গত ৪ঠা আগস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে স্থানীয় সময় সন্ধ্যার দিকে ঘটে এক বিশাল বিস্ফোরণ যা কেড়ে নেয় প্রায় দেড়শো এর ও বেশি মানুষের প্রাণ এবং আহত হয় তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। তাছাড়াও গৃহহীন হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেন শহরটির পোর্টের কাছে থাকা একটি স্টোর হাউজে ২৭০০ টন এমোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ করা ছিল এবং সেখান থেকেই বিস্ফোরণটি ঘটে।
এমোনিয়াম নাইট্রেটের সংকেত হচ্ছে NH₄NO₃ যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানা আকারে উৎপাদন করা হয়ে থাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে ব্যবহৃত অন্যতম প্রধান সার। তাছাড়াও এই এমোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন খনিতে বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজে। জ্বালানী তেলের মাধ্যমে একে ইগনাইট করে বিস্ফোরণ ঘটানো খুবই সহজ। শিল্পক্ষেত্রে এরকম এমোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরণের পেছনে অনেক গুলো কারণ দায়ী থাকে যা বৈরুতে ঘটেছিল।

কী কারণে ঠিক বিস্ফোরণটা ঘটতে পারে?
এমোনিয়াম নাইট্রেট নিজ থেকে কখনো জ্বলে না। এর পরিবর্ততে এটি অক্সিজেনের উৎস হিসেবে কাজ করে যা খুব সহজেই অন্যান্য উপাদান গুলোকে জ্বালিয়ে দিতে পারে। দহন হওয়ার জন্য অবশ্যই অক্সিজেন উপস্থিত থাকতে হবে, দানাদার এমোনিয়াম নাইট্রেট অক্সিজেনকে আরো বেশি ঘন করে দেয়। এজন্যই এটি খনন কাজে এত বেশি ব্যবহার করা হয়। আবার অতি উচ্চ তাপমাত্রায় এমোনিয়াম নাইট্রেট ভয়ংকর ভাবে নিজ থেকেই বিয়োজিত হতে থাকে, এর ফলে খুব তাড়াতাড়ি নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং পানির বাষ্প তৈরি হয়। এত দ্রুত গ্যাসের এই ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমেই ঘটে বিস্ফোরণ। যেখানে এমোনিয়াম নাইট্রেট রাখা আছে সেখানে আশেপাশে আগুন থাকলে উপরের প্রক্রিয়াটা ঘতে। ২০১৫ সালে পূর্ব চীনের একটি রাসায়নিক কারখানায় এরকম ভাবে এমোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বিস্ফোরণ ঘটে যার ফলে প্রাণ হারায় ১৭৩ জন মানুষ। একে বলা হয় তিয়ানজেন ট্রাজেডি। আসলে কীসের কারণে বৈরুতে এই ঘটনাটি ঘটেছে স্পষ্ট জানা না গেলেও ফুটেজ থেকে দেখা যায় পোর্টের ১২ নং ওয়ারহাউজ যেখানে এমোনিয়াম নাইট্রেট রাখা ছিল সেটির ছাদে আগুনের শিখা তৈরি হয়েছে। আগুন খুব কাছে না থাকলে এবং বেশিক্ষণ ধরে না জ্বললে এমোনিয়াম নাইট্রেটকে ট্রিগার করা সম্ভব না। অবশ্যই বিস্ফোরণের জন্য এক্ষেত্রে অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ দ্বারা প্রজ্জ্বলিত করতে হবে এমোনিয়ামকে। হয়ত এমনই কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল সেইদিন।

বিস্ফোরণের স্বীকার বাসিন্দাদের ঝুঁকি
বৈরুতের সেই বন্দরে প্রায় ৬ বছর ধরে মজুদ ছিল ২৭০০ টন এমোনিয়াম নাইট্রেট কোনো রকমের সতর্কতা ছাড়াই। একটি এমোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণ বিপুল পরিমাণে নাইট্রোজেন অক্সাইড তৈরি করে। নাইট্রোজেন অক্সাইডের রঙ লাল, এর গন্ধও খুবই বাজে রকমের। বিস্ফোরণের ছবি দেখেই লাল ধোঁয়া সনাক্ত করা যায় যে এখানে প্রচুর নাইট্রোজেন অক্সাইড রয়েছে। নাইট্রোজেন অক্সাইড বায়ু দূষণের অন্যতম প্রভাবক যা তৈরি করতে পারে মারাত্মক সব শ্বাসনালীর সমস্যা। বৈরুত বিস্ফোরণে উৎপন্ন ধূম্র খুবই মারাত্মক প্রভাব ফেলবে ওই এলাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের উপর যতক্ষণ না এটি প্রাকৃতিক ভাবে মিলিয়ে যায়। অনেকদিন পর্যন্ত এই অবস্থা স্থায়ী হতে পারে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুস্মারণ
বিভিন্ন দেশে এমোনিয়াম নাইট্রেট সার অথবা বিস্ফোরণ হিসেবে প্রায়ই মজুদ রাখা হয় এবং নিত্য আমদানি রপ্তানি তো রয়েছেই। এমোনিয়া গ্যাস এবং লিক্যুইড নাইট্রিক এসিডের সংমিশ্রণেই এটি তৈরি হয়। এমোনিয়াম নাইট্রেটকে অনেক আগেই ভয়ংকর রাসায়নিক পদার্থের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয় যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ রয়েছে। বৈরুতের ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কীভাবে গাছে দেবার সার ধ্বংস করে দিতে পারে মানুষ এবং একটি শহরকে…
তথ্যসূত্রঃ scientific american, The Conversation