“কি গরম রে বাবা। এত গরমে তোমার ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা জাগল কি করে?” ঘাম মুছতে মুছতে আমি প্রফেসর সাইরেক্স কে জিজ্ঞাসা করলাম। কিছু দিন হলো সে আমার বাসায় এসেছে। বার্লিন থেকে কি একটা প্রাইজ আর উপাধি পেয়ে সোজা আমাদের বাসায় চলে এসেছে। মহাশয় বড় রকমের বিজ্ঞানী। আমি আবার বিজ্ঞান-টিজ্ঞান প্রফেসরের মত অত বুঝি না, তবে সামান্য জ্ঞান তো আছেই।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরেও উত্তর পেলাম না।বুঝলাম উত্তর আর পাওয়া যাবে না।
“তোর ছায়াটা দেখেছিস? “অতঃপর মুখ খুললেন। “হ্যাঁ, দেখছি। কেন কি হয়েছে?” প্রফেসর মহাশয় সম্ভবত বিজ্ঞান কপচানো শুরু করবে।
“ভালো। বল তো ছায়া কি?” বিপাকে পড়লাম। ছায়ার কোনো বৈজ্ঞানিক ডেফিনিশন আছে নাকি?
ছায়া কি?
“কি। পারলি না তো? আমিই বলছি। আলো সরল রেখায় চলে। এই চলার পথে সামনে কোনো বস্তুতে বাধা পেলে বস্তুটির আলোর বিপরীত দিকে একটি অন্ধকার আবহ তৈরি হয়, যাকে ছায়া বলা হয়।”
“এই সংজ্ঞা তো আমিও বুঝি। এখানে নতুন আর কি হলো? শুধু পেট থেকে মুখে আসতে দেরি হচ্ছিল, এই যা।” আমাকে প্রশ্ন করছে, আমি কেন করব না? “আচ্ছা প্রফেসর, আলো যেহেতু বাধা পায় ই তারপরেও তো ছায়ার মধ্যে দিয়ে বস্তুকে দেখা যায়। আলো বাধা পেলে বস্তু দেখছি কিভাবে?”
“আলো বাধা পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু বস্তুটার অন্য পাশ থেকে আলো আসছে কিনা? তাই বলেই তো ছায়া কে পুরোপুরি কালো দেখায় না।” “তাই বলে ছায়ার রং শুধু কালো হবে?”
রঙ্গিন ছায়া!
“ছায়ার রং বিভিন্ন রকমের হতে পারে। তবে সেটা সাধারণত দেখা যায় না। বিভিন্ন রঙের ছায়া তখনই দেখা যায়, যখন একের অধিক ভিন্ন বর্ণের আলো একই তলকে আলোকিত করে। তখন ওই আলোগুলোর সামনে বস্তু রাখলে বিভিন্ন রঙের ছায়া দেখা যায়। একদিন তোকে হাতে কলমে দেখিয়ে দিব। এই পরীক্ষা খুবই সহজ।” (পরবর্তীতে এ নিয়ে বিস্তারিত পোস্ট হবে)
সে আরো বলতে লাগলো, “ছায়ারও কিন্তু গতি আছে। এই গতি আলোর গতির সমান।”
“ছায়ার গতি আলোর গতির সমান কিভাবে?”
“ছায়া তৈরি হয় আলোর অনুপস্থিতিতে। মনে কর তুই দেয়ালে আলো ফেললি। এই আলো ৩ লক্ষ কি.মি./সে. গতিতে যাচ্ছে। তুই যদি আলোর সামনে দাড়াস, তৎক্ষণাৎ আলোর সামনে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তোর ছায়া তৈরি হবে। এই ছায়া তৈরি হবে সেই গতিতে যেই গতিতে আলোর আসা বন্ধ হয়েছিলো।
আবার এমন কিছু উদাহরণ আছে যা দেখে মনে হতে পারে ছায়ার গতি আলোর চেয়ে বেশি। যেমনঃ মনে কর তুই খুব শক্তিশালী একটা আলোর উৎস চাঁদের উপর ফেললি। আর আলোর সামনে তোর আঙুল নাড়াচাড়া করছিস। তোর আঙুল যদি এক সেমি সরাস চাদে তৈরি হওয়া ছায়ার ক্ষেত্রে সেটা কয়েক কিলোমিটার সরে যাবে। কারন আলোর যে তলে ছায়া তৈরি হবে, তুই সেই তল থেকে যত দূরে যাবি তোর ছায়া তত বড় হবে অর্থাৎ বস্তু থেকে তলের দূরত্ব, ছায়ার আকারের সমানুপাতিক। তবে এটাকে তুলনাকে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে গ্রহণ করা যায় না। কারন ছায়া তো আলোর মত অস্তিত্ব নাই। মানে আলো তো ফোটন কণা দিয়ে তৈরি। কিন্তু ছায়া তো কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি না। আর তাছাড়া তুই আলোর সামনে আঙুল নাড়াচ্ছিস পৃথিবী থেকে, পৃথিবীতে সত্যিকারে তোর আঙুল নড়েছে মাত্র ১ সেমি”
“বাহ বেশ মজার ব্যাপার তো”
