তারকা এবং গ্যালাক্সি (ছায়াপথ) :
রাতের তারা ভরা আকাশ নিয়ে কৌতূহলী নেই এমন লোক হয়ত পাওয়া খুব কঠিন হবে। অবশ্য রাতের আকাশ নিয়ে ইন্টারেস্টিং সব প্রশ্ন আমরা ছোট বেলাতেই করতাম, বড় হবার সাথে সাথে সেই সব প্রশ্নও আমাদের মস্তিষ্ক থেকে আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে। যাই হোক রাতের আকাশে আমরা যেসব উজ্জ্বল বস্তু গুলো অআমরা দেখতে পাই তার বেশীর ভাগই তারকা নামেই পরিচিত। খালি চোখে আমরা যেসব তারকা দেখি তাদের বেশীর ভাগেরই দূরত্ব আমাদের থেকে কয়েকশত আলোক বর্ষের ভিতরে। এখন বলা যাক আলোক বর্ষ নিয়ে,আলোক বর্ষ হল দূরত্বের একক। তবে তা আমাদের দৈনিন্দন জীবনে ব্যাবহার হয় না,মহাজাগতিক দূরত্ব নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে এক অলোক বর্ষ বলে। আমাদের কাছাকাছি অবস্থিত একটি তারকার নাম প্রক্সিমা সেন্টোরী। এটি আমাদের থেকে চার আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত। এই রকম বহু সংখ্যক তারকা নিয়ে গঠিত হয় একেকটা গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। আমাদের সূর্য যে ছায়াপথে অবস্থিত সেই ছায়াপথের নাম মিল্কিওয়ে। সূর্যের মতো বহু তারকা আছে আমাদের এ মিল্কিওয়ে তে। এই ছায়াপথ গুলোর গঠন হয় সর্পিল আঁকারের।
হাবল এবং ছায়াপথ:
মহাবিশ্ব সম্পর্কিত আমাদের আধুনিক মানস চিত্রের শুরুটা হয় ১৯২৪ সালে। যখন এডুইন হাবল আমাদের দেখিয়েছিলেন আমাদের মিল্কিওয়েই একমাত্র ছায়াপথ নয় এরকম আরো অনেক ছায়াপথ আছে। হাবল কেবল মাত্র নয়টি ছায়াপথের দূরত্ব মাপতে পেরেছিলেন,যদিও এখন আমরা আধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যাবহার করে জনতে পারি এ পর্যন্ত দৃশ্যমান ছায়াপথের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ মিলিয়ন। এবং প্রতিটি ছায়াপথে আছে প্রায় এক লক্ষ মিলিয়ন তারকা। এই ছায়াপথ গুলোর মধ্যে আছে বিরাট বিরাট শূন্যস্থান। এই শূন্যস্থান গুলোর দূরত্ব এতটাই বেশী যে আপাত ভাবে তারকা গুলোকে স্থিরই মনে হতো। হাবল ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন এই দূরত্ব প্রত্যক্ষ ভাবে মাপা সম্ভব নয়। তাই সে পরোক্ষ পদ্ধতির আশ্রয় নেন। দূরত্ব মাপনের এই পদ্ধতিটি ছিল খুবই চমৎকার এবং বৃহৎ মাত্রিক বিবেচনায় নিখুঁত বটে। কোনো একটি তারকার আপাতদৃষ্ট উজ্জ্বলতা নির্ভর করে তার জ্যোতি এবং আমাদের কাছ থেকে তারাটির দূরত্বের উপর। এখন যেইসব তারকা মোটামুটি ভাবে আমাদের কাছে অবস্থিত সেই সমস্ত তারকার ক্ষেত্রে আমরা দূরত্ব এবং উজ্জ্বলতা সঠিক ভাবে মাপতে পারি,আর তা ব্যাবহার করে তারকাটির জ্যোতিও