আমাদের প্রত্যেকের ই নতুন বছর শুরু হয় নতুন দিনপঞ্জিকা বা ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যালেন্ডার দিয়ে । অফিস, বাসগৃহের দেয়াল কিংবা টেবিলে শোভা পায় নানান রকমের মনোহারি ক্যালেন্ডার।
কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি ক্যালেন্ডার যখন ছিল না তখন সঠিকভাবে সময় কিভাবে নির্ণয় করা হত ? বাস্তবিক-ই তখন সময় নির্ণয় ছিল বেশ দুরূহ একটি ব্যাপার ! মজার ব্যাপার হল তখন গতানুগতিক এই ক্যালেন্ডার না থাকলেও মানুষ দিনের হিসেব ঠিক-ই রাখত । কিন্তু সেটা কিভাবে ? আসুন জেনে নেয়া যাক প্রচলিত ক্যালেন্ডার তৈরির আগের ইতিহাস ।
ইতিহাস ঘাটলে অনেক ধরনের ক্যালেন্ডারের ইতিহাসের কথা জানা যায়।
সঠিক সময় নির্ধারণের জন্য একেক সময় একেক পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে মিশরীয় জ্যোতির্বিদরা একটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে দিবসকে ১২ ঘণ্টা ও রাত্রিকে ১২ ঘণ্টা হিসেবে ভাগ করে ২৪ ঘণ্টায় একটি পুরো দিন ধার্য করেন। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো একটি বিশেষ পানির ঘড়ি তৈরি করেছিলেন। যা দেখে তিনি তাঁর আশ্রমের ছাত্রদের অধ্যয়ন করতে বলতেন। রোমান সিনেটররা তাদের বক্তৃতার সময় ঠিক রাখার জন্য পানির ঘড়ি ব্যবহার করতেন।
প্রথম যে ক্যালেন্ডারের কথা জানা যায় তাঁর ভিত্তি ছিল চাঁদ । কেননা গ্রহ -নক্ষত্র ছাড়া চাঁদের কলার হ্রাস-বৃদ্ধির মতো এত বড় ঘটনা মানুষের নজর এড়াতে পারেনি । এছাড়া ঋতু পরিবর্তন ও পুনরায় আবর্তনের তুলনায় চাঁদের পরিবর্তনের সময় অপেক্ষাকৃত কম । ১৯৬৫ সালের কথা । ফ্রান্সে পাওয়া গেল ৩০ হাজার বছরের পুরনো হাড়ের টুকরা । এর এক পাশে আছে ৬৯ টি আলাদা দাগ। অনেকে ধারণা করলেন দাগগুলো শুধুই শিকারের হিসেব । তবে সেটা মানতে পারেন নি একজন ব্যক্তি, নাম তাঁর আলেকজান্ডার মাশরাক । তিনি মাইক্রোস্কোপের নিচে দাগগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করলেন এবং সিদ্ধান্তে আসলেন যে ওগুলো চাঁদের দশা পরিবর্তনের নমুনা।
এই ঘটনা নতুন না । এরকম আফ্রিকায় পাওয়া গিয়েছিল আরও একটি হাড় ,যা ৮৫০০ বছরের পুরনো । এতে দাগ আছে ১৬৮ টি । মাশরাক দেখান যে দাগগুলো সাড়ে পাঁচ মাসে নতুন ও পূর্ণ চাঁদের সাথে খাপ খায় । এথেকে উনি সিদ্ধান্ত নেন যে এগুলো দিন গণনা ছাড়া আর কিছু নয় ।
রোমান ক্যালেন্ডার
প্রাচীন রোম বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম । খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে ইতালীয় উপদ্বীপে এই সভ্যতার আবির্ভাব । রোমে মাসের প্রথম দিনকে বলা হত “ক্যালেন্ডি ” ( kalendae ) । এই শব্দটির ল্যাটিন রূপ ক্যালেন্ড্রিয়াম,যার মানে হিসাব খাতা । এটি থেকেই ইংরেজি ক্যালেন্ডার শব্দের উৎপত্তি ।
অনেকের মতে রোমানরাই পৃথিবীতে প্রথম ক্যালেন্ডার তৈরির দাবিদার। পণ্ডিত পণ্ডিফোরাই ৭৫৬ অব্দে এটি আবিষ্কার করেন। চাষাবাদের ওপর ভিত্তি করে এ ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করা হয় বলে এর মাসের সংখ্যা ছিল ১০। প্রবল শীতে ইউরোপে চাষাবাদ বন্ধ থাকতো বলে শীতের এই দু’মাস এতে ছিল না। শুক্লপক্ষের প্রথম চাঁদ দেখা দিলেই মাস গণনা শুরু হতো। ১০ মাসের ক্যালেন্ডারে দিনের সংখ্যা ছিল ৩০৪ । মার্চ মাস হতে বছর গণনা শুরু করা হত । ৩০ দিন বিশিষ্ট ৬ মাস ও ৩১ দিন বিশিষ্ট চার মাস সমন্বয়ে ৩০৪ দিন । দশম মাস ডিসেম্বরের পরে ছিল শীতের বিরতি । মজার ব্যাপার হল এ সময় আর দিন গণনা হত না !
