হাইজেনবার্গ এবং একটি অনিশ্চয়তার নীতি

সাধারণত “হাইজেনবার্গ” নামটি শুনলে যার চরিত্র মাথায় আসে তিনি হচ্ছেন জনপ্রিয় টিভি শো ‘Breaking Bad’ এর অভিনেতা Bryan Cranston এর চরিত্র অথবা অনিশ্চয়তা নিয়ে কিছু একটা। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার নীতি আসলে কী জিনিস? কীভাবে কাজ করে এটি? গত সপ্তাহে তাঁর এই নীতি ১১৭ বছরে পা দিল। সেই ট্রিবিউট হিসেবে আজকের এই লিখাটি।

বিজ্ঞানময় পূর্ববর্তী দিনগুলো
১৯০১ সালের ৫ই ডিসেম্বর জন্ম নেয়া ওয়ার্নার কার্ল হাইজেনবার্গ ছিলেন প্রখর মেধাবী একজন বিজ্ঞানী, যদিও তাঁর কিছু দুর্বলতাও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাব কোর্স গুলোতে হাইজেনবার্গ মোটেও ভালো ছিলেন না। আবার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের তখন একেবারে শৈশবকাল চলে। কিন্তু এই জায়গায় হাইজেনবার্গ নিজের প্রফেসরদের থেকেও বেশি জানতেন। সেজন্য প্রফেসররা ভাবতেন হয়ত হাইজেনবার্গ এক্সপেরিমেন্টাল কোর্সগুলোতেও সেরকম তুখোড় হবেন। সেজন্য সেইসময়ে ২১ বছর বয়সী হাইজেনবার্গের পিএইচডি থিসিস Hydrodynamics বুঝতে বিজ্ঞানীদের ২৫ বছর সময় লেগেছিল কারণ এটি এতটাই জটিল। আর হাইজেনবার্গ Hydrodynamics আর mathematics এ ভালো হওয়ার কারণে সেখানে A গ্রেড পেলেও তাকে পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্র থেকেই এই জটিল থিসিস লিখার জন্য উত্তর দিতে হয় যার কারণে সেগুলো প্রফেসরদের মনের মত না হওয়ায় তিনি পান F এবং গড় ফলাফল আসে C। এটাই ছিল তাঁর পিএইচডি এর গ্রেড। কিন্তু ভাগ্যক্রমে এই C তাঁর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনি তখনই Teaching Assistant হিসেবে University of Göttingen এ কর্মক্ষেত্র লাভ করেন। এবং সেজন্য তাকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় পৃথিবীর সেরা তিনটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান সেন্টারে তিনজন সেরা বিজ্ঞানীর সাথে। Arnold Sommerfeld, Max Born, এবং Niels Bohr. আমরা সবাই কমবেশি এদের চিনি। তাছাড়াও তিনি বন্ধু হোন Pauli এর সাথে যার নিজের নামে একটা নীতি আছে। হাইজেনবার্গ পুরোদমে নিজের ভবিষ্যৎ পদার্থবিজ্ঞানের কাছে সপে দিতে প্রস্তুত ছিলেন খারাপ গ্রেড থাকা সত্ত্বেও।

তখনকার সময়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনা ছিল শুধু পরমাণুর গঠন সম্পর্কিত। বোর আর সমারফিল্ডের মতে পরমাণুর গঠন হচ্ছে অনেকটা গ্রহের সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার মত। ঋণাত্বক আধানে আহিত ইলেক্ট্রনগুলো ধ্বনাত্বক চার্জে চার্জিত নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করছে। ইলেকট্রন গুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবদ্ধ থেকে ঘুরতে থাকে এবং তাঁদের রয়েছে নির্দিষ্ট শক্তিমাত্রা। তাঁরা কক্ষপথ পরিবর্তন করবে কেবল যদি শক্তি প্রদান করা হয়। হয় absorb অথবা emission spectrum পাওয়া যাবে এই পরিবর্তনে। যখন এরকম ঘটে, তখনই আমরা আলো দেখতে পাই। এই থিওরি dubbed হয়েছিল পরমাণুর কোয়ান্টাম মতবাদ নামে। যদিও এতে অনেক সমস্যাই রয়েছে তবে সেখান থেকে চমৎকার দুটি ধারণা মিলেছে, যা বর্তমান কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল নীতি। প্রথমটি হচ্ছে শক্তি নির্দিষ্ট কোয়ান্টা আকারে থাকে, সবসময় নিরবচ্ছিন্ন তরঙ্গ হবে এমন নয় এবং দ্বিতীয়ত আলোকে তরঙ্গ বা কণা দুই হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। এটাকে বলা হয় আলোর কণা- তরঙ্গ দ্বৈতনীতি।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পুরোনো থিওরির এই ব্যাপারগুলো এবং সমস্যা জন্ম দিল নতুন গবেষণার আহ্বান। হাইজেনবার্গ নতুন আরেকটি বিষয় উদ্ভাবন করলেন “Matrix Mechanics” এবং পাশাপাশি বিখ্যাত বিজ্ঞানী Erwin Schrödinger কনসেপ্ট দিলেন “Wave Mechanics” এর।

