চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারঃ মাথা প্রতিস্থাপন

মাথা প্রতিস্থাপন শব্দটি যদিও এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেক পরিচিত । কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না এই শব্দটি একবারে নতুন নয় । এই বিষয়টি আসলে কখন থেকে আলোচনায় আসে সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না । তবে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তারমধ্যে সবচেয়ে পুরনো তথ্যটি ১৯৫৯ সালের।

এটিকেই যদি সবচেয়ে পুরনো তথ্য ধরি তাহলেও বিষয়টি প্রায় ৫৮ বছর পুরনো । অথচ এত পুরনো বিষয়টি কেনো সর্বাধিক আলোচনায় এসেছে এতদিন পর? এতদিন কেনো বিষয়টি আলোচনায় এলো না? অবশ্যই এর পিছনেও একটা কারণ আছে । আর কারণটি হল পূর্বে মাথা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াটি ছিল কুকুর,ইঁদুর সহ অন্যান্য প্রাণীদের উপর । কিন্তু এখন যেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন ।

তবে সর্বপ্রথম একটা বিষয় সম্পর্কে আমাদের সবাইকে জানা উচিত । সবাই বিষয়টি হয়ত ভুলভাবে বুঝে থাকেন। বিষয়টি হলো “মাথা প্রতিস্থাপন” । আসলে “মাথা প্রতিস্থাপন” বিষয়টা কি ? জীবন্ত শরীর থেকে মাথা কেটে অন্য নতুন শরীরে লাগিয়ে দেয়া ? অনেকেই হয়ত ভাবছেন উত্তরটা “হ্যাঁ” , তবে সঠিক উত্তর হলো–” না ” ।

“মাথা প্রতিস্থাপন” বা ইংরেজিতে যাকে বলে “Head Transplantation” প্রকৃতপক্ষে আসলে এটি একটি “পুরো শরীর প্রতিস্থাপন” প্রক্রিয়া । যেহেতু পূর্বে “পুরো শরীর প্রতিস্থাপন” বলতে বোঝানো হতো দুইজনের মধ্যে শুধু ব্রেইন প্রতিস্থাপন করা তাই এই প্রক্রিয়াটিকে সঠিকভাবে বোঝানোর জন্য নাম দেয়া হয়েছে মাথা প্রতিস্থাপন বা “Head Transplantation”. মূলত এই প্রক্রিয়াতে ব্রেইনসহ পুরো মাথাকে প্রতিস্থাপন করা হয় ।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে যা জানা যায় সর্বপ্রথম “মাথা প্রতিস্থাপন” করা হয় একটা কুকুরের , যেটি করেছিলেন একজন সোভিয়েত বিজ্ঞানী ” ভ্লাদিমির ডেমিকভ” ১৯৫৯ সালে । ভ্লাদিমির চেষ্টা করেছিলেন তাঁর পরীক্ষাকে সফল করার কিন্তু কুকুরটি অপারেশন শেষের কিছুক্ষণ পরই মারা যায় । এর পূর্বেও ভ্লাদিমির প্রায় ২৪ টি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন কিন্তু সবগুলোতেই ফলাফল একই । এটিকে বিজ্ঞানের একটা ব্যর্থতায় বলা চলে । যদিও অনেকে মনে করেন ভ্লাদিমির এর এই অবদান-ই পরবর্তীতে মানবদেহে অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পথকে সুগম করে ।

এখন ফিরে আসা যাক মানুষের “মাথা প্রতিস্থাপন” এর ব্যাপারে ।

ইতালীয়ান প্রফেসর সারজিও ক্যানাভেরো দাবি করেছেন যে বিশ্বের সর্বপ্রথম মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া চালানো হয় মৃতদেহের উপর যেটি করা হয় ১৮ ঘন্টাব্যাপী । এই অপারেশন পরিচালনা করেন ডা.শিয়াওপিং রেন এবং তাঁর টিম । এটি করা হয় চীনের হারবিন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে । ডা.শিয়াওপিং রেন এবং তাঁর টিমমেটদের দাবি তারা কিছুদিন আগে একটি বানররের মাথা প্রতিস্থাপন করেন সফলভাবে, যদিও অনেকে এ ব্যাপারে সন্ধিহান ।