এরপর দ্বিতীয় রোমান রাজা নিউ পম্পিলাসের রাজত্বকালে বছরের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য আরও ৫০ দিন যোগ করা হল । এটিকে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ভাগ করার জন্য ৬টি ৩০ দিনের মাস থেকে ৬ দিন ধার নিয়ে ৫৬ দিনকে দুই মাসে মধ্যে ভাগ করে দেয়া হল । এতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির দিন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮ । রোমে আবার জোড় সংখ্যা নিয়ে সে কি উপহাস ! তাই জানুয়ারির ১ দিন কমিয়ে বছর কে ৩৫৫ দিন করা হয় ।
এরপর পঞ্চম রাজা টারকুইনাস জানুয়ারি কে প্রথম মাস ও মারসিডোনিয়াস নামের একটি অধিমাস যুক্ত করে বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন । প্রতি ২ বছর পর ২৩ শে ও ২৪ শে ফেব্রুয়ারির মাঝে ২৭/২৮ দিনের এই অধিমাস টি যুক্ত করা হত ।তাই ২ বছর পর পর এই মাসটি ২২ / ২৩ দিনের একটি মাসে পরিণত হত । তাই চার বছরে দিন সংখ্যা দাঁড়ায় (৪*৩৫৫)+২২+২৩ =১৪৬৫ টিআর । এতে প্রতি বছরের দিন সংখ্যা দাঁড়ায় গড়ে ৩৬৬.২৫ টি ।
‘লিপইয়ার’-এর প্রচলন হয় রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের শাসনামল থেকে। জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রীক জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে (মতান্তরে নামটি সসিজেনিস) নিয়ে আসেন ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য। মোসাজিনিস দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। ৩৬৫ দিনে বছর হিসাব করা হলে এবং প্রতি চতুর্থ বছরে ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করা হলে কোনো গরমিল থাকে না। মোসাজিনিস অতিরিক্ত একদিন যুক্ত এ বছরটির নাম দেন ‘লিপইয়ার’ এবং সংশোধিত এই ক্যালেন্ডারের নাম দেন ‘জুলিয়াস ক্যালেন্ড’যা দীর্ঘ সময় চালু ছিল।
মোসাজিনিসের সমাধান সহজ হলেও সঠিক ছিলো না। কারণটা পরিষ্কার। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে গড়ে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড সময় নেয়। মূল সৌর বছরের সাথে জুলিয়ান বছরের পার্থক্য তাই প্রায় ১১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের!
পৃথিবীর আবর্তনের উপর ভিত্তি করে ২০-২২ জুনের মধ্যে কোন একটা তারিখ উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে লম্বা দিন (দক্ষিণ গোলার্ধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ছোট) ও ২১-২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে কোন একটা তারিখ সবচেয়ে ছোট দিন (দক্ষিণ গোলার্ধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে লম্বা)। এ সৌর ঘটনাগুলো সুনির্দিষ্ট। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে লিপ ইয়ার থাকা সত্ত্বেও দিনের হিসাব এলোমেলো হয় এ ধরনের নির্দিষ্ট সৌর ঘটনার কারণে। অবশ্য এমন ভুল জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রসারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বছর গণনার মানসম্মত ব্যবস্থা হিসাবে পরিচিতি পেয়ে যায় এটি।
বর্তমান ক্যালেন্ডার
ষোড়শ শতাব্দীতে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির উদ্যোগে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অচল হয়ে পড়ে। তবে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ভুল সংশোধনের জন্য তিনি এ কাজ করেন নি। কারণটা ধর্মীয়!
