১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
এর আগের পর্বে আমরা জেনেছিলাম ফ্লাইং সসারের সহজসরল ডেফিনিশন, কেন এর নামকরণ ফ্লাইং সসারই হলো,বিভিন্ন দেশের মানুষের ফ্লাইং সসার দেখা এবং সেই সাথে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
তাহলে দেরি কেন। আজকে আরও কিছু নতুন তথ্য জেনে নেয়া যাক।
ফ্লাইং সসার নিয়ে যখনই আলোচনার ঝড় উঠেছে তখনই জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন তর্ক-বিতর্ক। অনেকেই মনে করেন ইউ.এফ.ও শুধুই সসার আকৃতির,তবে সে ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। অনেক ইউ.এফ.ও গোলক আকৃতির, অনেক গুলো সিগার আকৃতির, আবার কেউ কেউ বলে পিরামিড এর মতো ইউ.এফ.ও ও নাকি দেখেছেন তারা।
আচ্ছা বাস্তবে কি ফ্লাইং সসারের অস্তিত্ব আছে নাকি এটা শুধুই মানব মস্তিষ্কের হ্যালুস্যিনেশন?
২৪০ খ্রিস্টপূর্বে হ্যালির ধূমকেতু চীন জ্যোতির্বিদগণ লিপিবদ্ধ করেছেন ও এসব লিপি থেকে আকাশের বিভিন্ন বিস্ময়কর ঘটনা নিয়ে মানুষের কৌতূহল উত্তেজনা উদ্দীপনার সীমা নেই। তেমনি ফ্লাইং সসার নিয়েও নিয়ে মানবসভ্যতার কৌতূহল আশ্চর্যর কোন সীমা নেই।
১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় হাজারখানেক লোক ফ্লাইং সসার দেখেছে বলে দাবি করে। ১৯৪৮ সালের এক গোপন নথিপত্র অনুযায়ী, কয়েকজন সুইডিশ ইনভেস্টিগেটার সসারকে পৃথিবী বহির্ভূত বস্তু (Extraterrestrial Object ) বলে দাবি করেন। এই নথিপত্র প্রকাশিত হওয়ার পর, পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন ইত্যাদি ফ্লাইং সসার এর উপর গবেষণার জন্য বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রজেক্ট ব্লু বুক, প্রজেক্ট টুইংকেল, অপারেশন সসার ইত্যাদি।
প্রজেক্ট ব্লু বুক নং – ১
১৯৫২ সালে জুলাই মাসে ওয়াশিংটন ডিসির বিমানবন্দরে মার্কিন বিমান বাহিনীর তত্ত্বাবধানে দেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি গবেষণা সংস্থা গঠিত হয়েছিলো। প্রজেক্টটির প্রধান ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউয় অব টেকনোলজি থেকে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এইচ.পি. রবার্টসন। তাকে সাহায্য করার জন্য সেই প্রকল্পে নেয়া হয় ইঞ্জিনিয়ার,পদার্থবিজ্ঞানী,আবহাওয়া বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি দল।প্রকল্পটিতে অত্যন্ত গোপনে গবেষণা চালাচ্ছিলো তারা। তবে প্রকল্পটি তেমন সফলতা অর্জন করে নি। কারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিলো তার শতকরা ৯৫ভাগ তথ্যই বিভ্রান্তিকর ছিলো।
১৯৫২সালের ২০ ই নভেম্বর জর্জ এডামিক্স যে সসারটি দেখেছিলেন তার প্রকৃত রহস্য পরে উদঘাটিত হয়। সসারটি ছিলো ঘণ্টা আকৃতির এবং তিনি তার একটি ছবি তুলতেও সক্ষম হন। ছবিটি নিয়ে পরে চুলচেরা গবেষণা করা হয়। এর অন্যতম গবেষক মার্কিন লেখক ফ্রাংক এডওয়ার্ড। গবেষণা থেকে উঠে আসে,ছবিটি আসলে ১৯৩৭সালের দিকে তৈরি ক্যানিষ্টার ধরণের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার।
ছবিটি নিয়ে নভোচারী ডোনাল্ড ম্যানজেল মন্তব্য করেছেন,
ছবিটি আসল নয়। এটা আদৌ কোন সসার নয়।