এ ব্যাপারে একটি কনফারেন্সে প্রফেসর ক্যানাভেরো বলেছেন , ” প্রথম প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে মৃতদেহের উপর, এখন এটি জীবিত মানুষের উপর করা শুধুমাত্র সময়ের দাবি ।” তিনি আরো বলেন, “এরপরের ধাপে একজন মৃত ডোনার এর সাথে পূর্ণ মাথা বিনিময় করা হবে । তারপর আনুষ্ঠানিক প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে ।”

যখন প্রফেসর ক্যানাভেরো ২০১৬ সালে প্রথম এ ব্যাপারে প্রস্তাব করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন যে এই সার্জারিটি ২০১৭ সালের মধ্যে শেষ হবে । সে জন্য তিনি একজন রোগীর নামও ঘোষণা করেছিলেন — “ভ্যালারী স্পিরিডোনোভ” ।যদিও রোগীটি পরবর্তীতে অপারেশন করতে অস্বীকৃতি জানান বলে কথা শোনা যায়।তবে সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি ।কেউ কেউ দাবি করেছেন সেজন্য প্রফেসর এখন নতুন ভলেন্টিয়ার খুঁজে চলেছেন।

প্রফেসর ক্যনাভেরো তাঁর এই প্রক্রিয়াটি মানবদেহে কিভাবে চালানো হবে সে বিষয়ে বলেছেন। তাঁর মতে,

প্রথমে ডোনার এর শরীর ও মাথাকে ১২-১৫˚সে. এ শীতল করা হবে যাতে করে কোষগুলো অক্সিজেন ছাড়া কিছু সময় টিকে থাকতে পারে। তারপর গলার আশেপাশের টিস্যুগুলো কাটা হবে । তারপর ছোট ছোট রক্ত নালিকা গুলোকে আলাদা করে ধারালো ব্লেড দিয়ে স্পাইনাল কর্ডকে আলাদা করা হয় ।

এই সময় মাথা নড়াচড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় এবং স্পাইনাল কর্ডের দুই মাথা একীভূত করে দেয়া হবে পলিথিলিন গ্লাইকল নামক কেমিক্যাল দিয়ে ,যেটি কোষগুলোকে উজ্জীবিত করবে । এই কেমিক্যালটি অন্যান্য প্রাণীর স্পাইনাল কর্ড বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে । তবে প্রফেসর এছাড়াও “স্টেম সেল” অথবা অলফ্যক্টরী “এন্সহিটিং সেল” ব্যবহার এর কথাও জানিয়েছেন ।

সম্পূর্ণ টিস্যু ও রক্তনালীগুলো সফলভাবে সংযোগ করার পর রোগীকে কোমাতে রাখা হয় যাতে করে নতুন সংযোজিত কর্ডটি কম নড়াচড়া করে । এইসময়ে ইলেক্ট্রোগুলো স্পাইনাল কর্ডটিকে শক্তিশালী করতে কাজে লাগে ।

প্রফেসর মনে করেন এরপর থেকেই রোগী দ্রুত নড়াচড়া করার শক্তি ফিরে পাবে, মুখমণ্ডলের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবে , এমনকি একই আওয়াজে কথাও বলতে পারবে । একই ভাবে প্রায় ১ বছর এর মধ্যে রোগী হাঁটতেও পারবে ।

যাই হোক এগুলো ছিল প্রফেসর এর মতামত এবং তাঁর দাবি । এবার দেখা যাক তাঁর দাবির পক্ষে বিপক্ষে কতজন আছেন…

ডা. হান্ট বাটজির এর মতে, “আমি এ ব্যাপারে কাউকে উৎসাহিত করব না। আমি এটি কাউকে করার অনুমতি দিব না কারণ এক্ষেত্রে অনেক কিছু করতে হয় যা মৃত্যু থেকে ভয়ানক”

ডা. জেরি সিলভার যিনি ১৯৭০ সালের বানরের “মাথা প্রতিস্থাপন” প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি এই প্রক্রিয়াটিকে বিজ্ঞানের খারাপ দিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন । তিনি এই বিষয়টিকে একটি অনৈতিক হিসাবে দাবি করেন।