আগের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইস্টার ঠিক সময়ে পালন করা সম্ভব হচ্ছিলো না। ব্যাপারটা তৎকালীন ক্যাথলিক চার্চকে ভাবিয়ে তোলে। তাই ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াস নামের এক জ্যোতির্বিদকে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেন পোপ গ্রেগরি।
পরবর্তীতে জার্মান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টোফার ক্ল্যভিয়াস লিপ ইয়ারের জন্য কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেন ।
ক্ল্যাভিয়াসের প্রস্তাবনা অনুযায়ী লিপ ইয়ারের জন্য তিনটি শর্ত যোগ করা হয়ঃ
– বছরটিকে ৪ দিয়ে ভাগ করা যাবে।
– শতাব্দীর (যেমনঃ ২০০০, ১৯০০) বেলায় বছরটিকে ১০০ দিয়ে ভাগ করা গেলেই হবে না (জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে যেটি স্বাভাবিক ছিলো), একে ৪০০ দিয়েও ভাগ করা সম্ভব হবে।
১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন ক্যালেন্ডার কার্যকরী হয়। ধীরে ধীরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এ ব্যবস্থা। বিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
আমরা যে ইংরেজি বর্ষ পালন করি তা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী।
এবার দেখা যাক কিভাবে এলো এই ইংরেজি মাসের নাম—
জানুয়ারিঃ রোমে ‘জানুস’ নামক এক দেবতা ছিল। রোমবাসী তাকে সূচনার দেবতা বলে মানতো।
ফেব্রুয়ারিঃ যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৪৫০ বছর আগে দ্বিতীয় মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারির প্রচলন ছিল। সেকালে রোমানরা ‘ফেব্রুয়া’ নামে চিত্তশুদ্ধির উত্সব পালন করতো। ‘ফেব্রুয়া’ মানে পবিত্র। রোমানরা তাই এই মাসটিকে পবিত্র মনে করে।
মার্চঃ রোমান যুদ্ধ দেবতা ‘মারস’-এর নামানুসারে তারা মার্চ মাসের নামকরণ করেন।
এপ্রিলঃ ল্যাটিন শব্দ ‘এপিরিবি’ (যার অর্থ খুলে দেওয়া) থেকে এপ্রিল এসেছে।
মেঃ রোমানদের আলোকে দেবী ‘মেইয়ার’-এর নামানুসারে মাসটির নাম রাখা হয় মে।
জুনঃ রোমানদের নারী, চাঁদ ও শিকারের দেবী ছিলেন ‘জুনো’। আর তার নামেই জুনের নামকরণ করেন তারা।
জুলাইঃ জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে জুলাই মাসের নামকরণ।
আগস্টঃ জুলিয়াস সিজারের পর রোমের সম্রাট হন তারই ভাইয়ের ছেলে অগাস্টাস সিজার। তারই নামানুসারে এই মাসটির নামকরণ করা হয় ‘আগস্ট’।
সেপ্টেম্বরঃ সেপ্টেম্বর শব্দের শাব্দিক অর্থ সপ্তম। কিন্তু সিজারের বর্ষ পরিবর্তনের পর তা এসে দাঁড়ায় নবম মাসে। তারপর এটা কেউ পরিবর্তন করেনি।
অক্টোবরঃ ‘অক্টোবর’-এর শাব্দিক অর্থ অষ্টম। সেই মতে এটা অষ্টম মাস হওয়ার কথাঅ কিন্তু সেই অষ্টম মাস আমাদের ক্যালেন্ডারের এখন স্থান পেয়েছে দশম মাসে।
নভেম্বরঃ ‘নভেম’ শব্দের অর্থ নয়। সেই অর্থানুযায়ী তখন নভেম্বর ছিল নবম মাস। জুলিয়াস সিজারের কারণে আজ নভেম্বরের স্থান এগারোতে।
ডিসেম্বরঃ ল্যাটিন শব্দ ‘ডিসেম’ অর্থ দশম। সিজারের বর্ষ পরিবর্তনের আগে অর্থানুযায়ী এটি ছিল দশম মাস। কিন্তু আজ আমাদের কাছে এ মাসের অবস্থান ক্যালেন্ডারের শেষপ্রান্তে।
আরও একটা ব্যাপার আমরা যে বাংলা ক্যালেন্ডার দেখে ১লা বৈশাখ পালন করি তার প্রবর্তন করেছিলেন সম্রাট আকবর।
অফ টপিকঃ
কোন কিছুই আসলে নির্ভুল নয় । যদিও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে আমাদের কোন সমস্যা হয় না, একটা ব্যাপার খেয়াল রাখা দরকার। এ ব্যবস্থাতেও ছোট একটা সমস্যা থেকে গেছে। গ্রেগরিয়ান বছর মূল সৌর বছরের চেয়ে প্রায় ২৬-২৭ সেকেন্ড লম্বা। অর্থাৎ প্রতি ৩২৩৬ বছরে প্রায় ১ দিনের হিসাব ওলটপালট হবে এ ক্যালেন্ডারে।অবশ্য ৪৯০৯ সালের আগে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি !
অবশেষে বলা যায়, যদিও আধুনিক ক্যালেন্ডার তৈরির পেছনে রোমানদের ভূমিকাকেই বেশি মনে করা হয় তবে গ্রিক , মিসরীয় ,ভারতীয় ,চীনা ,মুসলিম ক্যালেন্ডারের ভূমিকাও অতুলনীয় ।