১৯৬৬ সালের ১১ই নভেম্বর, রাশিয়ান মহাকাশযান “জেমিনি-১২” এর দুজন নভোযাত্রী এডুইন অলড্রিন এবং জিম নোভেল ফ্লাইং সসার দেখেছেন বলে দাবী করেন। তাও আবার একটি নয়,একই সাথে চার চারটি ফ্লাইং সসার দেখেছেন এবং এই খবর জানিয়ে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে বার্তা পাঠান। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো পরে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে জানা যায়, তারা আসলে যে চারটি জিনিসকে সসার বলে দাবী করছিলেন সেগুলো আসলে ঘণ্টাখানেক আগে মহাকাশযান থেকে ফেলা চারটি আবর্জনার ব্যাগ। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ঘটনা আরও অনেক ঘটেছিলো।
১৯৬৮সালের জানুয়ারি মাসের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি বিভ্রান্তিকর ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের কলোর্যাডো ক্যাসল রক নামক একটি স্থানে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫জন লোক তীব্র আলোর ঝলকানিসহ প্রচণ্ড বেগে উড়ে আসছে এমন একটি বস্তু দেখে এবং এটিকে সসার বলে দাবি করে। কিন্তু পরে নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, সেটি আসলে মোমবাতি জ্বালানো গরম বাতাস ভর্তি একটি বেলুন।
ফ্লাইং সসার নিয়ে এতো সব বিভ্রান্তিকর ঘটনাগুলোর একটা ফাইনাল ডিসিশন দরকার হয়ে পড়ে। যার ফলে তৈরি হয় প্রজেক্ট ব্লু বুক নং ২।
প্রজেক্ট ব্লু ব্লক নং ২(কনডন রিপোর্ট) :
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন আরেকটি প্রজেক্ট তৈরি করা হয়। নতুন প্রজেক্টটিতে কাজ করেছিলেন বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণ্যমান্য বিজ্ঞানীরা। প্রজেক্টটিতে বিজ্ঞানীরা প্রায় ১৮মাস ধরে টানা গবেষণা চালিয়েছিল এবং এটিই তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল।
১৯৪৮ সালে মার্কিন বিমান বাহিনীদের উদ্যোগে ফ্লাইং সসার নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের সংখ্যা ছিল ১২,৬১৮টি। গবেষণার রিপোর্ট তৈরি শেষ হয় ১৯৬৭ এর জুনে।
রিপোর্টটি চূড়ান্ত ভাবে পর্যালোচনা করে National Academy of Science. দেড় হাজার পৃষ্ঠার এই রিপোর্টটির নাম দেওয়া হয়েছিলো “কনডন রিপোর্ট”।
প্রকল্পটির গবেষণা শেষে এর সাথে যুক্ত প্রায় সব বিজ্ঞানীরা একই মন্তব্য করেন যা পর্যালোচনা করলে জানা যায়,
ফ্লাই সসার বা মহাকাশে আগন্তুক এমন ধারণা করার পক্ষে তেমন জোরালো কোন যুক্তি নেই। বরং এমন ভ্রান্ত ধারণা প্রত্যাখ্যান করাই যুক্তিসঙ্গত ও বুদ্ধিমানের কাজ।
একটি ফ্লাইং সসার কতদূর উড়তে সক্ষম হবে এবং সর্বোচ্চ কত উচ্চতায় উঠতে পারবে বা এটির আকার আয়তন নিয়ে এখনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় নি। সম্প্রতি ইরান একটি আকাশযান তৈরি করেছে। গবেষকদের দাবি, তারাই প্রথম ফ্লাইং সসার তৈরি করেছে। ইরানের তৈরি এই সসারটির নাম ‘জোহাল’, যার ইংরেজি অর্থ Saturn আর বাংলা অর্থ শনি।
তারা আরও দাবী করেছেন বিশ্বের প্রথম ফ্লাইং সসারটি দেখতে ১৯৫০-এর দশকে হলিউডের বি ক্যাটেগরির সিনেমায় দেখানো ভীন গ্রহ থেকে আসা চাকতি আকারের ফ্লাইং সসার-এর মতো।
গবেষকরা জানিয়েছেন মূলত এই সসারটি এরিয়াল ফটোগ্রাফি(aerial imaging)বা আকাশ থেকে ছবি তোলার জন্য তৈরি করা হয়েছে। তবে এটি নানারকম যুদ্ধ বিগ্রহ ও মিশনেও অংশ নিতে সক্ষম।
মানুষ ফ্যান্টাসি প্রিয় ঠিকিই তবে ইউ এফ ও পুরোটাই মানুষের ফ্যান্টাসি নয়। ইউ.এফ.ও দেখার হাজারখানেক বা তার ও বেশি উদাহরণ ব্যাপারটাকে অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত করে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
রেফারেন্স :
১. https://www.techtunes.co/sci-tech/tune-id/61629
২.বই : মহাকাশের বিস্ময় ফ্লাইং সসার
লেখক : খায়রুল আলম