হকিং বিকিরণ

সহজ কথায় হকিং বিকিরণ হলো ব্ল্যাকহোল থেকে নির্গত বিকিরণ বা রেডিয়েশন। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তত্ত্বীয়ভাবে এই বিকিরণের ধারণা দেন, তাই এই বিকিরণের  নাম হকিং বিকিরণ বা হকিং রেডিয়েশন

আমরা সবাই কমবেশি ব্ল্যাকহোল এর কথা শুনেছি। এখন ব্ল্যাকহোল কি সেটা বুঝতে হলে আপনাকে অভিকর্ষ বা মহাকর্ষ  জানতে হবে। বিজ্ঞানী নিউটনের সেই বিখ্যাত আপেলের কাহিনী কে না জানে , আসলে আপেল পড়ার ঘটনা থেকে তিনি যে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন তা হলো মহাবিশ্বের যেকোন দুইটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে আর এই আকর্ষণ এর মান নির্ভর করে বস্তুদ্বয়ের ভরের উপর এবং মধ্যবর্তী দূরত্বের উপর। তাই আপেল আর পৃথিবীর মধ্যে আকর্ষণের জন্য আপেল উপরের দিক  অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দূরে না গিয়ে পৃথিবীর দিকেই চলে আসে কার আপেল আর পৃথিবী যদি একে অপরকে আকর্ষণ করে তবে পৃথিবীর আকর্ষণের মান আপেলের তুলনায় অনেক বেশি কারণ পৃথিবীর ভর আপেলের তুলনায় অনেক বেশি। একই কারণে  পৃথিবীর আশেপাশে নির্দিষ্ট সীমার ভিতর  অন্যকোন বস্তু থাকলে তা পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে। এখন আপনার আবার মনে হতে পারে তাহলে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের উপরে  প্লেন চলে কেমন করে,রকেট উড়ে কেমন করে অথবা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বা কেমন করে উড়িয়ে মহাকাশে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে? এর উত্তর হলো পৃথিবীর বা অন্য যেকোন নক্ষত্রের মহাকর্ষ বলের একটা লিমিট আছে যেটা নির্ভর করে ওই বস্তুর ভরের উপর, যা আগেই বলেছি।

এখন কোন বস্তুকে যদি এমন গতিতে মহাকাশের দিকে নিক্ষেপ করা হয় যে বস্তুটি পৃথিবীর এই মহাকর্ষ বলকে অগ্রাহ্য করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলে যেতে পারে, সেই গতিকে বলে ওই বস্তুর মুক্তিবেগ। এই মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি বেগে কোন বস্তুকে পৃথিবী থেকে নিক্ষেপ করলে তা আর পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে না। যে পদ্ধতিতে রকেট এবং স্যাটেলাইট পৃথিবীর বাইরে কক্ষপথে পাঠানো হয়। একথা শুধুমাত্র পৃথিবীর জন্য সত্য না মহাবিশ্বের যেকোনো বস্তু যেমন চন্দ্র, সূর্য, অন্যান্য নক্ষত্রের জন্যও সত্য। একটি নক্ষত্র তার জীবন দশায় কয়েকটি ধাপ পর করে, এর প্রত্যেকটি ধাপে নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ পদার্থের পরিবর্তন ঘটে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে।  এই পরিবর্তনের ধাপে ধাপে একটি নক্ষত্র লালদানব তারা,শ্বেতবামন তারা, নিউট্রন স্টার এবং অবশেষে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়ে জীবনাবসান ঘটায়।

