এ বছর ইউরোপের ফ্রান্সে মহাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এই হিটওয়েভের কারণে ফ্রান্সে সরকার জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে। জনসাধারণকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেছে।
এই তাপমাআত্রা বৃদ্বির কারণে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হিটওয়েভের কারণে জলোচ্ছাস, বনে আগুন থেকে শুরু করে প্লেন ভুপতিত হওয়া সহ রেল লাইন বেকে যাওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এজন্য স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বাতাসের ব্যাপারেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। জুনে দেশটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঠেকেছিল। ফ্রান্সের অন্যান্য জায়গাতেও এমন ভীষণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে। জার্মানীতে লোকজন বরফজমা পানি বোতলে করে নিয়ে ঘুমিয়েছে। ফ্রান্সে কিছু অস্থায়ী পুল চালু করা হয়েছে যাতে করে মানুষ-জন এই অতিমাত্রার গরমে সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।
এখন কেন এমনটা ঘটছে?
উচ্চ বায়মণ্ডলীয় চাপের কারণে উত্তর আফ্রিকা, পর্তুগাল, স্পেন থেকে উত্তপ্ত বাতাস উত্তর ইউরোপের দিকে বয়ে আসছে। একই ভাবে বলা যায়, সাহারা ম্রুভূমি থেকেও গরম বাতাস আসছে।

European Centre for Medium-Range Weather Forecasts (ECMWF) এর টিমোথি হাডসন বলেছেন, আকাশ মেঘমুক্ত এবং অস্বাভাবিক রৌদ্রউত্তাপের কারণে জুন মাসের তাপমাত্রা এমন বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও বলেন মাটি শুকনো থাকার কারণে বাষ্পীকরণ কম হয়েছে, যা কিনা মাটিকে ঠাণ্ডা রাখে। যদিও হিট ওয়েভ এই অঞ্চলে নতুন কিছু নয়, তবুও আবহাওয়াবিদরা বলছেন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃধির কারণে এরকম ঘনঘন হিটওয়েভের স্বীকার হচ্ছে ইউরোপ।

UK’s Meteorological Office এর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ গ্রাহাম মেজ বলেছেন, আবহাওয়ার পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। পুর্ব-ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেভেলের তুলনায় বর্তমানে সারাবিশ্বের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। এরফলে, এরকম চরম আবহাওয়া ভবিষ্যতে প্রতিনিয়ত দেখা যাবে।
এখন আমরা এক ডিগ্রী বা তার থেকে বেশী হিট ওয়েভের মুখোমুখি হচ্ছি। ভবিষ্যতে একারণে এসব হিটওয়েভ আরো বেশি বেশি ঘটবে।
১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে এথেন্সে ইউরোপের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রী রেকর্ড করা হয়েছিলো। গত বাইশ বছরে তাপমাত্রার গড় স্বাভাবিক থাকলে ছিলো। কিন্তু World Meteorological Organization (WMO) এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০১৮ এর তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪ তাপমাত্রার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
মানুষের কারণেই কি তাপমাত্রার বৃদ্ধি হচ্ছে?
গত বছর ইউরোপ জুড়ে ঘটা হিট ওয়েভ নিয়ে World Weather Attribution গ্রুপের গবেষণা সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, এই মহাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি তথা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষের কার্যকলাপ দায়ী। যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে, ২০৪০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই ইউরোপ জুড়ে এমন হিটওয়েভ ঘটতে থাকবে। ২১০০ সালের মাঝে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩-৫ ডিগ্রী বৃদ্ধি পাবে।
হিটওয়েভ কী?
পৃথীবীর একেক অঞ্চলের পরিবেশ একেক রকম হওয়ার কারণে , একেক অঞ্চলের জলবায়ু একেকরকম। তাই হিটওয়েভের কোনো অভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। তবে সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, হিটওয়েভ হচ্ছে একটি অঞ্চলের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। দৈনিক তাপমাত্রার থেকে ৫ ডিগ্রী বা তারচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাবে এবং অন্তত তিনদিন বা এর অধিক সময় ধরে এরকম অধিক তাপমাত্রা বজায় থাকবে। এছাড়াও আরও কিছু বিষয় যেমন রাত্রীকালীন তাপমাত্রা, আদ্রতা, বাতাসের গতির উপর হিটওয়েব নির্ভর করে। আদ্রতা এবং বাতাসের নিম্মগতির কারণে হিটওয়েভের আশংকা বেড়ে যায়। জনবহুল অঞ্চলে যেখানে মানুষের কার্যকলাপ বেশি, অধিক বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, কংক্রিট রয়েছে সেসব জায়গায় হিটওয়েভ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
হিটওয়েভ বিপজ্জনক কেন?
Met Office climate স্পেশালিস্ট মেজ বলেছেন “যদি তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রীর নিচে না নামে তবে দূর্বল মানুষেরা রাতারাতি অসুস্থ হয়ে পড়ে।”
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, যারা মাথা ব্যাথা, মাথা ঘোরানো, বিস্বাদ লাগা, বমি বমি ভাব, অতিরিক্ত ঘামা পেটে ব্যাথা, দ্রুত নিশ্বাস অথবা অতিরিক্ত পানি পিপাসার সমস্যায় ভুগছেন তাদেরকে হিটওয়েভ থেকে দূরে থাকতে হবে। যদি কারও শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রীর থেকে বেড়ে যায়, তবে সে মানুষটির হিট স্ট্রোকের ঝুকি বেড়ে যায়। এধরণের মানুষের দ্রুতই স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আবার কিছু বিপজ্জনক চিহ্ন দেখা যেতে পারে। যেমন ঘামানো বন্ধ হওয়া ,কিংবা নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া। হিট স্ট্রোকের কারণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পার্মানেন্ট ড্যামেজ সহ রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ইউরোপে ২০০৩ সালের হিটওয়েভের পর থেকে গতবছর পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার মানুষ হিটওয়েভের কারণে মারা গিয়েছে।
তথ্যসুত্রঃ BBC