বের করতে পারি। আর একই জাতীয় সমস্ত তারকার জ্যোতি সর্বদা সমান হয়। এই তথ্য ব্যাবহার করে আমরা দূরবর্তী কোনো তারকার আপাত উজ্জ্বলতা ব্যাবহার করে তার দূরত্ব মাপতে পারি,যেহেতু তাদের জ্যোতি আমাদের জানা(একই জাতীয় তারকার জ্যোতি সমান হয়)। কোনো একটি ছায়াপথের অনেক গুলো তারকার দূরত্ব এভাবে মেপে বের করলে যদি দূরত্ব গুলো মোটামুটি কাছাকাছি হয় তাহলেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে মাপন ঠিক আছে। এভাবে করে এডুইন হাবল মোটামুটি নয়টি ছায়াপথের দূরত্ব প্রায় সঠিক ভাবে মেপে বের করে ফেলেন। এখন তারকা এবং ছায়াপথের দূরত্ব হয়ত সঠিক ভাবে মাপা গেল কিন্তু তারকা গুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও তো কিছু বলতে হবে। আসলে তারকা গুলো এতো দূরে অবস্থিত যে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত বলাটা প্রায় অসম্ভব। তবে কোনো তারকার তাপ বর্ণালী (বিভিন্ন রঙের সমারোহ) দেখে আমরা সেই তারকার তাপমাত্রা সম্পর্কে ধারনা করতে পারি। তাছাড়া একেক ধরনের তারকার বর্ণালী তে আমরা একেক ধরনের রঙ অনুপস্থিত দেখি। অআমরা জানি একেকটি মৌলিক পদার্থের জন্য একেক ধরনের রঙ দেখা যায়। তাই বর্ণালীতে উপস্থিত রঙ থেকে আমরা ওই তারকায় উপস্থিত মৌলিক পদার্থ সমূহের ধারনা পেতে পারি।
ডপলার ইফেক্ট:
১৯২০ সালে যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অন্য ছায়াপথের তারকাগুলি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন,তখন তারা একটি অদ্ভুত জিনিস দেখতে পান। আমাদের নিজেদের ছায়াপথের তারকাগুলির বর্ণালীতে যে রঙ গুলো অনুপস্থিত, অন্য ছায়াপথের বর্ণালীর ক্ষেত্রে সেই একই রঙ অনুপস্থিত। কিন্তু তাদের সব কটি ক্ষেত্রেই রঙগুলি বর্ণালীর লোহিত প্রান্তের দিকে বিচ্যুত এবং সেই বিচ্যুতির পরিমাণ একই। এই তথ্যের ফলশ্রুতি বুঝতে হলে অআমাদের বুঝতে হবে ডপলার অভিক্রিয়া। মানুষের চোখে যা বিভিন্ন বর্ণ বলে প্রতিভাত হয় সেগুলি হল আলোকের বিভিন্ন কম্পাঙ্ক। দৃশ্যসীমার ভেতরে সর্বনিম্ন কম্পাঙ্ক হলে তা হয় লাল আলো আর সর্বোচ্চ কম্পাঙ্ক হলে তা হয় নীল আলো। এখন কল্পনা করা যাক আমাদের কাছ থেকে স্থির দূরত্বে অবস্থিত তারকার মতো একটি আলোকের উৎস এবং কল্পনা করা যাক সেখান থেকে একটি স্থির কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট আলোক উৎসারিত হচ্ছে। স্পষ্টতই যে তরঙ্গ আমরা দেখতে পাই তার কম্পাঙ্ক এবং সেই তারকা গুলি থেকে উৎসারিত তরঙ্গের কম্পাঙ্ক অভিন্ন। অনুমান করা যাক উৎসটি আমাদের অভিমুখে চলতে আরম্ভ করল। উৎসটি যখন পরবর্তী তরঙ্গ শীর্ষ পাঠাবে তখন সেটি হবে