ের পাতার কল্পজগৎ থেকে উঠে আসা কোনো প্রাণী নয়। বাস্তব পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এক প্রাণী যারা একসময় দাপিয়ে বেড়াতো গোটা দুনিয়ার আনাচে কানাচে । পৃথিবী থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পূর্বে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, আজও সকল বয়সী মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রাণীটি।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ডাইনোসর নিয়ে গবেষণার বয়সও খুব বেশি নয়। মাত্র ১৭০ বছর পূর্বে ব্রিটেনের মধ্য লন্ডনে প্রথমবারের মতো বিশালাকার ডাইনোসরের একটি পূর্ণাঙ্গ অস্থির সন্ধান পাওয়া যায়। ডাইনোসর নিয়ে গবেষণা, তত্ত্ব, রহস্য কিংবা গল্পের শেষ নেই।হারিয়ে যাওয়া প্রাণীটি নিয়ে গবেষণার অন্যতম অবলম্বন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে খুঁজে পাওয়া জীবাশ্ম। এসব জীবাশ্মের উপর গবেষণার থেকেই আবিষ্কার হয় ডাইনোসরের কোনো এক নতুন প্রজাতি, নতুন বৈশিষ্ট্য, নতুন তত্ত্ব যা পুরনো তত্ত্বকে বাতিল করে দেয় কিংবা বাতিল করে দেওয়া পুরনো তত্ত্বকে আবার পুনরুজ্জীবিত করে।
তবে অনেকের মতে ১৯৯১ সালে আন্দেজ পর্বতমালার কিনারে ইসচিগুয়ালষ্টো প্রভিন্সিয়াল পার্কে একদল আর্জেন্টাইন বিজ্ঞানী খোঁড়াখুঁড়ি করে প্রাচীনতম এক ডাইনোসরের দেহ আবিষ্কার করে। এর নাম ইরোপটার। ধারণা করা হয় মাংসাশী প্রাণীটির আবির্ভাব ২৩০ মিলিয়ন বছর আগে। টাইরানোসরাসের মতো ইরোপটার সরিসচিয়ান গোত্রভুক্ত ছিল। তবে ডাইনোসরের যুগ আরো আগে।
ডাইনোসরের প্রজাতির প্রাচুর্যতা
এ পর্যন্ত ডাইনোসরের আবিষ্কৃত প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৫০০, তবে জীবাশ্ম রেকর্ডের ভিত্তিতে ১৮৫০ টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থাত এখনো প্রায় ৭৫% প্রজাতি আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
উল্লেখযোগ্য কিছু প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ঃ
Saurischia: এসব ডাইনোসরের পম্চাত ছিল সরীসৃপদের মতো
Theropods: এটি মাংসভোজি ডাইনোসরের দল
Sauropods: এরা লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকত। এদের ছিল খুব লম্বা লম্বা গলা
Ornithischia: এরা লতাপাতা ভোজি যাদের কারো কারো পাখির মতো ঠোঁট ছিল
Ornithopoda: এরা “duck-billed” ডাইনোসর
Pachycephalosauria: এসব ডাইনোসরের মাথা ছিল খুব শক্ত
Ceratopsia: এরা শিংওয়ালা জাতির অন্তর্ভূক্ত
ডাইনোসরদের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ঃ
- উভচর ডাইনোসরঃ অনেক ডাইনোসর ছিল উভচর প্রজাতির ।মঙ্গোলিয়া থেকে পাচার করা একটি জীবাশ্ম যখন উদ্ধার করা হয় তখনো কেউ কল্পনা করতে পারেনি যে, ডাইনোসরের ইতিহাসে যুক্ত হতে যাচ্ছে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য।বিজ্ঞানীরাও গবেষণার শুরুতে ব্যাপারটি নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান, কেননা ইতিপূর্বে যত ডাইনোসর আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর কোনোটিই উভচর ছিল না। ব্রিটেনের বিশেষ একধরনের তরঙ্গ যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে বিস্তর গবেষণার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এটি একটি আসল ও সম্পূর্ণ জীবাশ্ম।নতুন আবিষ্কৃত এই ডাইনোসরটির নাম দেওয়া হয়েছে Halszkaraptor escuilliei ।
