চা এর ইতিকথা

জনপ্রিয় পানীয়গুলোর মধ্যে চা অন্যতম। চা’কে ব্রিটিশ পানীয় হিসেবে ধরা হলেও এর ইতিহাস প্রায় ৫০০০ বছর পুরনো, যা প্রাচীন চীনা সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

চা কোথায় এবং কিভাবে আবিষ্কার হয়েছে?

চা এর আবিষ্কার নিয়ে অনেক ধরনের লোককথা প্রচলিত থাকলেও সবচেয়ে প্রচলিত কিছু ঘটনা হচ্ছে,
২৭৩৭ বি.সি.র কোন একদিন চীনা সম্রাট Shen Nung এবং তার সৈন্যসামন্তরা ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস গাছের নিচে অবস্থান করছিলেন। তখন রান্নার কাজ করার সময় কিছু চায়ের পাতা এসে ফুটন্ত পানির হাড়িতে পড়লে চায়ের ঘ্রাণে চারপাশ মেতে উঠে। আর সেদিনই প্রথম মানব হিসেবে সম্রাট চা পান করেন।
অন্য আরেকটি লোককথায় জানা যায়, ১৫০০-১০৪৬ বি.সি.র দিকে শ্যাং রাজবংশের Shang Dynasty কর্তৃক ঔষধীয় পানীয় হিসেবে চা আবিষ্কার হয়।
চা’য়ের জন্ম নিয়ে আরেকটি ভয়ংকর লোককথা জানা যায়। চান বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বৌদ্ধ ঘটনাচক্রে নয় বছরের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙার পর নিজের কাজের জন্য রাগে ক্ষোভে তিনি তার চোখের পাপড়ি কেটে ফেলেন। এই চোখের পাপড়িগুলো মাটিতে পড়ার ফলে শিকড় গজায় এবং গাছের জন্ম হয়।

চা এর উৎস

খ্রিস্টাব্দ ২০৬ থেকে ২২০ এর মধ্যবর্তী সময়ে চীনা রাজবংশ থেকে চা পান এর উৎপত্তি হয়। তবে চা পাতা প্রথমে ঔষধি হিসেবে গ্রহণ করা হতো। এই পাতাকে পানিতে ফুটিয়ে পানীয় পান করার আগে চিবিয়ে খাওয়ার প্রচলন ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ থেকে ২২১ এর দিকে চা পাতাতে পরিবর্তন আনা হয়। এতে অন্যান্য উপাদান হিসেবে আঁদা, কাঁচা খোসা, স্ক্যালিয়ন নামক পেঁয়াজ এবং করোনেল যুক্ত করা হয়। মুখরোচক পানীয় হিসেবে চা চীনাদের দৈনন্দিন খাবারের একটা অংশ হয়ে যায়। তবে জানা যায় জনপ্রিয় পদ্ধতি হিসেবে তারা চা’কে ভাত এবং মাংসের সাথে মিশিয়ে খেত।
১৬৩৬ থেকে ১৯১১ সালে যখন কিং রাজবংশ চীন শাসন ক্ষমতায় ছিল তখন চায়ের মধ্যে স্বাদে রূপে ভিন্নতা আনা হয়। এগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ইয়েলো টি, ওলোং টি, গ্রীন টি, ব্ল্যাক টি, হোয়াইট টি, ডার্ক টি, ফ্লাওয়ার টি সহ আরো নানা স্বাদের চা। চায়ের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে বহিঃবির্শ্বে চা রপ্তানি শুরু করে। এবং শীঘ্রই বহিঃবির্শ্বেও চা নিজের স্বাদ,ঘ্রাণ দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেয়।

চা এর বংশ পরিচয়

পানির পরে চা দ্বিতীয় জনপ্রিয় পানীয়। চা ভোক্তাদের জন্য বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় তিন মিলিয়ন টনের বেশি চা জন্মে। চা ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ। প্রায় ৩০-৫০ বছর পর্যন্ত এই গাছ বাচে। এর সবুজ কুঁড়িগুলো সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় চা এর জন্য। বাজারে বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের চা পাতার মধ্যে স্বাদে, গন্ধে পার্থক্য থাকার কারণ এর প্রক্রিয়াজাতকরণ এর ধরনে ভিন্নতা এবং পাতাগুলো সংগ্রহ করার পর কতদিন র’ অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকাসহ আর্জেন্টিনার অনেক অঞ্চলেই চা চাষ করা হয়। আমেরিকার কয়েকটি অঞ্চলেও চা চাষ করা হয়। বেলে মাটি এবং মাঝারি শুকনা দোঁআশ মাটিযুক্ত বন্য জায়গায় চায়ের ভালো ফলন হয়। ছায়াযুক্ত অঞ্চলেও এর ভালো ফলন হয়।
চা গাছ প্রায় ৯মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কিন্তু চাষের সুবাধে ১-২মিটার লম্বা হলেই ছাটাই করা হয়।