পৃথিবী গোলাকার প্রমান করে দিলো ছায়া
“আরো আছে। পৃথিবী যে গোলাকার, সমতল নয় সেটা প্রমাণ করা সম্ভব ছায়া দিয়ে। ইরাতস্থিনিস সেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। মধ্য দুপুরে যখন সূর্য একেবারে মাথার উপরে থাকে ৯০৹ কোণে, তখন কিন্তু মসৃণ লাঠির মত বস্তুর কোনো ছায়া পড়ে না। যদি লাঠিটা ৯০৹ কোণে লম্বভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ, ওই সময় সূর্যের আলো লাঠিটার উপরে একেবারে লম্বভাবে আলো দেয়, তাই লাঠিটার পুরো জায়গায় আলো পরে। সব জায়গায় আলো পড়লে তো আর ছায়া তৈরি হওয়ার সুযোগ পাবে না। এই ঘটনাকে ভিত্তি করেই উনি পরীক্ষাটি করেছিলেন।
উনি প্যাপীরাসের গ্রন্থ থেকে জানতে পারলেন সায়েনে ২১ জুন বস্তুর ছায়া মধ্যদুপুরে মিলিয়ে যায়।এরাটোসথেনেস একটা পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়াতে ২১ জুনের মধ্যদুপুরে একটি উলম্ব লাঠি ছায়া প্রদান করে কিনা । পরীক্ষার পর তিনি আবিষ্কার করলেন, লাঠি ছায়া দিচ্ছে ।
এরাটোসথেনেস নিজেকে প্রশ্ন করলেন কীভাবে, একই সময়ে সায়েনে একটি লাঠি ছায়া প্রতিফলিত করছে না এবং অনেক উত্তরের দিকে অবস্থিত আলেকজান্দ্রিয়াতে লাঠি সুস্পষ্ট ছায়া প্রতিফলিত করছে । প্রাচীন মিশরের একটি মানচিত্র বিবেচনা কর, যেখানে থাকবে দু’টি সমদৈর্ঘ্যের উলম্ব লাঠি, একটি স্থাপিত হল আলেকজান্দ্রিয়াতে এবং অপরটি সায়েনে । মনে কর, একটি বিশেষ মুহূর্তে কোন লাঠিই কোন ছায়া প্রক্ষিপ্ত করছে না । এটি সহজে বোধগম্য হত যদি ভূপৃষ্ঠ সমতল হত । তখন সূর্য থাকত খাড়া মাথার উপরে । যদি দু’টি লাঠি সমদৈর্ঘ্যের ছায়া প্রদান করত, সেটিও একটি সমতল ভূপৃষ্ঠের ধারণাকে প্রকাশ করত । তখন সূর্য-রশ্মি দু’টি লাঠিতেই আনত থাকত সমান কোণে । কিন্তু এটি কি করে ঘটল যে, একই সময়ে সায়েনে কোন ছায়া পাওয়া গেল না, অথচ আলেকজান্দ্রিয়াতে পাওয়া গেল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ছায়া ?
এরাটোসথেনেস বুঝতে পারলেন, এর একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হল এই যে, পৃথিবীর পৃষ্টটি বক্র । শুধু তাই নয় বক্রতা যত বেশি হবে, ছায়ার দৈর্ঘ্যের পার্থক্যও তত বেশি হবে । সূর্য পৃথিবী থেকে এত দূরে অবস্থিত যে, যখন এর রশ্মিসমূহ ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছায়, তখন তা সমান্তরাল থাকে।”
” সমতলবাদীরা কি এই তথ্য জানে না? এ থেকে তো সহজেই প্রমাণিত হচ্ছে পৃথিবী বক্রাকার। মানে গোলাকার।”
আগুনের ছায়া আছে!
“তারা মূলত স্বার্থের জন্য ভুল তথ্য ফেরি করে বেড়ায়। সত্যিটা তো তারাও জানে। ছায়ার এই ঘটনা নিয়ে অনেকের মনেই ভুল ধারণা আছে। কিছুদিন আগে আমি এক ফোরামে দেখলাম, একজন প্রশ্ন করেছে আগুনের ছায়া দেখা যায় না কেন? বেশ কয়েকজন উত্তর দিয়েছে আগুনের ছায়া দেখা যায় না কারন এটা নিজেই একটা উৎস। কিন্তু একজন ভিন্নধর্মী উত্তর দিলো। সে বললো মোমবাতির শিখার ছায়া দেখা যায় তার মানে আগুনের ছায়া আছে। সেটা কিন্তু ভুল। কারন আগুনের ঘনত্ব খুবই কম। তার মাঝে এত ক্ষমতা নেই যে সে আলোকে বাধা দিতে পারবে। ফলে সাধারণ গ্যাসের আগুনের ছায়া দেখা যায় না। কিন্তু মোমবাতির মধ্যে রয়েছে কার্বন। মোমবাতি জ্বলার সময় কার্বনের ধোয়া অবিরত তৈরি হতে থাকে। যেহেতু কার্বন ভারী তাই সে আলোকে বাধা দিতে পারে। ফলে আগুনের শিখার ছায়া তৈরি হয়। ”
চলবে…
SOURCE : VSAUCE
Leave a Reply