ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার

২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া   জেমস ম্যাকাভয় অভিনীত “Split” সিনেমাটি হয়তো আমাদের অনেকেরই দেখা আছে । সিনেমাতে কেভিন চরিত্রে অভিনয় করা জেমস ম্যাকাভয়  ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত একজন রোগী। যার মাঝে একটি নয় , দুটি নয়, দশটি নয়, গুনে গুনে তেইশটি ভিন্ন সত্ত্বার বসবাস! অর্থাৎ একই দেহে তেইশটি ভিন্ন মানুষ।  এই সত্ত্বা গুলোর মাঝে কোনোটি ভালো, কোনোটি খারাপ, কোনোটি ৯ বছরের শিশু , মহিলা ,ফ্যাশন ডিজাইনার  আবার কোনোটি  আসুরিক শক্তি সম্পন্ন। প্রতিটি চরিত্রেই সে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের এক জন মানুষ।

অথবা  রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের লেখা ড. জেকিল ও মিস্টার  হাইডের সেই গল্পটা পড়েছেন ? যেখানে ড. জেকিল  আবিষ্কার করেন এমন এক ওষুধ যার প্রয়োগে তার ভেতরের খারাপ দিকটি প্রকট হয়ে উঠে এবং তিনি তখন  হয়ে যান সম্পূর্ণ অন্য একজন মানুষ যার নাম দেন তিনি মিস্টার হাইড।  আপাত দৃষ্টিতে এগুলো নিছক কল্পকাহিনী মনে হলেও এমন রোগ কিন্তু সত্যিই আছে যার জন্য এক ব্যক্তির মধ্যেই প্রকাশ পেতে পারে একাধিক ব্যাক্তির চরিত্র। আর এ রোগটিই হলো   ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার । ইংরেজিতে  Dissociative Identity Disorder  সংক্ষেপে “DID” .  একে মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারও বলা হয়। রোগটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন প্যারিসের “Salpetriere Hostital”  এর প্রধান চিকিৎসক ড. জিন মারটিন চারকট ।

কেন হয় এই রোগ?

একজন মানুষের মাঝে একাধিক সত্ত্বা প্রকাশ পাওয়ার অনেক গুলো কারণ আছে । তার মাঝে যে কারণটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় তা হল “আঘাত”।  অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় শৈশবে ঘটা কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনা, অতিরিক্ত মারধরের শিকার হওয়া বা যৌন হয়রানির শিকার  হওয়া এমন ব্যক্তিদের মাঝে এ রোগটি প্রকাশ পেয়েছে।  শৈশবে যখন শিশুদের সাথে এসব ঘটনা ঘটে তখন স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বলতার কারণে তারা এর প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু তার ভেতর ইচ্ছা থাকে প্রতিবাদ করার। এ ইচ্ছা থেকেই তার নিজের ভিতর জেগে উঠতে থাকে অন্য একটি সত্ত্বা যেটি তার থেকে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী । একটি মানুষের ভেতর জেগে উঠতে পারে একাধিক সত্ত্বা । প্রথম প্রথম দু, তিনটি সত্ত্বা দিয়ে শুরু হলেও আস্তে আস্তে এর সংখ্যা বাড়তে থাকে । এমনকি এ সংখ্যা ১০০ পর্যন্তও যেতে পারে।  তবে  বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এটি ঘটে নিজের মনের অবচেতনে। এক সত্ত্বা অন্য সত্ত্বার খবর নাও রাখতে পারে।  দেখা যায় তার আসল সত্ত্বাটি হয় লাজুক প্রকৃতির। কিন্তু অন্য গুলো হয় রুক্ষ, ভয়ানক বা অপ্রকৃতস্থ । কারণ বাকি সত্ত্বাগুলোর জন্ম হয়েছে বিভিন্ন রকম আঘাত থেকে। এই ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বাগুলো রোগীকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে । এছাড়া বেশিভাগ সময়ই রোগী যখন স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে তখন তার অন্য সত্ত্বা সম্পর্কে মনে থাকে না । তার মনে হয় সে ঘোরের মাঝে ছিলো।  যাকে সাইকোলজির ভাষায় বলা হয়  ‘ব্ল্যাক আউট’ ।

রোগের লক্ষণ:-

  •  রোগীর মাঝে একাধিক ব্যক্তিত্ব থাকবে। প্রতিটি ব্যক্তিত্বর আলাদা আলাদা লিঙ্গ, আচরণ, অঙ্গ ভঙ্গী , কথা বলার ধরণ থাকবে।
  •  তার এক সত্ত্বা অন্য সত্ত্বাকে মনে রাখতে পারে না।
  •  প্রায়ই সাময়িক  সময়ের জন্য তার স্মৃতি শক্তি বিলুপ্ত হয়। স্বাভাবিক বিষয়গুলো  ভুলে যাবার প্রবণতা বেড়ে যায়।
  •  সম্পর্ক,  মানসিক বা পেশাদারি চাপ সামলাতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
  •  তার মাঝে প্রচুর পরিমাণে হতাশা দেখা দেয় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়।
  •  বিভিন্ন ড্রাগের প্রতি আসক্তি দেখা যায়।
  •  বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়,।
  •  তার মাঝে প্রচুর পরিমাণে অস্থিরতা বেড়ে যায়।
  •  বিভিন্ন রকম হ্যালুসিনেশন হতে থাকে ।
  •  ভয়ানক স্মৃতি গুলো প্রায়ই তাড়িয়ে বেড়ায়।
  •  ঘুমের সমস্যা হয় । প্রায়ই  দুঃস্বপ্ন হয় ,  ইনসমনিয়া হয়, ঘুমের ঘোরে হাটার রোগও দেখা দেয়।

প্রতিকারঃ-

সম্পূর্ণরূপে সম্পূর্ণরূপে  মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার কখনোই নিরাময় করা যায় না।  নির্দিষ্ট কোনো ওষুধও নেই এর। তাই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকাই  এর অন্যতম সমাধান।  এর চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে , বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা  সব সত্ত্বাগুলোকে একটি সত্ত্বায় কেন্দ্রীভূত করা।   আর নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ না থাকায় মানসিক চাপ, অস্থিরতা, উদ্বিগ্নতা  কমানোর জন্য বিভিন্ন রকম ওষুধ ব্যবহার করে চিকিৎসার মাধ্যমে একে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।  এছাড়া বিভিন্ন রকম থেরাপি,  সাইকোথেরাপি, হিপনোথেরাপিও এর চিকিৎসার অন্তর্গত। এছাড়া রোগীর নিজের ভেতর প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য  ব্যক্তির ইচ্ছা থাকতে হবে। এভাবেই রোগী তার ভয়ানক জীবন ছেড়ে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারবে।

তথ্যসূত্রঃ

১। WebMD Medical Reference

২। https://www.mayoclinic.org

৩। National Institute of Mental Health

Comments are closed.