আজকে আমরা জানবো সেরা ৫ টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সম্পর্কে যেগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখা কিছুটা হলেও আবশ্যক তো বটেই।
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বলতে বোঝায় যেখানে টার্বাইন, জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। বেশ কিছু জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় যেমনঃ জল,তেল, কয়লা, সূর্যের আলো ,ভূ-তাপ, বায়ু,গ্যাস ইত্যাদি।
তো চলুন দেখে নেওয়া যাক সবচেয়ে বড় ৫ টি পাওয়ার প্ল্যান্ট ও তাদের ক্যাপাসিটি সম্পর্কেঃ
১। থ্রি গর্জেস বাধে অবস্থিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ

চীনের হুবেই প্রদেশে অবস্থিত এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হবেই না বা কেন??? ২২৫০০মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আর কি আছে??
প্রায় ২.৩৩৫কিমি দৈর্ঘ্য এবং ১৮১ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট বাধের উপর ভিত্তি করেই এর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র চলমান ।
এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী – Yangtze River এর বুকে বাধ স্থাপন করে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। চীনের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর জন্যে চীন ফসিল ফুয়েল বেজড বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুকেছে, কিন্তু এত পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য তো শুধু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া সম্ভব নয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই থ্রি গর্জেস জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি একাধারে চীনের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার মাত্র ১.৭% মেটায়, যদিওবা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে অন্তত ১০% চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে, কিন্তু চীনের বিদ্যুৎ চাহিদার উর্ধ্বমুখী গ্রাফের কারণে সে লক্ষ্যে পৌছাতে পারেনি।
৩২ টি ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ও ২টি ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটর ইউনিট এর সাহায্যে ২২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়ে থাকে, যার মধ্যে ৩২ টি জেনারেটরের একেকটির ওজন ৬০০০টন করে এবং যা কিনা সর্বোচ্চ ৭৫৬ মেগাওয়াট পাওয়ার জেনারেট করতে পারে এছাড়া জেনারেটিং ভোল্টেজ ২০কেভি(২০০০০ভোল্ট), জেনারেটরের দক্ষতা গড়ে ৯৪%, প্রায় ৯৬.৫% পর্যন্ত পৌছাতে পারে।
৪৫% ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর নিয়ে এর বার্ষিক উৎপাদন দাঁড়ায় ৮৭ টেরাওয়াট আওয়ারে। ২০১৮ সালে সেটা ১০০ টেরাওয়াট আওয়ার অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে যা চীনের সম্পূর্ন জলবিদ্যুৎ প্রজেক্ট এর ১৪%।
বছরে প্রায় ১০০ মিলিয়ন টন গ্রিন হাউস গ্যাস এর নিঃসরণ কমাতে সক্ষম হয়েছে এর দ্বারা চীন।
২। ইতাইপু বাধে অবস্থিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ

পারানা নদীর উপর ইতাইপু বাধ দ্বারা নির্মিত ইতাইপু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন ক্ষমতার দিক দিয়ে দ্বিতীয় হলেও বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতার দিক দিয়ে থ্রি গর্জেস জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে টপকিয়ে গেছে ২০১৬ সালে।
ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের যৌথ উদ্যোগের ফল এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ২০টি ইউনিটের মাধ্যমে ১৪০০০মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যেখানের প্রতিটি জেনারেটর ৭০০মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম।
তন্মধ্যে ১০টি ইউনিট ব্রাজিল এর জন্যে ৬০ হার্জে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং অপর ১০টি ৫০ হার্জে প্যারাগুয়ের জন্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
এদিকে প্যারাগুয়ের আবার এত বিদ্যুৎ দরকার পড়ে না, তাই তারা সেটা ব্রাজিলের কাছে বিক্রি করে দেয়। প্রায় ৩যুগের ও বেশি সময় চলা এই বাধের উচ্চতা ১৯৬মিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ৭.৯ কিলোমিটার।
৭৩% ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর নিয়ে ২০১৮ সালে এর বার্ষিক উৎপাদন ছিল প্রায় ৯৬.৫৮৬টেরাওয়াট আওয়ার যা থ্রি জর্জেস থেকে কিছুটা কম।
৩ .চীনের ইউনান প্রদেশের জিন্সা নদীর উপর নির্মিত Xiluodu বাধের উপর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ

এই বাধের ফলে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা ১৩৮৬০ মেগাওয়াট যা বিশ্বে ৩য় বৃহত্তম বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তকমা জুটিয়েছে। মাত্র ৭০০ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এবং ২৮৫.৫ মিটার উচ্চতা যা কিনা বিশ্বের ৪র্থ উচ্চতম বাধ, এর উপর ভিত্তি করে ১৮ ইউনিটের (প্রতিটি ৭৭০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন) সমন্বয়ে ১৩৮৬০মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম।
বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫৫.২ টেরাওয়াট আওয়ারের আশেপাশে। ২০১৩-২০১৪ সালে এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে খুলে দেওয়া হয়। দুটি আন্ডারগ্রাউন্ড পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়ে থাকে, যার প্রতিটি পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্যে ৯টি ফ্রান্সিস টার্বাইন জেনারেটর রয়েছে।
৪।সাইমন বলিভার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র:

