জেনারেটরঃ এক রহস্যময় যন্ত্রের গল্প

১৭৯১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ইংল্যান্ডে নিউইংটন বাটস অঞ্চলে কামার পরিবারে একটি শিশুর জন্ম হলাে। শিশুটির নাম রাখা হয় ফ্যারাডে। চার ভাইবােনের মধ্যে ফ্যারাডে ছিলেন তৃতীয়।

বাবা জেমস ছিলেন একজন কামার। আর্থিক অনটনের মধ্যেই ফ্যারাডে বড় হতে থাকেন। বাড়ির কাছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার পড়ালেখা শুরু হয়। ফ্যারাডের উচ্চারণে। সমস্যা ছিলাে। তিনি “র” উচ্চারণ করতে পারতেন না। এটা নিয়ে সবখানে হাসাহাসি হতাে। এমনকি স্কুলেও। সামান্য যােগ, বিয়ােগ, গুণ ও ভাগ পর্যন্তই ছিলাে তার গণিতের দৌড়! তারপর অর্থের অভাবে মাঝপথেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। এরপর আর কোনাে দিন। স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তার।

মাইকেল ফ্যারাডে

মাত্র ১৩ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে কাজ নেন একটি বইয়ের দোকানে। সেখান থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন। এর পর কাজ নেন বই বাঁধাইয়ের দোকানে। কাজের ফাঁকে অবসর পেলেই বসতেন বই নিয়ে। বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলাে তাকে বেশি আকর্ষণ করত। কিছুদিনের মধ্যে তিনি তার বাড়িতে বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য ছােট একটা ল্যাব তৈরি করে ফেলেন। হাত খরচের পয়সা বাঁচিয়ে গবেষণার জন্য একটা দুটো করে জিনিস কিনতেন। আবার ফেলে দেওয়া আবর্জনা থেকে অনেক পুরােনাে জিনিস সংরক্ষণ করতেন। ২১ বছর বয়সে একদিন হঠাৎ করে তিনি স্যার হামফ্রের সাথে কাজ করার সুযােগ পেলেন।

হামফ্রে তাকে ল্যাবরেটরির বােতল ধােয়ার কাজ দিলেন। কাজের ফাঁকেই তিনি হামফ্রের গবেষণা মনযােগ সহকারে দেখতেন। দেখা, শেখা আর নিজের প্রচেষ্টা। এর পথ ধরে তিনি মানবজাতির উন্নয়নে রাখেন মহা মূল্যবান অবদান ।

তার যুগান্তকারী আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে চৌম্বকের সাথে তড়িতের সম্পর্ক। এর মাধ্যমেই শক্তির এক বিশাল রূপান্তর মানবজাতির হাতে আসে।

এই আধুনিক যুগে বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের এক মূহুর্তও চলা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনারা কি জানেন, এই তড়িৎ কীভাবে, কোথা থেকে উৎপন্ন হয়? আর কাদের হাত ধরেই বা এই অতি মূল্যবান শক্তি আমাদের সেবায় নিয়ােজিত?

১৭৩৩ সালে ডাচ বিজ্ঞানী পিটার ভ্যান স্থির তড়িৎ ধরে রাখার জন্য লেডেনজার নামে এক প্রকার যন্ত্র তৈরি করেন। ১৭৪৮ সলে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০) পিটার ভ্যানের কয়েকটা লেডেনজার সেল একত্র করে তৈরি করেন তড়িৎ ধারক বা ব্যাটারি। তিনি এই ব্যাটারিকে চার্জ করার জন্য এক প্রকার যন্ত্র ব্যবহার করেন। সেটাই ছিল সম্ভবত প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র। যাকে জেনারেটরের আদিরূপ বলা যেতে পারে। যদিও জেনারেটরের সাথে এর কোনাে মিল নেই।

লেডেনজার সেল

তড়িৎ এবং চুম্বকত্বের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে স্থির বৈদ্যুতিক নীতির উপর ভিত্তি করেই জেনারেটর নির্মিত হত। ব্রিটিশ উদ্ভাবক জেমস উইমহার্স্ট এমন একটি স্থির বৈদ্যুতিক যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যার নাম উইমহার্স্ট যন্ত্র।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে স্যার হামফ্রে ডেভির ল্যাবে কাজ করার সময় ফ্যারাডে লক্ষ্য করেন, একটা তারের কুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে চুম্বককে আনা-নেওয়া করলে ভােল্টেজ উৎপন্ন হয়।

এই আবিষ্কারকে ফ্যারাডের তড়িচ্চুম্বকীয় নীতি বলা হয়। এই নীতির উপর ভিত্তি করে ফ্যারাডেই প্রথম তড়িচ্চুম্বকীয় জেনারেটর তৈরি করেন যা চল তড়িৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। তার জেনারেটর বা ডায়নামােটিকে “ফ্যারাডে ডিস্ক’ বলা হয়। অশ্বক্ষুরাকৃতির একটি চুম্বকের দুই মেরুর মাঝখানে স্থাপিত কপার চাকতির ঘূর্ণন ব্যবহার করে এই যন্ত্রে বিদ্যৎ উৎপাদন করা হয়।।

একটি চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে পরিবাহীকে ঘুরালে ইলেকট্রনের প্রবাহ হয়। আর ইলেকট্রন প্রবাহই যে তড়িৎ তা তােমরা অনেকেই জানাে। কোনাে পরমাণুর শেষ কক্ষপথের ইলেকট্রন প্রবাহ হলেই তা তড়িতে রূপ নেয়।

জেনারেটর কী?

