সৌরজগত
এই বিশাল পরিবারের অধিপতি সূর্য আর সদস্য মাত্র ৯ টি গ্রহ। আছে অসংখ্য গ্রহাণু, ধূমকেতু আর গ্রহদের উপগ্রহ। অনেক বিজ্ঞানীই এই সৌর পরিবারের জন্ম রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। এটি অনেকটা গোয়েন্দাগিরির মত। কারণ আজ থেকে ৫০০-৫৫০ বছর আগে আমরা কেউ জন্মাই নি। তবে সৌর পরিবারের অধিপতি ও সদস্যদের কিছু আচরণের প্রতি লক্ষ্য করলে তাদের জন্ম রহস্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী সৌরজগতেরসৃষ্টি রহস্য নিয়ে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। পূর্বে ভাবা হত সৌরজগত পৃথিবী কেন্দ্রিক যা গ্রাহ্য নয়। প্রথম সূর্য কেন্দ্রিক সৌর জগতের কথা বলেন গ্যালিলিও। এর রেনে দেকার্তে ও ইমানুয়েল কান্ট এই গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যান। ১৭৯৬ সালে ডি লাপ্লাস ও ১৯৪০ সালে ভাইৎস্যাকার সৌরজগত সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তত্ত্ব আবিষ্কার করেন তবে এর মাঝেও অনেক তত্ত্ব এসেছে। বর্তমানে আধুনিক সৌরজগত সৃষ্টি রহস্য এই সকল তত্ত্বের মিশেল।
আমাদের সৌরজগত সৃষ্টির মূল উপাদান ছিল আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘ। এটি হচ্ছে দুইটি নক্ষত্রের মধ্যকার স্থানে জমা ধূলিকণা, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, নানা ভারী মৌল ইত্যাদি। বিশাল স্থান জুড়ে এর অবস্থান। আস্তে আস্তে এরা ঘনীভূত হয়ে নক্ষত্রের আলো ভেদ করতে বাধা দেয় আর নিজে তাপ শোষণ করে উত্তপ্ত হয়।
এই আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘ সুষমভাবে না থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে অবস্থান করে। কিন্তু কেন্দ্রের ঘনত্ব বেশি থাকে। সূর্য সমান ভরের আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘ এইভাবে প্রায় দশ আলোকবর্ষ ব্যাপী। এই আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং বেশ কিছু ভারী মৌলের আধিক্য দেখা যায়। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই থাকে হাইড্রোজেন। আস্তে আস্তে এই মেঘ কেন্দ্রে আরও ঘনীভূত হয়ে উঠবে। কেন্দ্রে মহাকর্ষীয় পতনের সৃষ্টি হবে। আদি মেঘটি ঘূর্ণায়মান হয়। কেন্দ্রটি আরও সংকুচিত হয়ে আরও ঘূর্ণায়মান হয়ে ওঠে। ফলে জন্ম নেয় ভ্রূণ সূর্য।
ভ্রূণ সূর্য আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ও তাপ এবং আলো বিকিরণ করতে শুরু করে। প্রথমে অবলোহিত রশ্মি এবং বেশ কিছু সময় পরে দৃশ্যমান আলো বিকিরণ করে। এরপর কেন্দ্র যখন অনেক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তখন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হয় এবং জলে ওঠে সূর্য। ফলে ভ্রূণ সূর্য পরিপূর্ণ সূর্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
এভাবেই জন্ম হয়েছিল সূর্যের।
এবার আসা যাক সৌরজগতের অন্যান্য সদস্যদের জন্ম কথায়। কেন্দ্রে যখন সূর্য তৈরি হচ্ছে তখন এর আসে পাশের পদার্থগুলো ঘূর্ণনের ফলে আলাদা আলাদা চাকতির আকার নেয়। কেন্দ্রে নতুন সূর্য ও আশে পাশে ঘূর্ণায়মান চাকতি গুলোকে বলে সৌর নীহারিকা। এই সৌর নীহারিকার চাকতি গুলোতে প্রথমে গ্যাসের আধিপত্য থাকলেও পরে কঠিন পদার্থের উদ্ভব হতে থাকে। সৌর নীহারিকার কেন্দ্র থেকে যতই বাইরে যাওয়া যায়, ততই তাপমাত্রা কমতে থাকে। তাই কেন্দ্রে তুলনামূলক অনুদ্বায়ী পদার্থ থাকে যারা উষ্ণ তাপমাত্রায় কঠিন হয়ে যায়। ফলে কেন্দ্রে অনেক ছোট ছোট গ্রহাণু তৈরি হয়।
এই সময়ে মহাকর্ষীয় অস্থায়িত্বের কারণে সৌর নীহারিকায় কিছু ছোট ছোট ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়। ছোট ছোট গ্রহাণু গুলো পরস্পর একত্রিত হয়ে বড় আকার ধারণ করে তথা গ্রহের সৃষ্টি করে। সৌর নীহারিকার চাকতির ঘূর্ণনের দিকেই গ্রহ গুলো ঘুরতে থাকে সূর্যকে কেন্দ্র করে। ব্যতিক্রম হচ্ছে শুক্র ও ইউরেনাস। এদের হয়তো কোন বড় কোন বস্তুর সাথে ধাক্কা খেয়ে দিক পরিবর্তন হয়ে গেছে।
গ্রহাণু পুঞ্জ গুলো তৈরি হয়েছে যে গ্রহাণু গ্রহ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়নি তাদের দিয়ে। গ্রহ তৈরিতে এদের একত্রিত হতে হতো। কিন্তু গ্রহরাজ বৃহস্পতি যখন সৃষ্টি হল, এর শক্তিশালী আকর্ষণ দিয়ে আশেপাশের গ্রহাণুদের মারাত্মকভাবে আন্দোলিত করে। ফলে এরা আর একত্রিত হতে পারে না।
সদ্যজাত সূর্যের চারিদিকে যখন গ্রহ ও গ্রহাণু পুঞ্জ ঘুরছিল তখন সৌরজগতে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা ও অপ্রয়োজনীয় গ্যাস ছিল। এই জন্য সূর্যের একেবারে শৈশবে এক বিশেষ পর্যায়ের সৃষ্টি হয়। এই সময়ে সূর্য হতে শক্তিশালী ঝড়ো গতিতে পদার্থ উৎক্ষিপ্ত হতো। একে টি টরী দশা বলে। এর ফলে সৌর জগতের অপ্রয়োজনীয় বস্তুকণা, ধূলিকণা ও গ্যাস সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়। রয়ে যায় শুধু বড় বড় গ্রহ ও গ্রহাণু পুঞ্জ।
সৌরজগতের সম্পূর্ণ সৃষ্টি প্রক্রিয়াটির এখানেই শুভসমাপ্তি। মধুরেণ সমাপয়েৎ।