ভেনিজুয়েলার বলিভার প্রদেশের ক্যারনি নদীর উপর নির্মিত বাধের পানির আটকিয়ে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে।
লম্বায় ৭৪২৬ মিটার এবং উচ্চতায় ১৬২ মিটার নিয়ে এই বাধ প্রায় ৪২৫০ বর্গকিলোমিটার এরিয়া জুড়ে পানি সঞ্চয় করে রাখে। প্রায় ২১ টি ইউনিটের সাহায্যে ১০২৩৫ মেগাওয়াট পাওয়ার উৎপাদিত হয় যা বার্ষিকভাবে গড়ে ৪৭ টেরাওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে,যা একে ৪র্থ বৃহত্তম পাওয়ার প্ল্যান্টের তকমা দিয়েছে।
২০১৯ সালে যখন এই প্ল্যান্ট ফেইল করে তখন প্রায় ৩২মিলিয়ন মানুষ ব্ল্যাকআউটের শিকার হয়েছিল, বাধের পানির উচ্চতা কমে যাওয়ার ফলে প্ল্যান্ট শাটডাউন হয়ে গিয়েছিল। এই প্ল্যান্ট ভেনিজুয়েলার এক তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।
৫।বেলো মন্টে বাধের উপর নির্মিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র :

ব্রাজিলের পারা প্রদেশের জিংগু নদীর উপর স্থাপিত লম্বায় ৩৫৪৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৯০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট বেলোমন্টে বাধ দিয়ে পানি আটকিয়ে পানির বিভব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টার্বাইন ঘুরিয়ে জেনারেটর এর সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যার পরিমাণ ১০০১০মেগাওয়াট যা ১৬ টি ইউনিটের সমন্বয়ে উৎপাদিত হয়ে থাকে। সর্বোচ্চ ১১২৩৩ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট এটি।
বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৩৯.৫টেরাওয়াট আওয়ার যা একে ৫ম বৃহত্তম পাওয়ার প্ল্যান্টে রুপান্তরিত করেছে।

এখানে ৩টি বাধ মিলে একটি বাধ বানানো হয়েছে। মাত্র ৩৯% ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর নিয়ে এটি ব্রাজিলের সবচেয়ে কম কর্মদক্ষতা সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র।
যাই হোক আপনারা হয়তোবা ভাবছেন সেরা ৫ টি পাওয়ার প্ল্যান্টের ৫টি ই কিভাবে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র হয়?
FACT: যে পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর যত বেশি হবে সেটা তত বেশি ইউনিট জেনারেট করতে সক্ষম।
যেমন: চীনের থ্রি জর্জেস হাইড্রোপাওয়ার প্ল্যান্টের ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর মাত্র ৪৫% হওয়ার এর প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি ২২৫০০মেগাওয়াট হওয়ার পরেও এটা পাওয়ার উৎপাদনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় কেননা এটি বছরে ৯৩.৫টেরাওয়াট ইউনিট পাওয়ার জেনারেট করে।
অপরদিকে ব্রাজিলের ইতাইপু বাধের জল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওয়ার জেনারেট করার ক্যাপাসিটি ১৪০০০মেগাওয়াট হলেও এটি বছরে ৯৭টেরাওয়াট ইউনিট পাওয়ার জেনারেট করে শুধুমাত্র এর ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর ৭৩% হওয়ায়।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০ টি পাওয়ার প্ল্যান্টের মধ্যে ৯ টি ই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। যাই হোক চলুন দেখে নেওয়া যাক কোন কোম্পানি সবচেয়ে বেশী রাজস্ব আদায় করে বিদ্যুৎ থেকে (২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী)ঃ
10. E.ON – ৩৬.৯৪বিলিয়ন ডলার
9. Siemens -৩৮.৪২বিলিয়ন ডলার
8. General Electric Co -৩৮.৫ বিলিয়ন ডলার
7. Iberdrola- ৩৯.৭৯বিলিয়ন ডলার
6. Engie- ৪৮.৮বিলিয়ন ডলার
5. KEPCO -৫৩.৫ বিলিয়ন ডলার
4. TEPCO -৫৫.৩৬ বিলিয়ন ডলার
3. EDF – ৭৭.৮ বিলিয়ন ডলার
2. Enel – ৮৫.২৮ বিলিয়ন ডলার
1. State Grid Corporation of China – ৩৪৭ বিলিয়ন ডলার ( বার্ষিক বিদ্যুৎ বেচা হয় মাত্র ৩৮৭৪ টেরাওয়াট ইউনিট। )
বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলোর কি সক্ষমতা নেই এত পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার?
আছে অবশ্যই তবে এত বেশী পরিমাণে নেই, কিন্তু এত বড় আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সক্ষমতা কেবল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ই আছে, কারণ হল, পানি সহজলভ্য, বাধ নির্মাণ করে পানি আটকিয়ে সহজেই এই পানির বিভব শক্তি বাড়িয়ে প্রচন্ড গতিতে টার্বাইন ঘুরানো সক্ষম, যা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে এত পরিমাণে সম্ভব নয়, আবার কার্বণ নিঃসরণ মাত্রাও অনেকাংশে কমিয়ে আনে।
জ্বালানি(পানি) সবসময় রেডি, শুধু বাধ নির্মান করে সহজেই একটি অঞ্চলের বিদ্যুৎ-এর চাহিদা মেটানো সম্ভব।
কিন্তু সমস্যা হল, প্রচুর খরুচে পাশাপাশি অনেক জায়গা দখল করে রাখে। আবার পানির স্তর নিচে নেমে গেলে আশানুরূপ পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশেও কাপ্তাইয়ে ২৩০মেগাওয়াট এর একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, বর্তমানে সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদীতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা যাচাই করা হচ্ছে, সফল হয়ে গেলে সেখানে ৭০ এবং ১৪০ মেগাওয়াট এর দুটি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে।

SOURCE: https://www.forbes.com/sites/jamesconca/2017/08/10/the-biggest-power-plants-in-the-world-hydro-and-nuclear/#7429fb572c88