ইন্ডিয়ান টি

ব্রিটিশরা যখন এই ভারত উপমহাদেশ শাসন করে তখন তাদের মাধ্যমেই চীনা টি ভারত উপমহাদেশে পরিচিতি লাভ করে। চীনের একচেটিয়া মনোভাব ভেঙে দেয়ার জন্য ব্রিটিশরা ভারতীয়দেরকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে এই কাজ করে। ইন্ডিয়ার জলবায়ু, মাটি, আবহাওয়া চা চাষের অনুকূলে থাকায় তারা সঠিক রোপণ পদ্ধতি অবলম্বন করে চা চাষ শুরু করে। তবে তাদের চাষের পদ্ধতিতে ভিন্নতা ছিল। প্রাচীন ভারতীয়রা কখনোই চা’কে পানীয় হিসেবে গ্রহণ করত না বরং ঔষধি হিসেবে প্রাধান্য দিত। কিন্তু সময়ের সাথে তাদের স্বাদ বদলেছে। এখন চা সংস্থাগুলো টেটলি,টাইফুর মতো বিশ্বখ্যাত চা কোম্পানির সাথে কাজ করছে।

জাপানী টি

বিশ্বে জাপানই প্রথম “চা উৎসব” শুরু করে। তারা এই পানীয়টাকে এতটাই পছন্দ করেছিল যে তাদের ধর্মীয়গুরু এবং পুরোহিতদের জন্য চা পান অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে।

চা উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ এই পানীয়কে আরও কিভাবে নান্দনিক উপায়ে তৈরি করা হয় সেটা দেখানো হয়। ১৭৩৮ সালে Soen Nagatani ভিন্ন স্বাদের চা বাজারে আনেন। গ্রীন টি এর আনফার্মেন্টেড প্রকার নিয়ে কাজ করেন। জাপানে এই আনফার্মেন্টেড গ্রীন টি বর্তমানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।

ভিয়েতনামী টি

ভিয়েতনামের প্রসিদ্ধ চা দীর্ঘসময় ধরে ভিয়েতনামেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভিয়েতনামের নিজস্ব জনপ্রিয় চা লোটাস টি, জেসমিন টি বর্তমানে বহিঃর্বিশ্বেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

The different spices, herbs and Turkish tea powder are popular in tourist markets of Antalya, Turkey.

টার্কিশ টি

টার্কিশ ব্ল্যাক টি টার্কিশ কফির চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। তুরস্কে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা বাজার আছে বলে একে চায়ের দেশও বলা হয়।

শ্রীলঙ্কান টি

চীন, ভারত এবং কেনিয়ার পরে চতুর্থ বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী দেশ, শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় চা গুলোর মধ্যে সিলোন চা বিশ্বখ্যাত।

অতিরিক্ত চা পানের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

শতাব্দী ধরে চা ঔষধী নিরাময়কারী পানীয় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, চায়ের মধ্যে যে উদ্ভিজ্জ উপাদানগুলো আছে তা ক্যান্সার, স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে ভূমিকা রাখে।
সীমিত পরিমাণ চা পান শরীরের জন্য উপকারী হলেও প্রতিদিন ৩-৪ কাপ অর্থাৎ ৭১০-৯৫০মি.লি চা পানের ফলে শরীরে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

1.আয়রন শোষণ ক্ষমতা কমে যায়
2. ক্রমশে উদ্বেগ, চাপ, অস্থিরতা বৃদ্ধি করে
3. নিদ্রাহীনতা
4. বমি বমি ভাব
5. বুকজ্বালা করে
6. প্রেগন্যান্সি কমপ্লিকেশন দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় অধিক পরিমাণে ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে মিসক্যারেজের মত ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মায়। কিন্তু যেসব গর্ভবতী মায়েরা চায়ের প্রতি অ্যাডিক্টেড অনেক সময় ডাক্তাররা তাদেরকে হারবাল টি পান করতে বলে। হারবাল টিতেও এমন কিছু উপাদান আছে যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে প্রসববেদনা কমে যায়। 7. মাথা ঘোরানো
8. ক্যাফেইনের প্রতি আসক্তি এবং নির্ভরতা বাড়ায়
9. মাথাব্যথা

সুস্বাস্থ্যে চায়ের ভূমিকা

চা এ এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান আছে যা ভালো স্বাস্থ্যের সাথে সম্পৃক্ত। প্রধান রাসায়নিক উপাদানগুলোর মধ্যে আছে পলিফেনল, যা কেচিন (catechins) এবং এপিকেচিন্স (epicatechins) এর মধ্যে আছে। এই উপাদানগুলো চায়ের গুণাগুণকে আরও বেশি সমৃদ্ধশীল করে তোলে, বিশেষ করে গ্রীন টী কে। ব্ল্যাক এবং রেড টী’তেও এই উপাদানগুলো বিদ্যমান কিন্তু তা এতটাই সামান্য পরিমাণে যে সুস্বাস্থ্য খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারে না।