ডা. চ্যাড গরডন প্রফেসর অফ প্লাস্টিক সার্জারি,রিকন্সট্রাক্টিভ ও নিউরোলোজিক্যাল সার্জারি একমত যে প্রফেসর ক্যনাভেরো যে দাবি করেছেন তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অকল্পনীয় । কিন্তু তিনি মনে করেন একজনের ব্রেইন এর সাথে অপর একজনের স্পাইনাল কর্ড সংযুক্ত করা কোনভাবেই সম্ভব নয় । তিনি আরও বলেন, ” হয়ত এটি আরও একশ বছর পরে করা সম্ভব হতে পারে । কিন্তু তিনি যদি কথা দেন যে উনি একজন স্বাভাবিক মানুষ ফিরিয়ে দিতে পারবেন ,তাহলে উনি মিথ্যা বলছেন ।”

ডা. পল মায়ারস (এসোসিয়েট প্রফেসর অফ বায়োলজি,ইউনিভার্সিটি অফ মিন্নেসোটা,মরিস) বলেছেন, ” এই পদ্ধতিটি কাজ করবে না। এটি প্রথমে বানর এর উপর করা হয়েছে , কিন্তু সফলতা আসে নি। খুব বেশি সফল হলে রোগীটি হয় পাগল হয়ে যাবে এবং সাথে সারাজীবন মর্মান্তিক ব্যাথা সহ্য করতে হবে ।”

এছাড়াও অনেক বিজ্ঞানী আছেন যারা প্রফেসর ক্যানেভেরোর এই ট্রান্সপ্লান্টেশনের পদ্ধতিটিকে কাল্পনিক মনে করছেন।এই বিষয়ে প্রায় সব বিজ্ঞানী একমত যে এটি সম্ভব হলেও হতে পারে, তবে এই শতাব্দীতে এটি সম্ভব নয় ।

আর এই অপারেশন করতে গেলে দেড় কোটি ডলারেরও বেশি খরচ হবে , যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৩০ কোটি টাকা । যেটি প্রায় অসম্ভব ।

প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে কি কি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবেঃ

১) অপারেশন পরিচালনার জন্য ব্রেইন কে ১২-১৫ ˚সে এ আনতে হবে কিন্তু ডা. ক্রিস্টোফার (অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, নিউরোলোজিক্যাল সার্জারি, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি) এর মতে “যদি তাঁরা এই প্রক্রিয়াটি ১০ জনের উপর চালায় তাহলে ৩-৪ জন হয়তবা বেঁচে যেতে পারে ।” মানুষের জীবন নিয়ে এটা মূলত একটা তামাশা করার মত ঘটনা নয় কি ??!!

২) একীভূতকরণ অথবা জোড়া দেয়া যেটায় বলা হোক না কেনো এটির সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব-ই কম ।কারণ এটি পূর্বে অন্যান্য প্রাণীর উপর করা হয়েছে কিন্তু এটির সফলতা নেই বললেই চলে ।

কি কি সাইড ইফেক্ট দেখা দিতে পারে ?

যদি সার্জারিটি সঠিকভাবে চলে তাহলে এটি একটি বিস্ময়কর সাফল্য বিজ্ঞানের জন্য । কিন্তু অতীতেও একই কাজ সম্পাদন করা হয়েছিল যেটিতে শরীরের সাথে মাথার সামঞ্জস্য হয় নি, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্জন মাথা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সেটিতে প্রাণীটি ৮ দিন বেঁচে ছিল ।

এই বিষয়টির উপর অনলাইনে একটি ভোট নেয়া হয় পাঠকদের কাছ থেকে । সেখানে এই প্রক্রিয়ায় মাথা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব কিনা এই প্রশ্নের জবাবে ২৪০২ টি ভোটের মধ্যে প্রায় ৪৭% পাঠক বিশ্বাস করেন যে মাথা প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়, ৪৬% পাঠক বিশ্বাস করেন যে মাথা প্রতিস্থাপন সম্ভব তবে রোগী অনেক জটিল সমস্যায় পড়বেন , মাত্র ৭% পাঠক বিশ্বাস করেন যে মাথা প্রতিস্থাপন সম্ভব কোন রকম ঝামেলা ছাড়ায় ।

আজকের বিজ্ঞান কি পারবে এই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করতে ? উত্তর জানাটা এখন সময়ের দাবি মাত্র ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>