এখন কথা হলো,

তাহলে কি সব নক্ষত্রই ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয় এর উত্তর হল না,সব নক্ষত্র ব্ল্যাকহোল হতে পারে না। এর জন্য একটি  নক্ষত্রের যথেষ্ট পরিমাণ ভর থাকা আবশ্যক আর সেই ভরের পরিমাণ হলো কমপক্ষে আমাদের সূর্যের ভরের তিনগুণ হতে হবে। এর কম হলে চলবে না বেশি হলে চলবে। কারণ একটি নক্ষত্রকে একটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত করতে হলে নক্ষত্রের  সমস্ত ভরকে যে পরিমাণ মহাকর্ষীয় বলে টেনে সংকুচিত করে প্রায় একটি বিন্দুতে পরিণত করতে হবে তার জন্য কমপক্ষে সূর্যের তিনগুণ ভারি হতে হবে। তাহলে আমরা একথা বলতে পারি যে আমাদের সূর্যের ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখন আসি ব্ল্যাকহোল এর চরিত্রের বিশ্লেষণে।  ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষ বল যে প্রচণ্ড বেশি তা নিশ্চয় আপনারা এতক্ষণের আলোচনা থেকে বুঝতে পেরেছেন, শুধু যে বেশি তা নয় রীতিমতো অসীম অর্থাৎ এর নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যা কিছু আসবে সবকিছুই সে গিলে খাবে। এমনকি জগতের সবচেয়ে গতিশীল আলোও তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ থেকে মুক্তি পায় না। যেমন মুক্তি মিলেছিল রকেট এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কারণ পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বল ব্ল্যাকহোলের মতো এতো বেশি না।

যদি বলেন আমাদের সূর্য এবং পৃথিবী কি কখনো ব্ল্যাকহোলের মতো মহাকর্ষ বল পেতে পারে??  তা হলে, সেই ব্ল্যাকহোল হতে হলে পৃথিবী কে ০.৮৯ সেন্টিমিটার এবং সূর্যকে ৩ কিলোমিটার  ব্যাসার্ধের বস্তুতে সংকুচিত করতে হবে (সম্ভব?)।

Computer artwork of black hole

এখন আসি আসল কথায়,

তো টপিকের নাম থেকে বোঝা যায় আজ হকিং বিকিরণ নিয়ে আলোচনা করা হবে যদিও এই ধারণটা পরিষ্কার করার জন্য এতক্ষণ এতকিছু লিখলাম।

হকিং বিকিরণ ( মাঝেমধ্যে  বেকেনস্টাইন-হকিং বিকিরণ ও বলা হয়) হল প্রয়াত  ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে একটি তত্ত্বীয় ( থিওরিটিক্যাল) ভবিষ্যদ্বাণী।
সাধারণত ব্ল্যাকহোলকে ধরা হয় এর আশেপাশের নির্দিষ্ট এলাকার সব বস্তু এবং শক্তি এর প্রচণ্ড মহাকর্ষীয় বলে টেনে নেয়। কিন্তু ১৯৭২ সালে ইসরায়েলি পদার্থবিদ বেকেনস্টাইন প্রস্তাব করেন ব্ল্যাকহোলের সুনির্দিষ্ট এন্ট্রপি( কোন বস্তু বা সিস্টেমের বিশৃঙ্খলার পরিমাপ)  থাকা উচিত। এবং ব্ল্যাকহোলের তাপগতিবিদ্যার এবং শক্তি নির্গমনের প্রক্রিয়ার উন্নয়নের  সূচনা করেছিলেন।  ১৯৭৪ সালে স্টিফেন হকিং দেখিয়েছিলেন কিভাবে ব্ল্যাকহোলে কৃষ্ণবস্তুর মতো বিকিরণ হয়। এই পদ্ধতির সহজ ব্যাখ্যা হলো এরকমঃ স্টিফেন হকিং অনুমান করেছিলেন ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনের (ঘটনা দিগন্ত) কাছাকাছি  শূন্যস্থানে শক্তির ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে পদার্থ -প্রতিপদার্থ(  Particle- Antiparticle) সৃষ্টি হয়। এর ভিতর একটি পদার্থ ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তে পড়ে যায় এবং অন্যটি ঘটনা দিগন্তে পড়ার আগেই বেরিয়ে আসে হকিং বিকিরণ হিসেবে।  যার ফলে ব্ল্যাকহোল দেখা যায়। কারণ এখানে পার্টিকেল (পদার্থ)  নির্গত হচ্ছে।
যেহেতু ঘটনা দিগন্ত থেকে মুক্তি পাওয়া পদার্থটির শক্তি বাইরের মহাবিশ্বের সাপেক্ষে ধনাত্মক  সেহেতু ব্ল্যাকহোলে পতিত পদার্থটির শক্তি হবে বাইরের মহাবিশ্বের সাপেক্ষে ঋণাত্মক। যার ফলে ব্ল্যাকহোল ক্রমাগতভাবে শক্তি এবং ভর  হারায়।  কারণ ভর -শক্তি অন্তঃপরিবর্তনশীল(E=mc^2সূত্র অনুযায়ী )।
ছোট প্রাইমর্ডিয়াল ব্ল্যাকহোল যে পরিমাণ শক্তি শোষণ করে তার তুলনায় বেশি শক্তি বিকিরণ করে, যার ফলে এগুলোর ভর কমে যায়। কিন্তু বড় আকৃতির ব্ল্যাকহোল যে পরিমাণ শক্তি হকিং বিকিরণের মাধ্যমে হারায় তার তুলনায় অনেক বেশি শক্তি মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে শোষণ করে।