এ নিয়ে দুই পদার্থবিদদের মধ্যে হয় চরম বিতর্ক। কিন্তু দিন শেষে কেউই কোয়ান্টাম বিদ্যার ভেতরের ছবিটুকু নিজের থিওরির মাধ্যমে ফোটাতে সক্ষম হলেন না। যে জিনিসটা তখন প্রয়োজন ছিল সেটা হচ্ছে খুবই স্পষ্ট এক ব্যাখ্যা যা ছোটো পাল্লার কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যাকে বৃহৎ চিরায়ত পদার্থবিদ্যার সাথে সংযোগ তৈরি করে দিতে পারবে। এটা যে শুধু সহজ ছিল না এমন না, হাইজেনবার্গ বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা রীতিমতো অসম্ভব। কারণ আপনি একটি টেনিস বল উপরের দিকে ছুড়ে মারলে সবসময়ই এর ভরবেগ এবং অবস্থান জানতে পারবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কোয়ান্টাম স্তরে পৌঁছালে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। একটি কণার অবস্থান সম্পর্কে যত নিশ্চিত হবেন তাঁর ভরবেগ জানার অনিশ্চয়তা ততই বাড়বে এবং উল্টোভাবেও একই ব্যাপারটা। এর মানে এই নয় পদার্থবিজ্ঞান বা এক্সপেরিমেন্ট গুলো ভুল, এটার মানেই হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। হাইজেনবার্গ বিষয়গুলো চিঠি আকারে Pauli কে লিখে পাঠান যা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় রিসার্চ পেপারে এবং এটাই হয় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি!
তাহলে কীভাবে এটি কাজ করে?
এখানেই আসে কণা- তরঙ্গের দ্বৈতনীতি এবং পারিপার্শ্বিকের দৃষ্টির অবস্থান। বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্ট দ্বারা প্রমাণির হয়েছে যে আলো সেভাবেই আচরণ করবে যেভাবে আমরা এটিকে দেখব। আলোকে আমরা খালি চোখে যদি দেখি তবে এটি নিরবচ্ছিন্ন এক তরঙ্গ। কিন্তু কোনো ডিটেক্টর দিয়ে যদি হিসেব করতে চান এর গন্তব্য তাহলে তা আচরণ করবে কণা রূপে!
একইভাবে আপনি আলোর বেগ পরিমাপ করতে চাইলে সেটা হবে তরঙ্গ। অর্থাৎ আপনি তরঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন না। আবার যখন আপনি এর অবস্থান হিসাব করছেন তখন তা আসবে কণা রূপে কিন্তু তখন বেগ সম্পর্কে কিছুই জানবেন না।
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি এক টানাপোড়েনের জন্ম দেয়। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স জগৎের একটি বিখ্যাত ঘটনার ব্যাখ্যাও দেয়, “Quantum Tunneling”. সহজ ভাষায় টানেলিং বলতে বোঝায় ইলেক্ট্রনের মতো কণাগুলো কোনো একটি বাঁধা পেরিয়ে অপর প্রান্তে চলে যেতে পারে যা চিরায়ত বলবিদ্যায় অসম্ভব। আপনি যদি টানেলিং করা একটি কণার বেগ জানেন তবে এর অবস্থান সম্পর্কে কখনোই নিশ্চিত হতে পারবেন না অথবা এটি বাঁধা পার করে অপর প্রান্তে যাবে কী না সেটা জানা যাবেনা। ব্যাপারটা আরেকটা কনসেপ্টের সাথেও খাটে, ” Quantum Vaccum” যেটি বলে আমাদের মহাবিশ্বে রয়েছে অসংখ্য “ভার্চুয়াল কণা” যা সৃষ্টির সাথে সাথেই আবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হাইজেনবার্গের নীতি শক্তি ও সময়ের টার্ম দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়।
সুতরাং হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার এই নীতিকে ভয়ের কোনো কারণ নেই। নীতি সত্য বলেই বাস্তবতা সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে যেভাবে হওয়া উচিত।…

তথ্যসূত্রঃ Curiosity.com

Comments are closed.