কেমন হয় যদি আপনার সহ আপনার আশেপাশে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা লোকদের সবার ব্যবহার করতে থাকা স্মার্টফোন বা কম্পিউটার কোনো বিন্দুমাত্র সিগনাল ছাড়া হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়! একটা নুন্যতম ওয়ার্নিং ছাড়াই! আর সেই সাথে ড্যামেজ হয়ে যায় তার ভেতরে থাকা প্রত্যেকটা যন্ত্রাংশ। এমনকি সার্কিট বোর্ডটাও?!
হ্যাঁ, এমনি এক আতঙ্কের কাজ এটা, যার নাম EMP!
EMP বা Electromagnetic Pulse এর নাম আমরা অনেকে শুনেছি, আবার অনেকে নাও শুনে থাকতে পারি। তবে যারা সায়েন্স ফিকশন মুভি বা সিরিজ দেখেন এবং যারা শুটার গেম খেলে অভ্যস্ত তাদের কাছে EMP Bomb, EMP Grenade বেশ পরিচিত একটা নাম। তো যাইহোক, আশাকরি বুঝতেই পারছেন, পরিচিত হোক বা না হোক, EMP গুরুতর কোনোকিছুরই নাম। আজ আমরা আলোচনা করবো এই EMP এবং EMP Bomb/Device তথা মিলিটারি EMP নিয়ে।
তো প্রথমেই চলুন জেনে নেয়া যাক EMP আসলে কি?
EMP বা Electromagnetic Pulse হচ্ছে একধরণে পালস, বা সহজ ভাষায় ধাক্কা/ বিচ্ছুরণ বা বলতে পারেন ছিটকে বের হওয়া ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ। একে Transient Electromagnetic Disturbanceও বলে। আর এই ধাক্কা কোনো সাধারণ ধাক্কা নয়, এটি হল বিদ্যুৎ দ্বারা উৎপন্ন চৌম্বকীয় তরঙ্গের ছিটকে ছড়িতে পড়া স্রোত।কোনো উৎস থেকে যখন ইলেক্ট্রিক্যালি চার্জড পার্টিকেল বা কণা বা সহজ কথায় ইলেকট্রন ব্যাপক মাত্রায় বিচ্ছুরিত হয়ে একই সাথে ইলেকট্রিক ও ম্যাগনেটিক বা চৌম্বকীয় শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটায় তখন সেই বিচ্ছুরিত তড়িৎ – চৌম্বকীয় বিচ্ছুরণকেই EMP বলে।
উৎস অনুযায়ী এই স্রোতের বিস্তার শর্ট রেঞ্জ বা লং রেঞ্জ এর হতে পারে। এর ধাক্কাও হাল্কা বা প্রচন্ডরকম শক্তিশালী হতে পারে। তবে যেটাই হোক না কেনো, ঘনীভূত বিদ্যুৎ শক্তির কারণে উৎপন্ন এই ছিটকে পড়া চৌম্বকীয় তরঙ্গের প্রতি মিটার ভোল্ট এত বেশি হয় যে তা আশেপাশের মানুষের ক্ষতি করুক না করুক, কিন্তু তার রেঞ্জ/রেডিয়াসের দায়রায় পড়া প্রত্যেকটা ইলেক্ট্রনিক ও ডিজিটাল ডিভাইসকে তার শেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারে। চাক সেটা হোক আপনার স্মার্টফোন, আপনার ল্যাপটপ, ডেক্সটপ বা এমনকি আপনার টেলিভিশন, অথবা “শুধুমাত্র কোম্পানির প্রচারের জন্য” আপনার ঘরের দেয়ালে জ্বলতে থাকা এনার্জি সেভিং লাইট…!
EMP কেনো এত ভয়াবহ?
ElectroMagnetic Force বা চৌম্বকীয় শক্তি চার মৌলিক প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর একটি। এমনকি এই শক্তি মাধ্যাকর্ষণের চাইতেও অধিক শক্তিশালী। স্বভাবতই মৌলিক প্রাকৃতিক শক্তি হওয়ার দরুন এ শক্তি ব্যাপক বিস্তৃত। একই সাথে বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় এই শক্তি যেকোনো ধরণের বিদ্যুৎ পরিবাহী বস্তুর সাথে ক্রিয়াশীল। আর এদিকেই বাধে বিপত্তি। আমাদের গোটা সভ্যতা গড়ে উঠেছে অনেকখানিই বিদ্যুতের উপর নির্ভর করে। চলার গাড়ি থেকে শুরু করে মাথার উপর ফ্যান, বাতি, হাতের স্মার্টফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন সবই বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির আওতায়। প্রতিটা আধুনিক কলকারখানা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির উপর নির্ভরশীল। আর যদি ধরি কম্পিউটার প্রযুক্তির কথা, আধুনিক বিশ্বে কম্পিউটার ছাড়া যেকোনো দেশ অচল। স্রেফ অচল।
তো কথা হচ্ছে এইসব যন্ত্রপাতিরই বিদ্যুৎ পরিবহণের, বিভব পার্থক্যের বা ভোল্টের একটা সর্বোচ্চসীমা রয়েছে। এর উপরে কোনো শক্তি এইসব যন্ত্রপাতি এবং এগুলোর সাথে সংযুক্ত সার্কিট বোর্ড, চিপ ইত্যাদির সংস্পর্শে আসলে সেগুলোকে এমনকি চিরতরে অকেজো করে দিতে পারে। আর EMP এর প্রতি মিটারে ভোল্টের মাত্রা V/m এসব যন্ত্রপাতির সহ্যক্ষমতার চাইতে অনেক অনেক বেশি। যা দশগুণ থেকে শুরু করে হাজারগুণ বেশিও হতে পারে! এমনকি পারমাণবিক তড়িৎচৌম্বকীয় ধাক্কার শক্তি মিটারে বিশ থেকে ত্রিশ হাজার ভোল্টেরো হতে পারে। যা একটা যন্ত্রকে একদম এক নিমিষে পুরোপুরি তছনছ করে দিতে সক্ষম। যেখানে যুদ্ধবিমানের ককপিটের সরঞ্জামাদির সর্বোচ্চসীমা থাকে 7200 V/m!