হকিং বিকিরণের  দ্বিমত এবং অন্যান্য মতবাদঃ

যদিও বিজ্ঞানী মহলে হকিং মতবাদ গৃহীত হয়েছে তারপরও কিছু দ্বিমত এখনো রয়েছে।
কিছু বিজ্ঞানীর ধারনা এই তথ্যমতের চূড়ান্ত ফলাফল হয় তথ্য ( শক্তি)  হারিয়ে যায়,যেটা শক্তি অবিনশ্বর ধারনার সাথে সাংঘর্ষিক।
একইভাবে যারা ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় তাদের কাছে ব্ল্যাকহোল যে বস্তু শোষণ করে নেয় তা আরো বেশি অবিশ্বাস্য।এছাড়া কিছু বিজ্ঞানী হকিং মহাশয়ের অরিজিনাল ক্যালকুলেশনকেও চ্যালেঞ্জ করেন যেটা ট্রান্স-প্লাঙ্কিয়ান সমস্যা নামে পরিচিত।  এই চ্যালেঞ্জ এই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যে গ্র্যাভিটেশনাল হরাইজনের কাছাকাছি কোয়ান্টাম পার্টিকেল ( কোয়ান্টাম সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় এমন) যে অদ্ভুত আচরণ করে তা  স্পেস-টাইমে পর্যবেক্ষক এবং পর্যবেক্ষণ কাঠামোর সাপেক্ষে পর্যবেক্ষণ এবং পরিমাপ কোনটিই করা যায় না।কোয়ান্টাম ফিজিক্সের বেশিরভাগ বিষয়গুলোর মতো হকিং বিকিরণ এর দৃশ্যমান কোন পরীক্ষা করা প্রায় অসম্ভব।  তাছাড়া এই প্রক্রিয়া বর্তমান বিজ্ঞানের শর্তমতে পরীক্ষামূলক ভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য খুবই ক্ষুদ্র। যেমন এটার জন্য পরীক্ষাগারে হোয়াইট হোলের ইভেন্ট হরাইজন তৈরি করা- তাই এই তত্ত্বের পরীক্ষামূলক ফলাফল পাওয়া এখনো সম্ভব হয়নি। কে জানে কোন একদিন হয়তো প্রমাণ হয়েও যেতে পারে অথবা বিজ্ঞানের আরো অনেক তত্ত্বের মতো এটাও পরিত্যক্ত হয়ে যেতে পারে। আপাতত ততদিন এই এইটুকুই।

Comments are closed.