সভ্যতার গতিশীলতা যার উপর ভর করে শুরু হল সেটা হল চাকা। চাকা যানবাহনে ব্যবহৃত একপ্রকারের বৃত্তাকার যন্ত্রাংশ। চাকার কেন্দ্রস্থলের অবস্থিত অক্ষ বরাবর এটি ঘুরতে পারে। চাকার উপরে গড়িয়ে গড়িয়ে যানবাহন অবস্থান পরিবর্তন করে থাকে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে চাকার আবিষ্কারকে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে ধরা হয়।
মানুষের ধীর গতির জীবনে গতির সূচনা করে এই চাকা। চাকা আবিষ্কার এর পূর্বে মানুষকে নিজেই বইতে হত নিজের বোঝা। সভ্যতার ক্রমবিকাশ এর সাথে সাথে গতিশীলতা আনতেও চায় মানুষ আর এই গতিশীলতাকে কেন্দ্র করেই মানুষ প্রথমে গবাদিপশু গরু, গাধা, ঘোড়া, উট প্রভৃতি প্রাণীর পিঠে বোঝা বইতে শুরু করে। মানুষ যে সবসময়ই গতি পছন্দ করতো, করে তা প্রকাশ পেতে থাকে ধীরে ধীরে। একপর্যায়ে গাছের গুঁড়ির চাকতি কেটে তার মাঝ বরাবর ছিদ্র করা হয়। এটাই ছিলো সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম চাকা।

এই চাকা আবিষ্কার এখানেই থেমে থাকল না। এবার এতে যুক্ত হলো একটি দণ্ড। দুই চাকাকে জুড়ে দিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত হলো কাঠের পাটাতন। তৈরি হয়ে গেলো পৃথিবীর প্রথম গাড়ি। যা বর্তমান গরুর গাড়ির সাথে মিল রয়েছে।
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে তিন থেকে তিন হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমানে ইরান) আবিষ্কার হয় এ চাকা।
ককেশাসের উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে, যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেয়া হতো। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরানো নিদর্শন বা চিহ্ন।
পরবর্তীতে নানাভাবে চাকার বিবর্তন হয়েছে। কাঠের চাকা দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়া এবং ফেটে যাওয়ায় এতে লোহার পাতলা পাত লাগানো হয়। এক পর্যায়ে পাতের জায়গা দখল করে পাতলা রাবার। সর্বশেষ রাবারের চাকা ও টিউব আবিষ্কৃত হয়।

বর্তমানে শুধু গাড়ি নয়, নানা ধরনের যন্ত্রে চাকার ব্যবহার আছে। সুতা কাটার চরকা, ভারি জিনিস তোলার কপিকল, গিয়ার- ইত্যাদি চাকারই পরিবর্তিতরূপ।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ নাগাদ চাকার ব্যবহার ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের দিকে। চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায় ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, যখন চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন হয়। তবে ঐতিহাসিক বারবিয়েরি-লো (২০০০) এর মতে আরো পূর্বে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের দিকে চীনে চাকার প্রচলন ছিলো।
শুরুতে চাকা নির্মাণ করা হতো শুধু কাঠের চাকতি দিয়ে। স্পোকযুক্ত চাকার উদ্ভাবন হয়েছে বেশ পরে। এই চাকার ব্যবহারে গাড়ির ওজন কমে হালকা হয়। এতে এর গতি বাড়ে। প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আন্দ্রোনভ সংস্কৃতিতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার পাওয়া যায়। এর অল্প পড়েই ককেশাস এলাকার অধিবাসীরা ঘোড়ার গাড়িতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার শুরু করে। মূলত যুদ্ধে ব্যবহৃত রথে এধরণের চাকা তারা ব্যবহার করতো।
ওই এলাকা থেকে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে গ্রিক উপদ্বীপে। খ্রিষ্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দ নাগাদ কেল্টিকদের রথগুলোতে এমন চাকা ব্যবহার করা যেতো, যার পরিধি বরাবর লোহার বেষ্টনি দেয়া থাকতো। ফলে এ ধরণের চাকাগুলো অনেক মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হতো। স্পোকযুক্ত চাকা এভাবেই প্রায় অপরিবপর্তিত অবস্থাতে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্যবহৃত হয়ে আসে। ১৮৭০ খ্রিঃ এর দিকে চাকায় নিউম্যাটিক টায়ার ব্যবহার করা শুরু হয়।
আজকাল গাড়িতে যে চাকা দেখা যায় তার উদ্ভাবন হয় ১৯৬৭ সালে। যেখানে ১৩” এর ৪ টি স্পোক ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে ১৫” এর ৫ টি স্পোকযুক্ত গাড়ির চাকার তৈরি করা হয়ে থাকে।
সামগ্রিক ভাবে চাকার আবিষ্কার কেবল পরিবহন ব্যবস্থাই নয়, বরং প্রযুক্তির নানা দিকে নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। চাকা ব্যবহার করে জল চক্র (পানি তোলার এবং পানি হতে শক্তি আহরণের চাকা), গিয়ার চাকা, চরকা, ইত্যাদি তৈরি করা হয়। সাম্প্রতিক কালের প্রপেলার, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপ, এবং টারবাইন এরা সবই চাকারই পরিবর্তিত রূপ।
তথ্যসূত্রঃ
১. https://revolutionwheels.com/historWheel