তো বুঝতেই পারছেন EMP যেকোনো, স্রেফ যেকোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের জন্যে কতটা ক্ষতিকর!
EMP এর প্রকারভেদ।
অনেকরকমের EMP রয়েছে। তারমধ্যে কতগুলো রয়েছে প্রাকৃতিক, আবার রয়েছে মানবসৃষ্ট EMP ও।
বিচ্ছুরিত এই পালসগুলো তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তী করে ভিন্ন ভিন্নরকম ও মাত্রার হয়ে থাকে।
১. শক্তির ধরণ ( বিকিরিত, তড়িৎ, চৌম্বকীয় বা পরিবাহী)
২. উৎপন্ন বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সীমানা বা প্রসারণ (Range)
৩. পালস এর তরঙ্গরুপ যাকে বলে Waveform।
এই বিষয়গুলোর উপরই নির্ভর করে একটা EMP কেমন আর কতটা শক্তিশালী এবং তার ক্ষমতা কতটুকু বিস্তৃত। ধরণ, বৈশিষ্ট্য, উৎস ব্যতিরেকে এই পালসগুলো যেরকমের হয়ে থাকে তা হল :
প্রাকৃতিক EMP
১. বজ্রপাতজনিত পালস (Lightning Electromagnetic Pulse বা LEMP)
২. Electrostatic Discharge বা ESD (এই প্রক্রিয়াও বজ্রপাতের সময় ঘটে থাকে)
৩. উল্কাপাত থেকে সৃষ্ট EMP বা Meteoric EMP। যা উল্কাপিণ্ডের সাথে বায়ুমন্ডল বা খুব উচুতে কোনো বস্তুর সংঘর্ষের কারণে শক্তি বিচ্ছুরণে হয়ে থাকে।
৪. Coronal Mass Ejection বা CME। সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত করোনাজনিত EMP।
মানবসৃষ্ট EMP
১. নানারকম ইঞ্জিনসমুহ দ্বারা সৃষ্ট পালস ট্রেইন (একধরণের নিম্নমাত্রার ও শর্ট রেঞ্জের EMP)
২. ইলেক্ট্রিক সার্কিট বা বর্তনী হতে উৎপন্ন পালস ট্রেইন।
৩. বৈদ্যুতিক পাওয়ার লাইনের ওভারফ্লো বা সার্জ (Surge)
সামরিক EMP বা Military EMP
CME এর পর মানব সভ্যতার জন্যে যদি কোনো EMP সবচে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তা হল সামরিক EMP। এমনকি ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া প্রভাবের দিক থেকে বা ব্যবহারিক দিক থেকে বিবেচনা করলে Military EMP ই ডিজিটাল ডিভাইসের জন্যে বিরাট আতঙ্ক!
MEMP দুই প্রকার।
যথা,
১. Nuclear Electromagnetic Pulse বা NEMP। এবং,
২. Non Nuclear Electromagnetic Pulse বা NNEMP। নানারকমের EMP বোমা ও EMP Jammer এর অন্তর্ভুক্ত।
ভয়াবহ তিন EMP!
১. CME
বলা চলে পৃথিবীর জন্যে সবচাইতে বড় EMP এবং একই সাথে সবচে ভয়ানকও। সূর্য থেকে প্রচণ্ড গতি ও শক্তির সাথে ছিটকে বের হওয়া সৌরঝড় ও Corona’র ভগ্নাংশ এটি। এর মাঝে থাকা বিচ্ছুরিত শক্তি তথা EMP এতোটাই শক্তিশালী যে তা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারলে ভূপৃষ্ঠে ও এর উপরে থাকা সব ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সহ গোটা মানব সভ্যতা তছনছ হয়ে যেতে পারে। ভাগ্যিস আমাদের পৃথিবীর দুই চৌম্বক মেরু এই CME মোকাবেলায় পর্যাপ্ত শক্তিশালী। তবে মাত্রাতিরিক্ত শক্তিশালী CME পৃথিবীতে আঘাত হানলে পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর পক্ষে তা আটকে রাখা সম্ভব হবেনা। যার দরুণ ঘটতে পারে অকল্পনীয় রকমের বিনাশ!