জেনারেটর আমরা কমবেশি সবাই চিনি। জেনারেটর ইংরেজি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ হলাে যে যন্ত্র কোনাে কিছু উৎপন্ন করে বা জেনারেট করে। কিন্তু কী উৎপন্ন করা? উত্তর হলাে। এনার্জি বা শক্তি। অর্থাৎ আমরা যদি কোনাে জেনারেটর চালু করি তাহলে সেটি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণের ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি উৎপন্ন হবে। যেহেতু এখানে যান্ত্রিক ক্ষমতাকে বৈদ্যুতিক ক্ষমতায় রূপান্তর করা হচ্ছে সেহেতু এটিকে আমরা রূপান্তরকও বলতে পারি।

জেনারেটরের গঠন।

জেনারেটরে মূলত দুটি মৌলিক অংশ থাকে। যে অংশ চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে তাকে বলা হয় ম্যাগনেটিক সার্কিট। স্থির থাকে বলে একে স্টেটও বলা হয়। আর যে অংশ তড়িৎ উৎপাদনের কাজে নিয়ােজিত সেটার নাম ইলেকট্রিক সার্কিট। এটা ঘুরে বলে একে রােটর বলা হয়।

জেনারেটরের মূল কাঠামােকে ফ্রেম বা মূল বডি বলা হয়। যা জেনারেটরের বহিরাবরণ। এর মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্বে খাঁজ কাটা থাকে। এই খাঁজের মধ্যে কৃত্রিম চৌম্বক তৈরির জন্য পরিবাহী বসানাে থাকে। এই পরিবাহীতে বাইরে থেকে তড়িৎ সরবরাহ করে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিকে এক্সাইটেশন বলা হয়। এই চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুকে পরস্পর লম্বভাবে আকর্ষণ করে। একে লাইন অফ ফোর্স বলা হয়। পরিবাহীকে এই চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে ঘুরানাের ফলে লাইন অফ ফোর্স পরিবাহী দ্বারা কর্তন এবং ভােল্টেজ ইৎপন্ন হয়। খুব ছােট মােটর বা জেনারেটরের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চুম্বক ব্যবহার করা হয়। সাধারণ ৬ ভােল্ট এর উপরের মােটর বা জেনারেটরের জন্য কৃত্রিম চৌম্বক ব্যবহার করা হয়।

চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে পরিবাহীকে একটি রােটরের মধ্যে বসানাে হয়। এই চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে ঘুরানাের জন্য বাহিরে থেকে যান্ত্রিক শক্তি প্রয়ােগ কার হয়। এই যান্ত্রিক শক্তিকে প্রিমুভার বলা। হয়। ঘর্ষণজনিত বাধা এখানে যান্ত্রিক শক্তির অপচয়ের মূল কারণ। রােটরকে বাধাহীনভাবে। ঘােরানাে এবং ঘর্ষণ বাধা কমানাের জন্য দুই পাশে বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়।

জেনারেটর কীভাবে কাজ করে?

প্রিমুভার দিয়ে যখন রােটরকে ঘুরানাে হয়, তখন ফ্যারাডের তড়িচ্চৗম্বক নীতি অনুসারে রােটর জড়ানাে পরিবাহীতে বিভব (voltage) পার্থক্য দেয়। আমরা তাে জানি, বিভব পার্থক্য হলেই তড়িৎ প্রবাহ তৈরি হয়। মজার ব্যাপার হলাে, যে অংশকে ঘুরানাে হয়, তড়িৎ উৎপন্ন হয় সেই অংশেই।

উৎপন্ন তড়িৎকে এক প্রকার ব্রাশের মাধ্যমে ঘুরন্ত অংশের বাহিরে আনা হয়। প্রিমুভার দিয়ে কয়েল যত বেশি জোরে ঘুরানাে যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন তত বেশি হবে। সবসময় যে চৌম্বকক্ষেত্রই স্থির থাকবে তা নয়। হাই ভােল্টেজ উৎপাদনের সময় ঘুরন্ত পরিবাহী থেকে তড়িৎ বাহিরের সার্কিটে আনা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাড়ায়। এ কারণে পরিবাহীকে স্থির রেখে চৌম্বকক্ষেত্রকে ঘুরানাে হয়। এই মেশিনকে জেনারেটর না বলে। অল্টারনেটর বলা হয়। জেনারেটরে সাধারণত এসি (Alternating Current) তড়িৎ উৎপন্ন হয়। নানা সুবিধার জন্য একে ডিসি (Direct Current) বিদ্যুতে রূপান্তর করে ব্যবহার করা হয়। তাপ এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা, এই সমস্যা সমাধানের জন্য ইন্টারনাল ইক্সোস্ট ফ্যান ব্যবহার করা হয় ।। জেনারেটর আর মােটরের মৌলিক গঠনগত কোনাে পার্থক্য নেই। জেনারেটরে যান্ত্রিক (Mechanical) শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করে। আর মােটর বৈদ্যুতিক শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে। ছােট পরিসরের জন্য জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। আর বাণিজ্যিকভাবে তড়িৎ উৎপাদনের চনা অল্টানেটর ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলােতে মূলত। অল্টারনেটর ব্যবহার করা হয়। বন্ধরা একটু হলেও তােমরা শক্তির এই বিশাল রূপান্তরক সম্পর্কে জানলে। আশা করি জানার আগ্রহ তােমাদের আরাে জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করবে।

তাহলে আজ এ পর্যন্তই। ভাল থেকবেন। আবার দেখা হবে।

তথ্য সুত্রঃ The royal institution [TRI], PHYS ORG

https://bigganbortika.org/three-gorges-dam/

Comments are closed.