আমাদের নিকটতর। অর্থাৎ তরঙ্গ শীর্ষ আমাদের কাছে পৌছাতে যে সময় লাগবে,সেটা উৎস যখন স্থির ছিল,তখন যে সময় লাগত তার চাইতে কম। অর্থাৎ দুটি তরঙ্গশীর্ষের মধ্যবর্তী সময় হবে স্বল্পতর। সুতরাং এক সেকেন্ডে আমাদের কাছে যে তরঙ্গ পৌঁছাবে(অর্থাৎ কম্পাঙ্ক) তার সংখ্যাটাও তারকার স্থির অবস্থানের তুলনায় বেশী হবে। অনুরূপভাবে উৎস যদি অআমাদের থেকে দূরে অপস্রিয়মাণ হয়, তাহলে আমাদের কাছে যে তরঙ্গ গুলি পৌঁছাবে তার কম্পাঙ্ক হবে ক্ষুদ্রতর। সুতরাং আলোকের ক্ষেত্রে আমাদের কাছ থেকে দূরে অপস্রিয়মাণ তারকাগুলি থেকে নির্গত আলোক বর্ণালীর লাল প্রান্ত অভিমুখে বিচ্যুত হবে(লাল বিচ্যুতি) এবং আমাদের অভিমুখে যারা চলমান তাদের বর্ণালীতে থাকবে নীল বিচ্যুতি। কম্পাঙ্ক ও দ্রুতির ভিতরে এই সম্পর্ককে বলা হয় ডপলার অভিক্রিয়া।
মহাবিশ্বের প্রসারণ:
অন্যান্য ছায়াপথের অস্তিত্ব আবিষ্কারের পর সে সময় ব্যায় করেন ছায়াপথ গুলির দূরত্ব এবং বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে। সেই সময় অধিকাংশ লোকের ধারনা ছিল ছায়াপথ গুলি বেশ এলোমেলো গতিতে চলমান। সুতরাং আশা ছিল নীল বিচ্যুতি এবং লাল বিচ্যুতির পরিমাণ প্রায় সমান হবার কথা। কিন্তু হাবল দেখালেন অধিকাংশ ছায়াপথেরই লাল বিচ্যুতি হচ্ছে,অর্থাৎ অধিকাংশ ছায়াপথই আমাদের দূরে অপসারণ করছে।তখন তারা রীতিমত বিস্মিত হলেন। আরো বিস্মিত হলেন যখন ১৯২৯ সালে হাবলের আর একটি পর্যবেক্ষণ ফল প্রকাশিত হল। ছায়াপথ গুলির লাল বিচ্যুতির পরিমাণ মোটেও এলোমেলো নয়। এই বিচ্যুতি আমাদের কাছ থেকে ছায়াপথ গুলোর দূরত্বের সমানুপাতিক অর্থাৎ অন্য কথায় ছায়াপথটি যত দূরে, তার দূরাপসরনের গতিও তত বেশী। এর অর্থ হল মহাবিশ্ব স্থিতাবস্থায় নেই। এই তথ্য আবিষ্কারের পূর্বে মহাবিশ্বের স্থিতাবস্থা নিয়ে মানুষ কতটা বিশ্বাসী ছিল তা বোঝা যায় যখন খোদ আইনস্টাইনই স্থির মহাবিশ্বে বিশ্বাস করতেন। ১৯১৫ সালে যখন তিনি ব্যাপক অপেক্ষবাদ গঠন করেন, তখন তিনি মহাবিশ্বের স্থির অবস্থা গঠনের জন্য তার সূত্রে কসমোলজি কনসট্যান্ট (সৃষ্টিতাত্বিক ধ্রুবক)নামের একটি ধ্রুবক ব্যাবহার করেন। যাই হোক এখন আমরা জানি যে মহাবিশ্ব মোটেও স্থিতিশীল নয়,তা প্রসারমান।
One Comment
kamruzzaman Emon
নক্ষত্রগুলোর ডপলার ইফেক্ট থেকে মহাবিশ্বের প্রসারণ সম্পর্কে আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু কারণ সম্পর্কে জানি না। প্রসারণের কারণ নিয়ে বিস্তারিত লেখা চাই 😀
আর হ্যা, চমৎকার এই লেখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। ডপলার ইফেক্টের ব্যাখ্যাটা একটু সহজ করলে আরো চমৎকার হতো 😀