- নিরামিষভোজী ডাইনোসর ঃ Limusaurus প্রজাতির অদ্ভুত ডাইনোসরগুলোর শৈশবকালে শক্তিশালী দাঁতের অধিকারী হলেও, যৌবনে পদার্পণের পর্যায়ে দাঁত হারাতে শুরু করে। মাত্র ১.৫ মিটার লম্বা দ্বিপদী এই প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব ছিল প্রায় ১৬০ মিলিয়ন বছর পূর্বে। মাত্র ১২ বছর বয়সে যাদের সবগুলো দাঁত পড়ে যেত। এরকম বিবর্তন অন্য কোনো প্রজাতির ডাইনোসর তো নয়ই, বরং বর্তমান কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো প্রাণীর মধ্যেও দেখা যায়নি।
- ডিমে তা দিতো ডাইনোসর ঃ ‘চিকেন ফ্রম হেল’ ডাক নাম দেওয়া ডাইনোসরগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো বিশালাকার এবং গায়ে পাখির মতো পালক দ্বারা আবৃত। পালকযুক্ত ডাইনোসরগুলোর মধ্যে এরাই সবচেয়ে বৃহৎ। Anzu wyliei নামক ডাইনোসরগুলো Oviraptorosaurs এর অন্তর্ভুক্ত ।
- ছোট আকারের ডাইনোসরঃ সবচেয়ে মজার বিষয় হল আমরা ডিনোসর বলতে শুধুমাত্র বিশালদেহী জীবকেই বুঝি । কিন্তু ডাইনোসর বলতে যে শুধু বিশালাকার দেহের জন্তু বোঝায় তা নয়, বরং খুবই ও সেসময় ছিল। সবচেয়ে ছোট ডাইনোসর Anchiornis এর ওজন ছিল ১১০ গ্রাম। তৃনভোজী Microceratus এবং Wannanosaurus এর দৈর্ঘ্য ৬০সেন্টিমিটার(২ ফুট) ।
- নতুন প্রজাতির সবচেয়ে বড় ডাইনোসরঃ সর্ববৃহৎ ডাইনোসরটি লম্বায় প্রায় ১২০ ফুট, উচ্চতা ২০ ফুট এবং ওজন প্রায় ৬৯ টন যা প্রায় ১২টি আফ্রিকান হাতির সমান ওজন যার সন্ধান পাওয়া যায় ২০১৭ সালে । সেটি হলো Titanosaurs গোত্রের। এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া সবচেয়ে বড় ডাইনোসর এটি । ধারণা করা হচ্ছে এটিই এখন পর্যন্ত বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী ।
ডাইনোসর ধ্বংসের কারনঃ
ডাইনোসরদের ধ্বংসের পেছনে বিজ্ঞানীরা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। তবে কোটি কোটি বছর পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করে যাওয়া মহা শক্তিশালী জীবগুলোর ধ্বংস হয়ে যাবার কারণ নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে।
কেউ বলেন উদ্ভিদ জীবনে পরিবর্তনের ফলে ডাইনোসরদের খাবারে গোলমাল দেখা যায়। না খেতে পেরে মারা যায় তারা। অবশ্য ক্রিটোশিয়াস যুগের শেষে আকস্মিক আবহাওয়া পরিবর্তনটাই ডাইনোসরের ধ্বংস হয়ে যাবার জন্য দায়ী বলে জোরালো যুক্তি মেলে। ১৬০ মিলিয়ন বছর ধরে উষ্ণ আবহাওয়ার সাথে পরিচিত ছিল প্রাগঐতিহাসিক প্রাণীগুলো। সেই আবহাওয়া ৬৪ মিলিয়ন বছর আগে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। স্থির তাপমাত্রায় অভ্যস্ত ডাইনোসরেরা পরিবর্তিত জলবায়ুর সাঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি নিজেদেরকে। ফলে একের পর এক ঢলে পড়তে শুরু করে মৃত্যুর কোলে।
অবশ্য আরেকদল বিজ্ঞানী বলেছেন, ডাইনোসরদের বিলুপ্ত হয়ে যাবার পেছনে দায়ী কোন গ্রহাণু অথবা ধূমকেতু। ক্রিটোশিয়াস যুগের শেষ দিকে গ্রহাণু কিংবা ধূমকেতু আছড়ে পড়ে পৃথিবীতে। গোটা পৃথিবী আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ধুলোয়। ভয়ঙ্কর ধুলোড় মেঘ ভেদ করে সূর্যারশ্নি মাসের পর পাস পৌছুতে পারেনি পৃথিবীতে ফলে বেশিরভাগ উদ্ভিদ মরে যায়। না খেতে পেরে প্রাণ হারায় ডাইনোসররা।
তবে ডাইনোসরের বিলুপ্তিতে আরেকটি কারণকে প্রাধান্য দেয়া হয় তা হলো, তাদের ডিমের খোসার পুরুত্ব। পরীক্ষায় দেখা যায়, সাড়ে ছয় কোটি বছর আগের ডিমের খোসা ১২ থেকে ১৪ কোটি বছর আগের ডিমের খোসার চেয়ে যথেষ্ট পুরু ছিল। ফলে ডিমের খোসা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা বাচ্চা ডাইনোসরের পক্ষে কষ্টকর ব্যাপার ছিল। এর ফলে পরবর্তীতে ডাইনোসরের বিকলাঙ্গতা দেখা দিত এবং প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেত। এভাবে এক সময় তারা বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হয়।