গ্রীন টি তৈরিতে ব্যবহৃত ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া এই পলিফেনল স্তরকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে
পলিফেনলস এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা অক্সিডেন্টগুলোকে নিরপেক্ষভাবে সংযুক্ত করে।
চা এবং সুস্বাস্থ্যের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে না কি তা দেখতেই হার্ভাড স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর গবেষকরা দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা চালান। গবেষণা থেকে জানা যায়,
যারা কম চা পান করেন তাদের চেয়ে যারা নিয়মিত পরিমির পরিমাণে চা পান করেন তাদের ডায়াবেটিকস, হাই কোলেস্টেরল, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কম থাকে। কারণ পলিফেনলগুলো রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম থাকে।
রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন বিরামহীনভাবে অঙ্কুরিত হয়ে কোষগুলোকে সিগন্যাল দেয়। ফলে গ্লুকোজ বিপাক শুরু হয়।

  • চা হার্ট অ্যাটার্ক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়
  • গ্রীন টি, ব্ল্যা টি ওজন কমাতে সাহায্য করে
  • চা হাড়ের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে
  • সাম্প্রতিক প্রানীর উপর একটা গবেষণায় উঠে এসেছে, মরিঙ্গা ( যা আমাদের দেশে সজিনা নামে পরিচিত) টি তে দুধের চেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম রয়েছে। পাশাপাশি ভিটামিন এ এবং কে, আয়রন রয়েছে যা হাড়কে মজবুত করতে দুর্দান্ত ভাবে কাজ করে।
  • চা আপনার হাসিকে আরও বেশি প্রাণবন্ত রাখে
    জাপানি গবেষক অর্ডাইন বলেছেন যে, “চা দাঁতের ক্ষয় হ্রাস করতে পারে।” চা পান করার পরে এটি মুখের পিএইচ এর মান পরিবর্তন করে। এমনকি এটি দাঁতে ক্যাভিটিস হওয়াও রোধ করতে পারে। আরেকজন গবেষক বনসি বলেছেন, “অন্যান্য ড্রিংকস যেমন দাঁতের এনামেলকে ক্ষয় করে চা তেমন কিছুই করে না।”

বিভিন্ন ধরনের চায়ের উপকারী দিকগুলো

Peppermint Tea ঐতিহ্যগত ভাবে পাচনতন্ত্রের অস্বস্তি দূর করার কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, পেপারমিন্ট তেল বমি বমিভাব, ক্র্যাম্পিং, খিঁচুনি এবং পেটের ব্যথা উপশম করতে ভূমিকা রাখে।

Hibiscus Tea উচ্চ রক্তচাপ কমাতে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। অ্যাসপিরিন বা মূত্রবর্ধক ঔষধ গ্রহণকালীন এই চা না পান করাই ভালো।

বমি বমিভাব দূর করতে Ginger Tea এর তুলনা হয় না। তাছাড়া আরও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে পিরিয়ডের ব্যথা উপশম করতে আদার চা সহায়তা করে। ডায়াবেটিকস আক্রান্তদের জন্যও আদার চা উপকারী।

গবেষণায় দেখা গেছে Passionflower Tea নিদ্রাহীনতা দূর করতে এবং অ্যানজাইটি হ্রাস করতে সাহায্য করে।

উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর Rose Hip Tea এর অ্যান্টিফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্যগুলো প্রদাহ এবং বাতের ব্যথা হ্রাসের সাথে জড়িত। পেটের মেদ কমাতে এর ভূমিকা তুলনাহীন। তাছাড়া ত্বকের অ্যান্টি এজিং এর বিরুদ্ধেও লড়াই করে রোজ হিপ টি।

প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে যে Lemon Balm Tea অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের স্তর বৃদ্ধি করে। হার্ট এবং ত্বকের অবস্থার উন্নতি করতে পারে। উদ্বেগ কমাতে সহায়তা করে।

Sage Tea স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে, কোলন হেলথ এবং হার্ট সুস্থ রাখার কাজ করে বলে জানা গেছে।

Rooibos Tea নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুব সম্প্রতি গবেষণা শুরু করেছেন। প্রাথমিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, রুইবোস চা হাড় মজবুত করতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে। তবে এ নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

Echinacea Tea সাধারণত ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা কমাতে এবং ঠাণ্ডাজনিত সমস্যার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে। তবে বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবাদ রয়েছে।

Chamomile Tea পিরিয়ডের ব্যথা উপশম করতে, হাই ব্লাড লিপিড, রক্তের শর্করা এবং ইনসুলিনের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করে। Chamomile Tea এর শান্তশিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত।

চা শরীরের জন্য উপকারী হলেও দুধ চা অর্থাৎ চা তে চিনি,দুধ ব্যবহার করার ফলে এর গুণাগুণ কমে যায়। এতে অতিরিক্ত ক্যালরি রয়েছে। আমাদের অনেকেরই দীর্ঘ সময় ধরে চা ফুটিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আছে। এতে শরীরের উপকারের চেয়ে ক্ষতিটা বেশি হয়।

রেফারেন্স :

১. https://www.ediblewildfood.com/tea-plant.aspx
২. https://www.health.harvard.edu/staying-healthy/tea-a-cup-of-good-health
৩. https://tea101.teabox.com/history-of-tea/৪.https://www.healthline.com/nutrition/10-herbal-teas#section2

Comments are closed.