জনপ্রিয় ভিডিও গেমস Assassin’s Creed ও Knowing এর মত মুভিতে এই CME এর “কনসেপ্ট” ব্যবহার করতে দেখা যায়।
২. Nuclear EMP (Military EMP)
এটি মূলত পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বা বিকিরণ। এই রেডিয়েশন বিশ – ত্রিশ বা তারো বেশি কিলোভোল্ট পার মিটারের হয়।
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তির এই বিচ্ছুরণ এত বেশি শক্তিশালী যে হাজার হাজার মিটার দূরে থাকা ট্রাঞ্জিস্টর, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র, মোবাইল, সার্কিট, সলিড ড্রাইভ, এমনকি পেন ড্রাইভ পর্যন্তও চিরতরে অকেজো হয়ে যেতে পারে এর কবলে পড়লে। যদিও পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিত্যনৈমিত্তিক কোনো ব্যাপার নয়, আর এই EMP এর সময়কাল খুব কম হয়, তবু মানবসৃষ্ট EMPগুলোর মধ্যে এটা সবচে শক্তিশালী।
৩. Non Nuclear EMP (NNEMP) (Weaponry)
কখনো স্পেশাল অপস এর কোনো ফিকশন টিভি সিরিজ, মুভি বা Call of Duty, Battlefield, Rainbow সিরিজের মত গেম খেলেছেন?
দেখে থাকলে বা খেলে থাকলে খুব সহজেই মনে করতে পারবেন সেখানে EMP গ্রেনেড /EMP Bomb / EMP Detonator নামের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকে। যদিও কোনো দেশের সামরিক শক্তি কর্তৃক স্বঘোষিত তেমন কোনো EMP Grenade এর অস্তিত্ব এখন অবধি নেই, তবে EMP মিসাইল, EMP বোমা জাতীয় জিনিস পৃথিবীর বুকে বহু আগে থেকেই আছে। হয়তো ইতোমধ্যে এই প্রযুক্তি গোপন গবেষণাগুলোর মাধ্যমে আমরা যতটা ধারণা করছি তার চাইতেও অনেক বেশি এগিয়ে গেছে!
এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল CHAMP (Counter-electronics High Power Microwave Advanced Missile Project) মিসাইল এবং explosively pumped flux compression generator।
এইসব নন – নিউক্লিয়ার EMP অস্ত্রের রেঞ্জ খুব কম হলেও এগুলো লক্ষ্যের দিকে খুব ভালভাবে আঘাত হানতে পারে। এসব EMP Bomb জাতীয় ডিভাইসে তিনটি মুল অংশ থাকে।
১. ক্যাপাসিটর ব্যাংক, যা টিউবের ভেতরে থাকা সামান্য পরিমাণ বিস্ফোরোককে বিস্ফারিত হতে সাহায্য করে।
২. ধাতব আর্মেচার বা বিস্ফোরক রাখার টিউব। এখানে থেকে উৎপন্ন বিস্ফোরণের সাহায্যে পালস তৈরি হয়।
৩. ইলেকট্রিক লোডার ও সুইচ। এই দুটোর মাধ্যমেই ফ্লাক্স কমপ্রেশন প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চমাত্রায় উৎপন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ পরিবাহী কুণ্ডলীর মাধ্যমে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় পালস উৎপন্ন করে। যায় শর্ট রেঞ্জে নির্দিষ্ট সীমায় সেকেন্ডের মধ্যে EMP বিচ্ছুরিত করে আশেপাশে ডিভাইসকে অকেজো করে দিতে পারে!
খুব একটা প্রচলিত নাম না হলেও বিভিন্ন দেশের দ্বারা পরিচালিত স্পেশাল অপারেশনগুলোতে EMP Detonator বেশ কার্যকরী জিনিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তবে এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে বাঘা বাঘা হ্যাকাররা বা অপরাধীরাও ঘটিয়ে ফেলতে পারে মহা বিপত্তি! যা প্রভাব পড়তে পারে অনেকের উপর।
পরিশেষে বলা যায়, EMP সামরিক ক্ষেত্রে কার্যকরী এক এ্যান্টি ইলেকট্রিক উইপন হলেও বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, সামরিক সংস্থাসহ প্রতিটি বড়মাপের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীগুলোর উচিত তাদের ডেটা স্টোরেজগুলো EMPর মত ভয়ানক শক্তি থেকে সুরক্ষিত কোথাও রাখা। আজ এইটুকুই।
পরেরবার হয়তো আসবো আবার কোনো নতুন বিষয় নিয়ে।
One Comment
আলট্রাশর্ট পালস, এবছর পদার্থে নোবেলের বিজয়গাঁথা | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] […]