মহাকর্ষ তরঙ্গঃ আইনস্টাইন তুমি আবারও জিতে গেলে…

শুরু করার আগে বলে নেই যে আজকে কেন বিজ্ঞানীদের জন্য ঈদের দিন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা কি সেটা না জানলেও এই নামের সাথে মোটামুটি সবাই বেশ পরিচিত। তো যাই হোক, আপেক্ষিকতা আবিষ্কারের পর থেকেই এই থিওরি বেচারাকে অনেক চরাই উতরাই পেরুতে হয়েছে। এই থিওরিকে প্রমান করার জন্য যত পরীক্ষা চালানো হয়েছে তার সব কটাতেই এটা সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু কেবলমাত্র একটা পরীক্ষা কোনভাবেই করা যাচ্ছিল না। কারণ পরীক্ষাটা করার জন্য যথেষ্ঠ উন্নত প্রযুক্তি আমাদের ছিল না। পরীক্ষাটা হল ‘মহাকর্ষ তরঙ্গ এর অস্তিত্ব প্রমান’। আপেক্ষিকতা অনুযায়ী কোন তরণশীল ভরযুক্ত বস্তু তার চলার জন্য আশেপাশের স্থানকে বাকিয়ে ফেলে এবং এর ফলে স্থানের উপর দিয়ে একটা তরঙ্গ বয়ে যায়। এই তরঙ্গটাকেই বিজ্ঞানীরা গত ১০০ বছর ধরে খুজে পাচ্ছিলেন না। এই পরীক্ষাটাই ছিল আপেক্ষিকতার জন্য চূড়ান্ত এবং কঠিন প্রমাণ। কিন্তু এতেও আইন্সটাইন সফলভাবে পাশ করে গিয়েছে :p


এইবার একটু খোলাসা করা যাক। পানিতে ভরযুক্ত কিছু ফেললে পানিতে একটা তরঙ্গ বয়ে যায়। বাতাসেও তরঙ্গ তৈরি হয় যাতে করে শব্দ চলে বেড়াতে পারে। এভাবে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ হল আলো। যাই হোক, এভাবে স্থানেও তরঙ্গ তৈরি হয়। আমাদের জানা ৩ টি মাত্রা দিয়েই আমাদের পরিচিত স্পেস। এই স্পেসে অবস্থিত প্রতিটি বস্তুর জন্য স্থান কিছুটা বেকে যায়। যেমন আপনি যদি একটা চাদর টানটান করে ধরে রেখে তাতে একটা ফুটবল বসিয়ে দেন তাহলে দেখবেন যেখানে বল রেখেছেন সেখানে চাদরের স্থানটা বেকে গিয়েছে। যত বেশি ভারী বল রাখবেন চাদর তত বেশি বেকে যাবে। যেমন টেনিস বলের চেয়ে ফুটবলে চাদর বেশি বাকবে। ঠিক তেমনিভাবে স্থানেও কোন বস্তুর জন্য স্থান বেকে গিয়ে বক্রতা তৈরি হয়। যত বেশি ওজন তত বেশি বক্রতা। এখন যদি এই বস্তুগুলো তরনে চলা শুরু করে তাহলে তারা পানির মত স্থানেও তরঙ্গ সৃষ্টি করবে। পানিতে একটা ছোট ঢিল মারলে ছোট তরঙ্গ আর বড় ঢিলের জন্য বড় তরঙ্গ তৈরি হয়। তাই বস্তুর ভর যত বেশি হবে তরঙ্গও তত বড় হবে।

আমরা মহাকর্ষ তরঙ্গের ব্যাপারটা মোটামুটিভাবে বুঝলাম। এবার জানব LIGO ( Laser Interferometer Gravitational-wave Observatory) ‘র বিজ্ঞানীরা কিভাবে এটি শনাক্ত করল।

মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকরণের ব্যাপারটা খুব বেশি জটিল না। শুধুমাত্র একটু ট্রিক্স খাটাতে হয় আরকি। আচ্ছা, আমরাতো জানি যে আলোর গতি ধ্রুব। অর্থাৎ এ দিয়ে বুঝতে পারি যে পৃথিবীতে এক কিলোমিটার পথ যেতে আলোর যে সময় লাগবে মঙ্গল গ্রহেও ঐ এক কিমি পথ যেতে একই সময় লাগবে। এরকমই একটা মডেল তৈরি করেছে LIGO আর এতে সহায়তা করেছে ক্যালটেক আর MIT ‘র বিজ্ঞানীরা। এখানে একটা মূল পয়েন্ট থেকে লেজার রশ্মির মাধ্যমে দুইপাশে আলো নিক্ষেপ করা হয়। এই দুইপাশের দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার। তাহলে কোন লেজার রশ্মির এই ৪ কিমি দুরত্ব অতিক্রম করার প্রয়োজনীয় সময় একই হওয়া উচিত। 


আচ্ছা, পানিতে যখন তরঙ্গ তৈরি হয় তখন পানির উপরের পৃষ্ঠের আয়তন বেড়ে যায়। ঠিক তেমনি গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের কারণে স্থান হ্রাস বৃদ্ধি পায়। এই হ্রাসকৃত স্থানের কারণেই LIGO
 তে যে ৪ কিমি পথ তৈরি করা হয়েছিল তাতে আগের থেকে বেশি সময় লাগবে। এই মহাকর্ষ তরঙ্গ (gravitational wave) খুবই ক্ষুদ্র হয়। এই কারণে এই সামান্য হ্রাস বৃদ্ধি নির্নয় করতে অনেক বেশি সেনসিটিভ যন্ত্রের প্রয়োজন। LIGO একটা পরমানুর ব্যাসার্ধের ১/১০০০ মিটারের সমান পর্যন্ত পরিবর্তন নির্ভুলভাবে মাপতে পারে। তাই একটা মহাকর্ষ তরঙ্গ যখন পৃথিবীর উপর দিয়ে বয়ে চলে তখন স্থানের বৃদ্ধি হয়। আর এই কারনে ঐ যে ৪ কিমির দুটো পথের মধ্যে সময়ের পার্থক্য দেখা দেয়। এই সময়ের পার্থক্যের একমাত্র কারণ হল এই মহাকর্ষ তরঙ্গের কারণে তৈরি স্থান কালের বক্রতা।

LIGO
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ টাইম ট্রাভেল, হিমাংশু কর।

এবার জেনে আসি LIGO কোন ধরনের অথবা কিসের জন্য তৈরি হওয়া মহাকর্ষ তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছে। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে সৌর ভরের প্রায় ৫০ গুন ভরের দুইটা ব্ল্যাক হোলের সন্ধান মিলেছে। এখানে ব্ল্যক হোল দুটি পরস্পরকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে আলোর ৫০% গতিতে। একে বলা হয় বাইনারী ব্ল্যাক হোল সিস্টেম। এটাই এ পর্যন্ত পর্যবেক্ষনযোগ্য প্রথম কোন বাইনারী ব্ল্যাকহোল ছিল। আচ্ছা, আমরা জানি যে বস্তু তার ভরের জন্য স্থানে বক্রতা তৈরি করে। এখন যদি এই ভরযুক্ত বস্তুটা গতিশীল হয় তাহলে একটা তরঙ্গের সৃস্টি হবে। কিন্তু এই তরঙ্গ হবে খুবই সূক্ষ। তাই এর পরিমাপের জন্য অনেকবেশি সেন্সিটিভ যন্ত্রের দরকার যা LIGO ‘র আছে। 

২০০২-২০১২ পর্যন্ত LIGO একটিও মহাকর্ষ তরঙ্গ আবিষ্কার করতে পারে নি । তারপর ২০১২-২০১৫ পর্যন্ত ৩ বছরের খাটনির ফল হল Advanced LIGO. গত বছর ফেব্রুয়ারী মাসে যাত্রা শরু করে ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখেই বিশাল আবিষ্কার করে ফেলে LIGO. সেপ্টেম্বরে শনাক্ত হলেও এতদিন একে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল আরো চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে ১০০% শিওর হওয়ার জন্য। আর গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারী এই গবেষনার প্রেস রিপোর্টি দেখানো হয়েছিল।
এই হল মোটামুটি গল্প যা নিয়ে এত মাতামাতি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>